শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক যেসব আলোচনা করেছিলেন, তার অংশবিশেষ এখানে সবার সাথে শেয়ার করা হচ্ছিল । সেই সঙ্গে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গেও কিছু কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যাচ্ছে – কিন্তু সেগুলোও স্বামী পরমানন্দের কোনো না কোনো আলোচনা সূত্র থেকেই বলা ! এর মধ্যে যদি কোনো মতামত সংকলকের হয় – সুধী পাঠক অবশ্যই তা ধরে ফেলবেন বলেই আমার বিশ্বাস ৷ কারণ সেই কথাগুলি মনে দাগ কাটবে না – মনকে নাড়া দেবে না, ‘আহা কি শুনলাম!’– এই ভাবটা আসবে না ৷ অপরপক্ষে গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের যে কোনো কথা শুনলেই যেন মনে হবে – “বাঃ ! এ তো বেশ কথা ! এ যেন নতুন কথা শুনছি ! এমনটা তো আগে কখনো শুনিনি ! এমন করে তো কেউ কখনো ব্যাখ্যা করেনি !”
তাই সেই পরম করুণাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দকে স্মরণ করেই আজ আবার আমরা প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি ! এই কথাগুলি যখন লিখতে বসছি তখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর প্রভাবে প্রায় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, কোথাও কোথাও সঙ্গে রয়েছে ঝোড়ো হাওয়া – অর্থাৎ চরম দুর্যোগপূর্ণ দিন ! কিন্তু গুরু মহারাজ বলেছিলেন – (সম্ভবত এটি শাস্ত্রোক্ত কথা !) ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত দিনটি মানব জীবনে দুর্যোগপূর্ণ দিন নয়, সেই দিনটিই মানবের জীবনে দুর্যোগপূর্ণ __যে দিনে ভগবানের (ঈশ্বরের) স্মরণ হ’ল না !
এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে একটা কথা, যা চক্ষণযাদীর টগর মল্লিকের কাছে শুনেছিলাম – সেইটা বলেই ফেলি ! 1978 সালের 26/27 শে সেপ্টেম্বর – সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং বন্যার তাণ্ডব । তখনও বনগ্রাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয় নাই – সবে বনগ্রামে গুরু মহারাজের (তখন রবীন) জন্য একটা কুঁড়ে ঘর তৈরি করা হয়েছিল কারণ উনি কথা দিয়েছিলেন, উনি বনগ্রামে যে কোনো সময় চলে আসতে পারেন । কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ওই ঘরটিও নষ্ট হয়ে গেছিল – আর গুরু মহারাজ তখন ছিলেন দামোদরের ধারে চক্ষণজাদি গ্রামের টগর মল্লিকদের বাড়িতে । গোটা গ্রামটা তখন ধুলিস্যাৎ অবস্থা – গ্রামের সমস্ত মাটির বাড়ি পড়ে গেছে, বহু গবাদি পশু মারা গেছে – গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা একটু উঁচু জায়গার খোঁজ হয় নদীবাঁধে অথবা কোন না কোন পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল । টগরদেরও পাকা বাড়ি ছিল – তাই গ্রামের বহু মানুষ প্রাণের দায়ে সেখানে জড়ো হয়েছিল ৷ গুরুমহারাজ কয়েকজন যুবককে নিয়ে টগরদার মা-য়ের (অত্যন্ত স্নেহময়ী এবং সকলের প্রতি মমতাশীল মহিলা) কাছ থেকে খাবারের উপকরণ চেয়ে নিয়ে উপস্থিত সকলের প্রাণ ধারণের মতো খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন । এমন সময় সন্ধ্যা আগত – কিন্তু পাশের মসজিদে আজানের ধ্বনি নেই । কে দেবে আজান ? মোয়াজিন তো প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে ! গ্রামের মধ্যে দিয়ে তখন বাঁধভাঙ্গা দামোদরের প্রাণঘাতী জলস্রোত প্রবাহমান ! কে নামবে সেই জলে ? তাই সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালের (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে এটি একটি) নামাজের আজান বন্ধ ! সেই দিনটি ছিল ওই গ্রামবাসী সকলের কাছে চরম দুর্যোগের দিন – তাই ঈশ্বর-আল্লাহ সকলের ভজন-পূজন বন্ধ !
কিন্তু সাক্ষাৎ ভগবান সেখানে উপস্থিত – সবাই ভুলে গেলেও সে যে নিত্য বর্তমানে স্থিত, তাই তার ভুলটি হবার জো নাই ! সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঠিক সময়ে গুরুমহারাজ (রবীন) টগর-কে ডেকে বলেছিলেন – ” কি গো ! আজ তো এখনো মসজিদে আজান দিল না !” টগর মল্লিক বা অন্যান্যরা বলে উঠেছিল – ” আজ আর আজান কে দেবে ? সবাই নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ! আপনি বাঁচলে আল্লাহর নাম !”
