শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে বা অন্যান্য স্থানে ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক যে সমস্ত আলোচনা করেছিলেন – সেইগুলি এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল । অবশ্যই মাঝে মাঝে ভগবান বুদ্ধের-ই অন্যান্য রূপগুলির কথা(ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী পরমানন্দ) এসেই যাচ্ছে ! তবে আজকে বুদ্ধের কথা ।৷
গুরুমহারাজ বলেছিলেন –দুই ধরনের বুদ্ধের রূপ এবং কার্যকারিতা পৃথক! তথাগত বুদ্ধ শান্ত – সমাহিত, আর অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ জীবজগতের কল্যাণের জন্য সদা নিয়োজিত, সদা তৎপর। প্রথম দলের ‘বুদ্ধ’-গণ যেন সূর্যের মতো – দূর থেকে পৃথিবী গ্রহের জীবজগৎ-জড়জগৎ সকলের মঙ্গল সাধন করে যাচ্ছেন এবং দ্বিতীয় দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন প্রেম ও করুণায় পরিপূর্ণ। তাই সূর্যের সমস্ত তাপ-ঔজ্জ্বল্য ঢেকে-ঢুকে জীবের কাছে কাছে এসে, তাদেরকে স্পর্শ করে, তাদের স্পর্শ নিয়ে তাদের কল্যাণ করা – তাদেরকে আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নত করার গুরুদায়িত্ব এঁনাদের !
গুরুমহারাজ খুব সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন । উনি বলেছিলেন – ” যেমন ধর, একদল লোক একটা গর্তের মধ্যে থাকা পাঁক-কাদাজলের মধ্যে পড়ে গিয়ে, পরস্পর পরস্পরে কাদা মাখামাখি করছে । অনেকে হয়তো গর্ত থেকে উঠতে চাইছে – কিন্তু হায় ! বারবার পিছলে পিছলে পড়ে যাচ্ছে অথবা অন্যরা তাকে টেনে নামিয়ে নিচ্ছে! এইবার সেই স্থানে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি (প্রথম দলের মহাপুরুষ) এসে গর্তে পড়ে যাওয়া মানুষগুলির দুরবস্থা দেখে ব্যথিত হলেন এবং তারা কিভাবে, কোন কায়দায় ওই গর্ত থেকে বেরোতে পারে এবং তাদের গায়ের নোংরা কাদা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে পারে তার নিখুঁত উপায়গুলি বলে দিতে শুরু করলেন ৷ তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে এবং জ্ঞানলাভ করে অনেকেই সেই গর্ত থেকে উঠে আসতে লাগল । উঠে এসে তারা নিজেদের গায়ে লেগে থাকা সমস্ত নোংরা আবর্জনা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেলতে পারল।
কিন্তু ঐ স্থানে যদি অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ (দ্বিতীয় দলের মহাপুরুষ) আসেন, তাহলে তিনি কর্দমাক্ত এবং নিজেদের মধ্যে কাদা মাখামাখি খেলায় মত্ত ওই মানুষগুলিকে দেখে প্রেমে-করুণায় আর স্থির থাকতে পারেন না – নিজেই লাফিয়ে ওই কাদার মধ্যে নেমে পড়েন এবং বাছাবাছি না করে কাদা-মাখামাখি করা সমস্ত ব্যক্তিকে খপাখপ ধরে, চাগিয়ে ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে উপরে তুলে দেন। এইজন্য তাঁকেও কিছুটা কাদা মাখতে হয়, কিন্তু তাতে কি ? মা যখন কাদামাখা শিশুকে ধরে পরিষ্কার করেন – তখন তাঁর কি হাতে গায়ে একটু কাদা লাগে না ? এক্ষেত্রেও তেমন-ই হয় । প্রেমের এমন মহিমা, তখন কারো কোন দোষ-ই দোষ বলে মনে হয় না, তখন কোথাও কোন Negative-ই দেখা যায় না, তখন শুধুই Positive আর Positive !” ভগবান পরমানন্দ বলেছিলেন – ঈশ্বরের অবতার পুরুষেরা সকলেই অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ ৷
