গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বিভিন্ন সিটিংয়ে ভগবান বুদ্ধ সম্বন্ধে নানান কথা বলতেন – সেগুলির কিছু কিছু এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল । আগের দিন আমরা উল্লেখ করেছিলাম বুদ্ধের জীবনে শ্রেষ্ঠ দান গ্রহণের কথা ! আজকে তার বিস্তার করা যাক্ ৷ এই ঘটনাটি অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’-এ বা অন্যান্য বুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থে কিভাবে বর্ণিত হয়েছে তা আমার জানা নাই – আমি ভগবান পরমানন্দ যেমনটি বলেছিলেন – তেমনটি বলার চেষ্টা করছি !
ভগবান বুদ্ধ অর্হত্ত্ব লাভের পরে পরেই যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার বা বিস্তার করেছিলেন – তা কিন্তু নয় । ভগবান বুদ্ধের প্রথম দীক্ষিত শিষ্যা ছিলেন সুজাতা (সুজাতার কাহিনী পরে বলা হবে) ! এ সেই সুজাতা যে ভগবান বুদ্ধকে (সমাধির ভূমি থেকে নামার পর) পায়েস খাইয়ে প্রাণরক্ষা করেছিল ৷ এরপর আনন্দ, সারিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন প্রমুখ অন্তরঙ্গ ত্যাগী ভক্তরা একে একে ওনার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে – ওনার সাথেই থাকতে শুরু করেন । এরপর দলে দলে সাধারণ মানুষেরা বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে – অনেক পরে রাজন্যবর্গ ওনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল ।
যাইহোক, বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই প্রথম “মহাসঙ্গীতি” বা বৌদ্ধ ভক্তদের ধর্মবিস্তারের উদ্দেশ্যে এক জায়গায় ‘জমায়েত’- সংঘটিত হয়েছিল । আর এর জন্য উনি স্থান নির্বাচন করেছিলেন ‘সারনাথ’ । বেনারসের পাশেই সারনাথ অবস্থিত –সেটাই হয়েছিল প্রথম ‘মহাসঙ্গীতির’ স্থান । অনেক পরে সম্রাট অশোক ভগবান বুদ্ধের অনুসরণে ঐ একই স্থানে ‘মহাসঙ্গীতি’ করেছিলেন । এই স্মৃতি রক্ষার্থেই ওখানে অশোক চক্র, অশোকস্তম্ভ খোদিত হয়েছিল ৷ ওখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল ভারতবর্ষের বাইরের দেশগুলিতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করার । প্রকৃতপক্ষে সম্রাট অশোকের সময়েই বৌদ্ধধর্মের বার্তা নিয়ে কয়েকশো বৌদ্ধ শ্রমণ (ভিক্ষু) বা সন্ন্যাসী ভারতের প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল ৷ এদের মধ্যে সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) অন্যান্য শ্রমণদের সাথে গিয়েছিল সম্রাট অশোকের কন্যা ভিক্ষুণী সংঘমিত্রাও ৷
ভগবান বুদ্ধ সারনাথে সকল ভক্তদের সাথে মিলিত হবার পর ঘোষণা করেছিলেন – ‘ধর্মভেরী’ বাজিয়ে (আজও সমস্ত বৌদ্ধ মঠ বা মনেষ্টারীতে ধর্মভেরী দেখা যায়, আর ঘূর্ণায়মান যে গোল গোল জিনিসগুলি থাকে ওইগুলি ‘কালচক্রে’-র রূপক ৷) অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হবে ; কিন্তু এই ধর্মভেরী বাজানোর আগে তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান গ্রহণ করবেন । “বার্তা রটে গেল গ্রামে গ্রামে”– লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে গেল যে ভগবান বুদ্ধ জীবনে এই প্রথম ভক্তদের কাছ থেকে দান গ্রহণ করবেন ৷ তাও সেই দান তিনি সবার কাছ থেকে গ্রহণ করবেন না –তিনি গ্রহণ করবেন একটি মাত্র দান, যা তাঁর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে – উনি শুধুমাত্র সেই দানটি-ই গ্রহণ করবেন ৷