তখন গুরুমহারাজ টগর মল্লিককে বলেছিলেন – “সে কি কথা ! তাই বলে আজান হবে না ! এই বাড়ির ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে তুমি-ই আজান দাও !” টগর বলেছিল – ” কিন্তু দাদা (ওরা গুরু মহারাজ বা তৎকালীন রবীনকে ‘দাদা’-ই বলত !) | আমি তো আজানের কথা ও সুর ঠিকমতো জানি না !” গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “চলো, আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি ! আমার কাছে শুনে শুনে তুমি আজান দেবে – চলো ।” টগর মল্লিক সেদিন ঐ আশ্চর্য মানুষটির কাছ থেকে আজানের মন্ত্র শিখে নিয়ে ‘আজান’ দিয়েছিল ৷
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণের কথা (আজ ভগবান বুদ্ধের কথা আমাদের মাথায় থাক্_ভগবানের অন্য লীলার কথাই হোক।) ! তৎকালীন দক্ষিণেশ্বরের পাশেই এঁড়েদা বা আড়িয়াদহ তখন নিছক গ্রাম বললেই চলে ! আড়িয়াদহে একটি ছোট মসজিদ ছিল এবং সেখানকার যিনি মোয়াজিন তথা মৌলভী ছিলেন – তিনি খুবই সহজ-সরল ভালো মানুষ ছিলেন ৷ তখনকার দক্ষিণেশ্বরে তো বেশি লোকজন যাতায়াত করতো না – তিথি-নক্ষত্র বিশেষে লোকজন হতো এবং রানীর বাঁধানো ঘাটে স্থানীয় বহু মানুষজন স্নান করতে আসতো । ওই মোয়াজিন মাঝে মাঝেই ঠাকুরের কাছে আসতেন – ওনাদের মধ্যে নানান গল্প-গুজব হতো । প্রতিদিন সকালে ও বিকালে নির্দিষ্ট সময়ে ওই মোয়াজিন মসজিদ থেকে আজান দিতো (তখনকার দিনে মসজিদে মাইক ছিল না – মানুষের গলার জোর-ই ছিল সম্বল), ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির থেকেই তা শুনতে পেতেন ।
কিন্তু একদিন ঠাকুর আজান ধ্বনি শুনতে পান নি – অথচ সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজানের ধ্বনি আসছে না – দেখে উনি নিজেই হেঁটে আড়িয়াদহের ঐ মসজিদে চলে গেলেন । গিয়ে দেখেন যে মৌলভীটি প্রায় জ্বরে বেঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন ওই ছোট্ট মসজিদে মোয়াজিনের ভূমিকা পালন করলেন – আজান ধ্বনি দিয়েছিলেন ঠাকুর ! গ্রামবাসী বুঝতেও পারেনি, তারা মনে করেছিল বোধয় ঐ মোয়াজিনেরই কন্ঠস্বর!
তখন আর ক’জনই বা মসজিদে নামাজ পড়তে আসতো ! তবু যে ক’জনই বা আসতো – তাদেরকে দেখতে পেয়ে ঠাকুর ওই মোয়াজিনের চিকিৎসা ও শুশ্রূষার ব্যবস্থা করতে বলে ফিরে গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। (ক্রমশঃ)
তাই সেই পরম করুণাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দকে স্মরণ করেই আজ আবার আমরা প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি ! এই কথাগুলি যখন লিখতে বসছি তখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর প্রভাবে প্রায় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, কোথাও কোথাও সঙ্গে রয়েছে ঝোড়ো হাওয়া – অর্থাৎ চরম দুর্যোগপূর্ণ দিন ! কিন্তু গুরু মহারাজ বলেছিলেন – (সম্ভবত এটি শাস্ত্রোক্ত কথা !) ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত দিনটি মানব জীবনে দুর্যোগপূর্ণ দিন নয়, সেই দিনটিই মানবের জীবনে দুর্যোগপূর্ণ __যে দিনে ভগবানের (ঈশ্বরের) স্মরণ হ’ল না !
এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে একটা কথা, যা চক্ষণযাদীর টগর মল্লিকের কাছে শুনেছিলাম – সেইটা বলেই ফেলি ! 1978 সালের 26/27 শে সেপ্টেম্বর – সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং বন্যার তাণ্ডব । তখনও বনগ্রাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয় নাই – সবে বনগ্রামে গুরু মহারাজের (তখন রবীন) জন্য একটা কুঁড়ে ঘর তৈরি করা হয়েছিল কারণ উনি কথা দিয়েছিলেন, উনি বনগ্রামে যে কোনো সময় চলে আসতে পারেন । কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ওই ঘরটিও নষ্ট হয়ে গেছিল – আর গুরু মহারাজ তখন ছিলেন দামোদরের ধারে চক্ষণজাদি গ্রামের টগর মল্লিকদের বাড়িতে । গোটা গ্রামটা তখন ধুলিস্যাৎ অবস্থা – গ্রামের সমস্ত মাটির বাড়ি পড়ে গেছে, বহু গবাদি পশু মারা গেছে – গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা একটু উঁচু জায়গার খোঁজ হয় নদীবাঁধে অথবা কোন না কোন পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল । টগরদেরও পাকা বাড়ি ছিল – তাই গ্রামের বহু মানুষ প্রাণের দায়ে সেখানে জড়ো হয়েছিল ৷ গুরুমহারাজ কয়েকজন যুবককে নিয়ে টগরদার মা-য়ের (অত্যন্ত স্নেহময়ী এবং সকলের প্রতি মমতাশীল মহিলা) কাছ থেকে খাবারের উপকরণ চেয়ে নিয়ে উপস্থিত সকলের প্রাণ ধারণের মতো খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন । এমন সময় সন্ধ্যা আগত – কিন্তু পাশের মসজিদে আজানের ধ্বনি নেই । কে দেবে আজান ? মোয়াজিন তো প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে ! গ্রামের মধ্যে দিয়ে তখন বাঁধভাঙ্গা দামোদরের প্রাণঘাতী জলস্রোত প্রবাহমান ! কে নামবে সেই জলে ? তাই সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালের (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে এটি একটি) নামাজের আজান বন্ধ ! সেই দিনটি ছিল ওই গ্রামবাসী সকলের কাছে চরম দুর্যোগের দিন – তাই ঈশ্বর-আল্লাহ সকলের ভজন-পূজন বন্ধ !
কিন্তু সাক্ষাৎ ভগবান সেখানে উপস্থিত – সবাই ভুলে গেলেও সে যে নিত্য বর্তমানে স্থিত, তাই তার ভুলটি হবার জো নাই ! সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঠিক সময়ে গুরুমহারাজ (রবীন) টগর-কে ডেকে বলেছিলেন – ” কি গো ! আজ তো এখনো মসজিদে আজান দিল না !” টগর মল্লিক বা অন্যান্যরা বলে উঠেছিল – ” আজ আর আজান কে দেবে ? সবাই নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ! আপনি বাঁচলে আল্লাহর নাম !”
তখন গুরুমহারাজ টগর মল্লিককে বলেছিলেন – “সে কি কথা ! তাই বলে আজান হবে না ! এই বাড়ির ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে তুমি-ই আজান দাও !” টগর বলেছিল – ” কিন্তু দাদা (ওরা গুরু মহারাজ বা তৎকালীন রবীনকে ‘দাদা’-ই বলত !) | আমি তো আজানের কথা ও সুর ঠিকমতো জানি না !” গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “চলো, আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি ! আমার কাছে শুনে শুনে তুমি আজান দেবে – চলো ।” টগর মল্লিক সেদিন ঐ আশ্চর্য মানুষটির কাছ থেকে আজানের মন্ত্র শিখে নিয়ে ‘আজান’ দিয়েছিল ৷
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণের কথা (আজ ভগবান বুদ্ধের কথা আমাদের মাথায় থাক্_ভগবানের অন্য লীলার কথাই হোক।) ! তৎকালীন দক্ষিণেশ্বরের পাশেই এঁড়েদা বা আড়িয়াদহ তখন নিছক গ্রাম বললেই চলে ! আড়িয়াদহে একটি ছোট মসজিদ ছিল এবং সেখানকার যিনি মোয়াজিন তথা মৌলভী ছিলেন – তিনি খুবই সহজ-সরল ভালো মানুষ ছিলেন ৷ তখনকার দক্ষিণেশ্বরে তো বেশি লোকজন যাতায়াত করতো না – তিথি-নক্ষত্র বিশেষে লোকজন হতো এবং রানীর বাঁধানো ঘাটে স্থানীয় বহু মানুষজন স্নান করতে আসতো । ওই মোয়াজিন মাঝে মাঝেই ঠাকুরের কাছে আসতেন – ওনাদের মধ্যে নানান গল্প-গুজব হতো । প্রতিদিন সকালে ও বিকালে নির্দিষ্ট সময়ে ওই মোয়াজিন মসজিদ থেকে আজান দিতো (তখনকার দিনে মসজিদে মাইক ছিল না – মানুষের গলার জোর-ই ছিল সম্বল), ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির থেকেই তা শুনতে পেতেন ।
কিন্তু একদিন ঠাকুর আজান ধ্বনি শুনতে পান নি – অথচ সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজানের ধ্বনি আসছে না – দেখে উনি নিজেই হেঁটে আড়িয়াদহের ঐ মসজিদে চলে গেলেন । গিয়ে দেখেন যে মৌলভীটি প্রায় জ্বরে বেঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন ওই ছোট্ট মসজিদে মোয়াজিনের ভূমিকা পালন করলেন – আজান ধ্বনি দিয়েছিলেন ঠাকুর ! গ্রামবাসী বুঝতেও পারেনি, তারা মনে করেছিল বোধয় ঐ মোয়াজিনেরই কন্ঠস্বর!
তখন আর ক’জনই বা মসজিদে নামাজ পড়তে আসতো ! তবু যে ক’জনই বা আসতো – তাদেরকে দেখতে পেয়ে ঠাকুর ওই মোয়াজিনের চিকিৎসা ও শুশ্রূষার ব্যবস্থা করতে বলে ফিরে গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। (ক্রমশঃ)