ভগবান বুদ্ধের পদ্মফুল ভালোবাসার কথা একটু আগে বলা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে গুরু মহারাজের বলা গল্পটি সংক্ষিপ্তভাবে এবার বলছি ৷ একদিন ভগবান বুদ্ধ কোন এক স্থানে রয়েছেন, ফলে সেই অঞ্চলের ভক্তরা বুদ্ধ দর্শনে যাবার সময় অনেকেই বাজার থেকে বুদ্ধের ভালোবাসার ফুল _পদ্মফুল নিয়ে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের চরণে দেবার বাসনা করল । কিন্তু কি আশ্চর্যের কথা ! সেদিন বাজারে একজন ফুলওয়ালার কাছে মাত্র একটিই সদ্য প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্ম ছিল – গোটা ফুল বাজারে আর কারও কাছে কোন পদ্মফুল ছিল না! ফলে সেই অঞ্চলের ধনী, শ্রেষ্ঠী, জমিদার ইত্যাদিরা সকলেই একটিমাত্র পদ্মপুষ্পের জন্য দর হাঁকতে শুরু করল! অন্যান্য দিনে যে পদ্মের প্রতিটির দাম হয়তো এক টাকা, দুই টাকা – সেইটা সেদিন দর উঠে গেল সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ! বেচারা গরীব, সহজ-সরল ফুলওয়ালা ওই পদ্মটির দাম এত বেশি হচ্ছে কেন – তা বুঝতে পারছিল না । সে যখন প্রকৃত কারণটি জানতে পারল, তখন সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল – ” যাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বা যাঁর কৃপালাভ করার জন্য তোমরা একটা ফুলের এত দাম দিতে চাইছো – তাহলে সেই ব্যক্তি কত দামী ! তাঁর কৃপালাভ করাটা কত দামী ! অতএব এই ফুল আমি তোমাদের কারুকেই বিক্রি করব না – এই ফুল আমি নিজেই সেই মহান মানুষটির পায়ে নিবেদন করে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করব !”– এই বলে সেই ফুলওয়ালা নিজেই বুদ্ধকে ওই ফুলটি নিবেদন করেছিল ।
ওই ঘটনায় ফুলওয়ালাটির প্রতি ভগবান বুদ্ধ নিশ্চয়ই প্রসন্ন হয়েছিলেন – কিন্তু ওটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ দান গ্রহণ নয় । “গল্প কথা প্রসঙ্গে”– ভগবান বুদ্ধের জীবনের এই গল্পটি আলোচনা হলেও এখানে আর একবার বলা যাক্ । এই গল্পটির অনুকরণে একটি গল্প আমরা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম – “দি গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” অর্থাৎ “জ্ঞানীগণের উপহার”। ভগবান যীশু যখন বেথেলহেমের আস্তাবলে নিতান্ত সাধারণের মতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন – সেই সময় আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তন দেখে, দিক নির্ণয় করে প্রাচ্য দেশের (ভারতবর্ষের) কয়েকজন জ্ঞানী সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে ওই আস্তাবলে গিয়ে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁরা কিছু মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি ও সুগন্ধি ইত্যাদি দিয়ে ওই শিশুকে আশীর্বাদ করেছিলেন । তাঁরাই মাতা মেরীকে প্রথম বলেছিলেন যে, এই শিশু বড় হয়ে মানবজাতির ত্রাণকর্তা হবে । ওই জ্ঞানীগণকেই বাইবেলে Magi (মেজাই) বলে উল্লেখ করা হয়েছে । আমাদের পাঠ্য পুস্তকের গল্পটির নাম এইটি হলেও গল্পটি ছিল গান্ধীর (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) জন্মদিনে চাওয়া Most valuable gift -কে নিয়ে । গান্ধী এমনিতে কারো কাছে কোনদিন তেমন কিছু চাইতো না, কিন্তু কোন এক জন্মদিনে ঐরকম চাওয়া দেখে তৎকালীন ধনীরা থলিভর্তি টাকা, সোনা ইত্যাদি নিয়ে ওনাকে দিতে এসেছিল কিন্তু উনি সে সব প্রত্যাখ্যান করে একজন ভিখারির সারাদিনের ভিক্ষালব্ধ সঞ্চয় গ্রহণ করে বলেছিলেন – ” এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার !”
