গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সকাল-বিকাল ওনার ঘরের সামনের দিকে বসে ‘সিটিং’ করতেন (এই সিটিং পরম্পরা এখনও বজায় রয়েছে । এখন যাঁরা আশ্রমের সিনিয়র মহারাজ তাঁরাই সিটিং করেন), ওই সিটিং-এ যেসব আলোচনা হতো – তারই কিছু অংশ এখানে পরিবেশিত হচ্ছে ৷ আমরা আলোচনা করছিলাম ইংরেজ জাতি এবং তাদের ভাষা_র উদ্ভব বিষয়ে গুরু মহারাজ যা আলোচনা করেছিলেন সেই প্রসঙ্গে ! ওদের ভাষা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষা কোন মৌলিক ভাষা নয় – অনেকগুলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ইংরেজি ভাষা । গুরু মহারাজ যে ভাষাগুলির নাম করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে প্রাচীন কেল্টিক ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষার বেশি উপাদান এসেছিল ৷ ইউরোপ মহাদেশে ইংরেজি ভাষার থেকেও প্রাচীন ভাষা ছিল ল্যাটিন, গ্রীস ইত্যাদি ৷ এই ভাষাগুলি থেকে প্রচুর শব্দ ইংরেজিতে ঢুকে ভাষাটিকে অনেকটাই সমৃদ্ধ করেছে। ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকে ইংরেজরা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশ অর্থাৎ এক কথায় সমগ্র বিশ্বজুড়ে যেভাবে তাদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল যে ইংরেজদের ব্যবহৃত ভাষাই গোটা বিশ্বের ভাষায় রূপ নিতে বসেছিল ! নেহাত দেশ-কাল-পাত্র ভেদে মানুষের মুখের গঠন, জিহ্বার গঠন ইত্যাদি পৃথক হয় – তাই সব ভাষা সব ধরনের মানুষ ঠিকমত আয়ত্ত করতে পারে না । এই জন্যেই ভিন্ন ভিন্ন দেশে এতো ভাষার বৈচিত্র্য, না হলে তো সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সব মানুষের একটাই ভাষা হতো !
ইংরেজদের দাপটে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই প্রথম ভাষা ইংরেজী, কোন কোন দেশে ইংরেজী দ্বিতীয় ভাষা ৷ যে সব দেশে ওরা পা রেখেছিল তাদেরকে ইংরেজী ভাষাটিকে ওরা চট্ করে ভুলতে দেয়নি !
তবে গুরু মহারাজ বলেছিলেন বিশ্বের প্রাচীনতম এবং Most Scientific ভাষা সংস্কৃত । আগামী পৃথিবীতে সভ্য মানুষের ভাষা হবে সংস্কৃত । এমনকি কম্পিউটারের Main ভাষা হবে সংস্কৃত । কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা এখানে থেকেই যায় যে, সংস্কৃত যখন সবচাইতে প্রাচীন এবং Most Scientific তাহলে এই ভাষাটা dead languag-এ পরিণত হলো কেন ?? তার উত্তরে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় হাজার বছর ধরে) ভারতীয়রা পরাধীন থাকার সময় বিদেশীরা এদেশের প্রাচীন পুঁথিপত্র নষ্ট করে দিয়েছিল এবং আচার্যদেরকে মেরে ফেলেছিল ৷ ফলে উপযুক্ত আচার্যের অভাবে এদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতঅর্থে বিদ্যাশিক্ষার আর কোন চল্-ই ছিল না । গোটাকয়েক টোল এখানে ওখানে টিমটিম্ করছিল। তাছাড়া মধ্যযুগ থেকেই ভারতীয় বিদ্যাশিক্ষার নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছিল সমাজের উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণদের হাতে ! ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ব্রাহ্মণদের মধ্যে চরম একটা উন্নাসিকতা চলে এসেছিল, নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল যে তারা ছাড়া সমাজের আর কেউই বেদ পাঠের অধিকারী নয় । এইভাবে নিজেরাই শত সহস্রভাগে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলেছিল – দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদী – এইসব নাম দেখেই বোঝা যায় যে কার কতগুলি বেদে অধিকার বা কে কটা বেদে পন্ডিত – এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেই বিভেদ ছিল । তার উপরে কেউ সামবেদীয় ব্রাহ্মণ, কেউ যজুর্বেদীয়, আবার কেউ বা ঋকবেদীয় – কারো হয়তো বেদে-ই অধিকার নাই । কথিত আছে বাংলা সহ পূর্ব প্রান্তের ব্রাহ্মণদের মধ্যে নৈয়ায়িক বেশি ছিল বলে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণরা এখানকার ব্রাহ্মণসমাজকেই ব্রাত্য করে দিয়েছিল – এদেরকে বেদজ্ঞ বলে গ্রাহ্যই করা হতো না ।
আর এই জন্যেই কর্ণাটকের সেনবংশীরা যখন বাংলায় রাজত্ব করেছিল তখন কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে তাদের পারিবারিক যাগ-যজ্ঞ, বিভিন্ন সংস্কার-ক্রিয়াকর্মাদি সম্পন্ন করতেন । এই থেকেই বাংলাদেশে (পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা) কৌলিন্য প্রথার প্রচলন হয়ে গিয়েছিল । যারা কনৌজের ব্রাহ্মনের সাথে সম্পর্কযুক্ত তারাই কুলীন বা একটু উঁচু থাকের ! বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলি হাস্যকর মনে হলেও একসময় এখানকার সমাজে এইসব প্রথা (কৌলিন্য প্রথা) ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল !
যাইহোক, আবার ফিরে আসি ইংরেজ জাতির কথায় ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন ইংরেজী ভাষার একটা অন্যতম ভাল দিক একে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দিয়েছে – তা হল Acceptibility ! পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শব্দ এই ভাষায় ঢুকে ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করেছে ! কিন্তু ভারতীয় অধ্যাত্ম শাস্ত্রের ভাষাগুলি না ঢোকায় এখনো সেগুলির কোন ইংরেজি প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না ! যেমন সংস্কৃতে রয়েছে ” আত্মা, অজর-অমর-নিত্য-শাশ্বত-সনাতন ৷” এইযে “নিত্য-শাশ্বত-সনাতন”, এই তিনটিকে পৃথক পৃথক ভাবে ইংরেজিতে বলা যাবে না ! সবগুলিকে হয় Absolute না হয় Eternal বলে চালাতে হবে । অপরদিকে সংস্কৃতে বিদেশি শব্দ প্রায় ঢোকেই নি – তাই ভাষাটি সকলের গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি ! বহু পূর্বে হয়তো ভাষাটি সাধারণের ভাষা থাকলেও মধ্যযুগের পর থেকে এটি পণ্ডিতদের এবং রাজন্যবর্গের ভাষায় সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণ মানুষ Colloquial বলতো – এই রকমই একটি হলো ‘পালি’ ভাষা ।
ইংরেজ জাতির সাথে ফরাসী জাতির প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু কালের ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন ইতিহাসের সবচাইতে ‘দীর্ঘকালীন যুদ্ধ’ বা ‘শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে’-র কাহিনী । অতি সামান্য কারণে উভয় দেশের রাজন্যবর্গ বেশ কয়েক পুরুষ ধরে এই যুদ্ধ চালিয়েছিল ৷ উভয় দেশই এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল – কিন্তু কেউ কারো বশ্যতা মেনে নেয়নি বা আপোষ-মীমাংসাও করতে চায়নি !
ইতিহাসবিদরা এই যুদ্ধের উৎপত্তি সম্বন্ধে কি বলেছেন বা কি মতামত দিয়েছেন তা জানিনা – কিন্তু গুরু মহারাজের কাছে শতবর্ষব্যাপী চলা যুদ্ধের কারণ সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম সেটা আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই পরিবেশন করব _কিন্তু সেটা হবে পরের সংখ্যায়।।(ক্রমশঃ)
ইংরেজদের দাপটে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই প্রথম ভাষা ইংরেজী, কোন কোন দেশে ইংরেজী দ্বিতীয় ভাষা ৷ যে সব দেশে ওরা পা রেখেছিল তাদেরকে ইংরেজী ভাষাটিকে ওরা চট্ করে ভুলতে দেয়নি !