যে ঘটনার অনুকরণে গান্ধী ঐ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, ভগবান বুদ্ধের জীবনের সেই ঘটনাটা এবার বলি ! বুদ্ধত্ব অর্জনের পর ভগবান বুদ্ধ আর কোন একটি জায়গায় স্থির থাকতেন না, সারা বছর ধরে সমগ্র উত্তর ভারত – পূর্ব ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বেড়াতেন! কোনস্থানে থাকলেও খুব বেশি দিনের জন্য কোথাও স্থিতু হোতেন না। তাছাড়া কখনই উনি কোন রাজার ‘গৃহে’ বা ধনীর ‘গৃহে’ বা ‘প্রাসাদে’ রাত্রি বাস করতেন না (যদিও তারা সকলেই হয়তো তাঁর শিষ্য ছিল) – উনি কোন না কোন গাছ তলায় অথবা ফাঁকাস্থানে সশিষ্য রাত কাটাতেন ৷ সেখানে বেশিরভাগ সময়েই তিনি প্রবচন করতেন, উপস্থিত ভক্তদের সমস্যার মীমাংসা করে দিতেন– শেষে হয়তো কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন!
একমাত্র বর্ষাকালটা ভগবান বুদ্ধ সশিষ্য কোন না কোন রাজা, জমিদার বা শ্রেষ্ঠীর বাগানে বা প্রাসাদের বাইরের কোন আবাসস্থলে কাটিয়ে দিতেন। বর্ষার এই দুই তিন মাস একই স্থানে থাকাকে বলা হোত ‘বর্ষাবাস’।এর ফলে অনেকের অনেকরকম সুবিধাও হোত। গুরুমহারাজ বর্ষাবাসের কয়েকটা কারণ বলেছিলেন, তার মধ্যে একটা কারণ বলছি __বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেহেতু ভিক্ষালব্ধ অন্নেই ক্ষুন্নিবৃত্তি কোরতো এবং তারা সারাদিনে একবেলা মাত্র আহার কোরতো কিন্তু বর্ষাকালে ভিক্ষা তেমন মিলতো না, ফলে সবার সবদিন আহারও জুটত না। বৌদ্ধমঠ বা মনেস্টারীর নিয়ম ছিল খুবই কড়া এবং কঠোর! সকাল থেকে নিত্যকর্মাদি সেরে নির্দিষ্ট সময়ে ভিক্ষায় বেরোতে হোত এবং মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসতে হোত। নাহলে আর ভিতরে ঢুকতে পারবে না! প্রতিদিন একই স্থানে সমস্ত সন্ন্যাসীর পেটভরা অন্ন পাওয়া যেতো না _তাই অনেক দূর দূর স্থানে তাদেরকে যেতে হোত। ভিক্ষা গ্রহনের ঘন্টা বাজার সাথে সাথে এক একটা মঠ থেকে শয়ে শয়ে সন্ন্যাসী যখন ছুটে বেরিয়ে যেতো(নির্দিষ্ট সময়ে ফিরতে হবে বলে) _তখন তারা দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটতো! এর ফলে শত শত একর বর্ষার চাষের ফসল নষ্ট হয়ে যেতো। চাষীরা রাজাদেরকে এই নিয়ে complain কোরতো _রাজারা আবার বুদ্ধকে এই কথাটা বলেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের বর্ষাবাসের এটাও একটা অন্যতম কারন!
এছাড়াও অন্য আর একটি কারণের কথাও উনি বলেছিলেন । ভগবান বুদ্ধ সারাবছর বিভিন্ন স্থানে পরিব্রাজন করেই বেড়াতেন। এর ফলে বৌদ্ধ ভক্তরা যে ওনার একটু সঙ্গ করবেন বা ওনার সেবা করবেন __সেই সুযোগ তারা পেতো না। কিন্তু বর্ষাবাসের সুযোগে দলে দলে সাধারণ মানুষেরা সেই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে তাদের মনোবাসনা মেটাতে পারতো।। (ক্রমশঃ)
গুরুমহারাজ বলেছিলেন –দুই ধরনের বুদ্ধের রূপ এবং কার্যকারিতা পৃথক! তথাগত বুদ্ধ শান্ত – সমাহিত, আর অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ জীবজগতের কল্যাণের জন্য সদা নিয়োজিত, সদা তৎপর। প্রথম দলের ‘বুদ্ধ’-গণ যেন সূর্যের মতো – দূর থেকে পৃথিবী গ্রহের জীবজগৎ-জড়জগৎ সকলের মঙ্গল সাধন করে যাচ্ছেন এবং দ্বিতীয় দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন প্রেম ও করুণায় পরিপূর্ণ। তাই সূর্যের সমস্ত তাপ-ঔজ্জ্বল্য ঢেকে-ঢুকে জীবের কাছে কাছে এসে, তাদেরকে স্পর্শ করে, তাদের স্পর্শ নিয়ে তাদের কল্যাণ করা – তাদেরকে আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নত করার গুরুদায়িত্ব এঁনাদের !
গুরুমহারাজ খুব সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন । উনি বলেছিলেন – ” যেমন ধর, একদল লোক একটা গর্তের মধ্যে থাকা পাঁক-কাদাজলের মধ্যে পড়ে গিয়ে, পরস্পর পরস্পরে কাদা মাখামাখি করছে । অনেকে হয়তো গর্ত থেকে উঠতে চাইছে – কিন্তু হায় ! বারবার পিছলে পিছলে পড়ে যাচ্ছে অথবা অন্যরা তাকে টেনে নামিয়ে নিচ্ছে! এইবার সেই স্থানে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি (প্রথম দলের মহাপুরুষ) এসে গর্তে পড়ে যাওয়া মানুষগুলির দুরবস্থা দেখে ব্যথিত হলেন এবং তারা কিভাবে, কোন কায়দায় ওই গর্ত থেকে বেরোতে পারে এবং তাদের গায়ের নোংরা কাদা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে পারে তার নিখুঁত উপায়গুলি বলে দিতে শুরু করলেন ৷ তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে এবং জ্ঞানলাভ করে অনেকেই সেই গর্ত থেকে উঠে আসতে লাগল । উঠে এসে তারা নিজেদের গায়ে লেগে থাকা সমস্ত নোংরা আবর্জনা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেলতে পারল।
কিন্তু ঐ স্থানে যদি অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ (দ্বিতীয় দলের মহাপুরুষ) আসেন, তাহলে তিনি কর্দমাক্ত এবং নিজেদের মধ্যে কাদা মাখামাখি খেলায় মত্ত ওই মানুষগুলিকে দেখে প্রেমে-করুণায় আর স্থির থাকতে পারেন না – নিজেই লাফিয়ে ওই কাদার মধ্যে নেমে পড়েন এবং বাছাবাছি না করে কাদা-মাখামাখি করা সমস্ত ব্যক্তিকে খপাখপ ধরে, চাগিয়ে ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে উপরে তুলে দেন। এইজন্য তাঁকেও কিছুটা কাদা মাখতে হয়, কিন্তু তাতে কি ? মা যখন কাদামাখা শিশুকে ধরে পরিষ্কার করেন – তখন তাঁর কি হাতে গায়ে একটু কাদা লাগে না ? এক্ষেত্রেও তেমন-ই হয় । প্রেমের এমন মহিমা, তখন কারো কোন দোষ-ই দোষ বলে মনে হয় না, তখন কোথাও কোন Negative-ই দেখা যায় না, তখন শুধুই Positive আর Positive !” ভগবান পরমানন্দ বলেছিলেন – ঈশ্বরের অবতার পুরুষেরা সকলেই অবলোকহিতেশ্বর বুদ্ধ ৷