তবে গুরু মহারাজ বলেছিলেন বিশ্বের প্রাচীনতম এবং Most Scientific ভাষা সংস্কৃত । আগামী পৃথিবীতে সভ্য মানুষের ভাষা হবে সংস্কৃত । এমনকি কম্পিউটারের Main ভাষা হবে সংস্কৃত । কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা এখানে থেকেই যায় যে, সংস্কৃত যখন সবচাইতে প্রাচীন এবং Most Scientific তাহলে এই ভাষাটা dead languag-এ পরিণত হলো কেন ?? তার উত্তরে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় হাজার বছর ধরে) ভারতীয়রা পরাধীন থাকার সময় বিদেশীরা এদেশের প্রাচীন পুঁথিপত্র নষ্ট করে দিয়েছিল এবং আচার্যদেরকে মেরে ফেলেছিল ৷ ফলে উপযুক্ত আচার্যের অভাবে এদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতঅর্থে বিদ্যাশিক্ষার আর কোন চল্-ই ছিল না । গোটাকয়েক টোল এখানে ওখানে টিমটিম্ করছিল। তাছাড়া মধ্যযুগ থেকেই ভারতীয় বিদ্যাশিক্ষার নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছিল সমাজের উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণদের হাতে ! ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ব্রাহ্মণদের মধ্যে চরম একটা উন্নাসিকতা চলে এসেছিল, নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল যে তারা ছাড়া সমাজের আর কেউই বেদ পাঠের অধিকারী নয় । এইভাবে নিজেরাই শত সহস্রভাগে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলেছিল – দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদী – এইসব নাম দেখেই বোঝা যায় যে কার কতগুলি বেদে অধিকার বা কে কটা বেদে পন্ডিত – এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেই বিভেদ ছিল । তার উপরে কেউ সামবেদীয় ব্রাহ্মণ, কেউ যজুর্বেদীয়, আবার কেউ বা ঋকবেদীয় – কারো হয়তো বেদে-ই অধিকার নাই । কথিত আছে বাংলা সহ পূর্ব প্রান্তের ব্রাহ্মণদের মধ্যে নৈয়ায়িক বেশি ছিল বলে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণরা এখানকার ব্রাহ্মণসমাজকেই ব্রাত্য করে দিয়েছিল – এদেরকে বেদজ্ঞ বলে গ্রাহ্যই করা হতো না ।
আর এই জন্যেই কর্ণাটকের সেনবংশীরা যখন বাংলায় রাজত্ব করেছিল তখন কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে তাদের পারিবারিক যাগ-যজ্ঞ, বিভিন্ন সংস্কার-ক্রিয়াকর্মাদি সম্পন্ন করতেন । এই থেকেই বাংলাদেশে (পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা) কৌলিন্য প্রথার প্রচলন হয়ে গিয়েছিল । যারা কনৌজের ব্রাহ্মনের সাথে সম্পর্কযুক্ত তারাই কুলীন বা একটু উঁচু থাকের ! বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলি হাস্যকর মনে হলেও একসময় এখানকার সমাজে এইসব প্রথা (কৌলিন্য প্রথা) ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল !
যাইহোক, আবার ফিরে আসি ইংরেজ জাতির কথায় ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন ইংরেজী ভাষার একটা অন্যতম ভাল দিক একে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দিয়েছে – তা হল Acceptibility ! পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শব্দ এই ভাষায় ঢুকে ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করেছে ! কিন্তু ভারতীয় অধ্যাত্ম শাস্ত্রের ভাষাগুলি না ঢোকায় এখনো সেগুলির কোন ইংরেজি প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না ! যেমন সংস্কৃতে রয়েছে ” আত্মা, অজর-অমর-নিত্য-শাশ্বত-সনাতন ৷” এইযে “নিত্য-শাশ্বত-সনাতন”, এই তিনটিকে পৃথক পৃথক ভাবে ইংরেজিতে বলা যাবে না ! সবগুলিকে হয় Absolute না হয় Eternal বলে চালাতে হবে । অপরদিকে সংস্কৃতে বিদেশি শব্দ প্রায় ঢোকেই নি – তাই ভাষাটি সকলের গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি ! বহু পূর্বে হয়তো ভাষাটি সাধারণের ভাষা থাকলেও মধ্যযুগের পর থেকে এটি পণ্ডিতদের এবং রাজন্যবর্গের ভাষায় সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণ মানুষ Colloquial বলতো – এই রকমই একটি হলো ‘পালি’ ভাষা ।
ইংরেজ জাতির সাথে ফরাসী জাতির প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু কালের ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন ইতিহাসের সবচাইতে ‘দীর্ঘকালীন যুদ্ধ’ বা ‘শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে’-র কাহিনী । অতি সামান্য কারণে উভয় দেশের রাজন্যবর্গ বেশ কয়েক পুরুষ ধরে এই যুদ্ধ চালিয়েছিল ৷ উভয় দেশই এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল – কিন্তু কেউ কারো বশ্যতা মেনে নেয়নি বা আপোষ-মীমাংসাও করতে চায়নি !
ইতিহাসবিদরা এই যুদ্ধের উৎপত্তি সম্বন্ধে কি বলেছেন বা কি মতামত দিয়েছেন তা জানিনা – কিন্তু গুরু মহারাজের কাছে শতবর্ষব্যাপী চলা যুদ্ধের কারণ সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম সেটা আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই পরিবেশন করব _কিন্তু সেটা হবে পরের সংখ্যায়।।(ক্রমশঃ)