ভগবান বুদ্ধের পদ্মফুল ভালোবাসার কথা একটু আগে বলা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে গুরু মহারাজের বলা গল্পটি সংক্ষিপ্তভাবে এবার বলছি ৷ একদিন ভগবান বুদ্ধ কোন এক স্থানে রয়েছেন, ফলে সেই অঞ্চলের ভক্তরা বুদ্ধ দর্শনে যাবার সময় অনেকেই বাজার থেকে বুদ্ধের ভালোবাসার ফুল _পদ্মফুল নিয়ে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের চরণে দেবার বাসনা করল । কিন্তু কি আশ্চর্যের কথা ! সেদিন বাজারে একজন ফুলওয়ালার কাছে মাত্র একটিই সদ্য প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্ম ছিল – গোটা ফুল বাজারে আর কারও কাছে কোন পদ্মফুল ছিল না! ফলে সেই অঞ্চলের ধনী, শ্রেষ্ঠী, জমিদার ইত্যাদিরা সকলেই একটিমাত্র পদ্মপুষ্পের জন্য দর হাঁকতে শুরু করল! অন্যান্য দিনে যে পদ্মের প্রতিটির দাম হয়তো এক টাকা, দুই টাকা – সেইটা সেদিন দর উঠে গেল সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ! বেচারা গরীব, সহজ-সরল ফুলওয়ালা ওই পদ্মটির দাম এত বেশি হচ্ছে কেন – তা বুঝতে পারছিল না । সে যখন প্রকৃত কারণটি জানতে পারল, তখন সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল – ” যাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বা যাঁর কৃপালাভ করার জন্য তোমরা একটা ফুলের এত দাম দিতে চাইছো – তাহলে সেই ব্যক্তি কত দামী ! তাঁর কৃপালাভ করাটা কত দামী ! অতএব এই ফুল আমি তোমাদের কারুকেই বিক্রি করব না – এই ফুল আমি নিজেই সেই মহান মানুষটির পায়ে নিবেদন করে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করব !”– এই বলে সেই ফুলওয়ালা নিজেই বুদ্ধকে ওই ফুলটি নিবেদন করেছিল ।
ওই ঘটনায় ফুলওয়ালাটির প্রতি ভগবান বুদ্ধ নিশ্চয়ই প্রসন্ন হয়েছিলেন – কিন্তু ওটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ দান গ্রহণ নয় । “গল্প কথা প্রসঙ্গে”– ভগবান বুদ্ধের জীবনের এই গল্পটি আলোচনা হলেও এখানে আর একবার বলা যাক্ । এই গল্পটির অনুকরণে একটি গল্প আমরা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম – “দি গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” অর্থাৎ “জ্ঞানীগণের উপহার”। ভগবান যীশু যখন বেথেলহেমের আস্তাবলে নিতান্ত সাধারণের মতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন – সেই সময় আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তন দেখে, দিক নির্ণয় করে প্রাচ্য দেশের (ভারতবর্ষের) কয়েকজন জ্ঞানী সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে ওই আস্তাবলে গিয়ে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁরা কিছু মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি ও সুগন্ধি ইত্যাদি দিয়ে ওই শিশুকে আশীর্বাদ করেছিলেন । তাঁরাই মাতা মেরীকে প্রথম বলেছিলেন যে, এই শিশু বড় হয়ে মানবজাতির ত্রাণকর্তা হবে । ওই জ্ঞানীগণকেই বাইবেলে Magi (মেজাই) বলে উল্লেখ করা হয়েছে । আমাদের পাঠ্য পুস্তকের গল্পটির নাম এইটি হলেও গল্পটি ছিল গান্ধীর (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) জন্মদিনে চাওয়া Most valuable gift -কে নিয়ে । গান্ধী এমনিতে কারো কাছে কোনদিন তেমন কিছু চাইতো না, কিন্তু কোন এক জন্মদিনে ঐরকম চাওয়া দেখে তৎকালীন ধনীরা থলিভর্তি টাকা, সোনা ইত্যাদি নিয়ে ওনাকে দিতে এসেছিল কিন্তু উনি সে সব প্রত্যাখ্যান করে একজন ভিখারির সারাদিনের ভিক্ষালব্ধ সঞ্চয় গ্রহণ করে বলেছিলেন – ” এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার !”
যে ঘটনার অনুকরণে গান্ধী ঐ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, ভগবান বুদ্ধের জীবনের সেই ঘটনাটা এবার বলি ! বুদ্ধত্ব অর্জনের পর ভগবান বুদ্ধ আর কোন একটি জায়গায় স্থির থাকতেন না, সারা বছর ধরে সমগ্র উত্তর ভারত – পূর্ব ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বেড়াতেন! কোনস্থানে থাকলেও খুব বেশি দিনের জন্য কোথাও স্থিতু হোতেন না। তাছাড়া কখনই উনি কোন রাজার ‘গৃহে’ বা ধনীর ‘গৃহে’ বা ‘প্রাসাদে’ রাত্রি বাস করতেন না (যদিও তারা সকলেই হয়তো তাঁর শিষ্য ছিল) – উনি কোন না কোন গাছ তলায় অথবা ফাঁকাস্থানে সশিষ্য রাত কাটাতেন ৷ সেখানে বেশিরভাগ সময়েই তিনি প্রবচন করতেন, উপস্থিত ভক্তদের সমস্যার মীমাংসা করে দিতেন– শেষে হয়তো কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন!
একমাত্র বর্ষাকালটা ভগবান বুদ্ধ সশিষ্য কোন না কোন রাজা, জমিদার বা শ্রেষ্ঠীর বাগানে বা প্রাসাদের বাইরের কোন আবাসস্থলে কাটিয়ে দিতেন। বর্ষার এই দুই তিন মাস একই স্থানে থাকাকে বলা হোত ‘বর্ষাবাস’।এর ফলে অনেকের অনেকরকম সুবিধাও হোত। গুরুমহারাজ বর্ষাবাসের কয়েকটা কারণ বলেছিলেন, তার মধ্যে একটা কারণ বলছি __বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেহেতু ভিক্ষালব্ধ অন্নেই ক্ষুন্নিবৃত্তি কোরতো এবং তারা সারাদিনে একবেলা মাত্র আহার কোরতো কিন্তু বর্ষাকালে ভিক্ষা তেমন মিলতো না, ফলে সবার সবদিন আহারও জুটত না। বৌদ্ধমঠ বা মনেস্টারীর নিয়ম ছিল খুবই কড়া এবং কঠোর! সকাল থেকে নিত্যকর্মাদি সেরে নির্দিষ্ট সময়ে ভিক্ষায় বেরোতে হোত এবং মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসতে হোত। নাহলে আর ভিতরে ঢুকতে পারবে না! প্রতিদিন একই স্থানে সমস্ত সন্ন্যাসীর পেটভরা অন্ন পাওয়া যেতো না _তাই অনেক দূর দূর স্থানে তাদেরকে যেতে হোত। ভিক্ষা গ্রহনের ঘন্টা বাজার সাথে সাথে এক একটা মঠ থেকে শয়ে শয়ে সন্ন্যাসী যখন ছুটে বেরিয়ে যেতো(নির্দিষ্ট সময়ে ফিরতে হবে বলে) _তখন তারা দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটতো! এর ফলে শত শত একর বর্ষার চাষের ফসল নষ্ট হয়ে যেতো। চাষীরা রাজাদেরকে এই নিয়ে complain কোরতো _রাজারা আবার বুদ্ধকে এই কথাটা বলেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের বর্ষাবাসের এটাও একটা অন্যতম কারন!
এছাড়াও অন্য আর একটি কারণের কথাও উনি বলেছিলেন । ভগবান বুদ্ধ সারাবছর বিভিন্ন স্থানে পরিব্রাজন করেই বেড়াতেন। এর ফলে বৌদ্ধ ভক্তরা যে ওনার একটু সঙ্গ করবেন বা ওনার সেবা করবেন __সেই সুযোগ তারা পেতো না। কিন্তু বর্ষাবাসের সুযোগে দলে দলে সাধারণ মানুষেরা সেই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে তাদের মনোবাসনা মেটাতে পারতো।। (ক্রমশঃ)