এই কথা শোনা মাত্রেই বুদ্ধ ভক্তদের মধ্যে দান দেবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল । রাজা-জমিদার-শ্রেষ্ঠী সহ সাধারণ ভক্তরাও ভগবানকে দেওয়ার জন্য টাকাকড়ি, সোনাদানা, ফলমূল, পদ্ম ফুলের ঝুড়ি, সুগন্ধি দ্রব্যাদি ইত্যাদি আরো কত কি নিয়ে বুদ্ধের সামনে এসে জড়ো হতে শুরু করল ৷
ধীরে ধীরে ভক্তসংখ্যা এত বাড়তে লাগল যে আনন্দ-সারিপুত্তরা শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সকলকে একটা সারিতে দাঁড় করিয়ে দিল । এরফলে সেই লাইন লম্বা থেকে আরও লম্বা হতে থাকলো, কিন্তু ভগবানের কাছে কারও কোন ‘দান’-ই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হলো না ৷ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পর তারা যখন ভগবানের কাছে গিয়ে তার দানের সামগ্রীটি বুদ্ধকে দেবার জন্য উদ্যত হচ্ছিল – অমনি ভগবান মাথা নেড়ে তাঁর অসম্মতি ব্যক্ত করছিলেন । এইভাবে সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার ভক্তের ‘দানের সামগ্রী’ প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেল ।
সারনাথ অঞ্চলে একজন অতি-বৃদ্ধা ভিখারিণী ছিল – সে পথের প্রান্তে একটা ছোট্ট ঝুপড়িতে থাকত এবং ভিক্ষান্নের দ্বারা কোনরকমে দিনাতিপাত করতো ৷ দুপুর অবধি অতি কষ্টে নগরের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে ক্লান্ত শরীরে তার পর্ণকুটিরে পৌঁছে মধ্যাহ্নের খাবারের জোগাড় করতে যাবে এমন সময় সে তার ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথিকদের মুখে আলোচনা শুনতে পেলো যে, আজ ভগবান বুদ্ধ সারনাথের একটি বিশেষ স্থানে ‘ধর্মভেরী’ বাজাবেন কিন্তু তার আগে তিনি কিছু দান গ্রহণ করবেন – যে দানটি হবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান ৷ কিন্তু বহু শ্রেষ্ঠী, রাজা, জমিদার সকলের মূল্যবান দানও বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ দান হিসাবে বিবেচনা করছেন না – তা প্রত্যাখ্যান করছেন ! ভগবানকে কিছু দেবার বাসনা আর কার না থাকে ! ওই বৃদ্ধা ভিখারিণীও তার জীবনের শেষ সুযোগটি ছাড়তে চাইলো না । সে এক দৌড়ে গিয়ে পাশের ডোবায় স্নান সেরে নিল এবং তার সম্বল একটাই ছিন্ন শাড়ি ভালো করে কেচে নিয়ে সেই ভিজে কাপড়টাই জড়িয়ে পড়ে নিল । এরপর সে ভাবতে বসল ভগবানকে সে কি-ই বা দান দিতে পারে ? ভিক্ষালব্ধ পাঁচবাড়ির শক্ত শস্যদানা তো দেওয়া যায় না ! হটাৎ তার মনে হোল ভগবান সারাদিন একই আসনে বসে সকলের দান দেবার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তাঁর কতই না কষ্ট হচ্ছে – এইটা ভাবতেই ওই বৃদ্ধার মধ্যে মায়ের মমতা জেগে উঠল! সে ভাবলো, তাকে এমন কিছু নিয়ে যেতে হবে যা ভগবান তখনই খেতে পারেন এবং তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণার নিবৃত্তি হয় !
ঐ বৃদ্ধা মহিলা পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে দেখে যে, তারই উঠোনের এক প্রান্তে একটি পেঁপে গাছে সুন্দর একটা পেঁপে একেবারে ভরপুর পেকে রয়েছে! তাড়াতাড়ি ঐ পেঁপেটি গাছ থেকে পেড়ে বৃদ্ধাটি দেখল _ফলটিতে পাখীতে ঠোকরানোর দাগ রয়েছে। কিন্তু খুঁতযুক্ত ফল তো দেবতাকে দেওয়া যায় না! কি করা যায় _সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হটাৎ তার মনে হোল, ফলটিকে ধুয়ে পরিস্কার করে _তার সন্তানকে কি সে খাওয়াতো না!!
যেই ভাবা __অমনি সে ভালো করে ধোওয়া পেঁপেটিকে কাপড়ের আঁচলে ঢাকা দিয়ে দৌড় লাগালো সেই দিকপানে যেখানে ভগবান বুদ্ধ রয়েছেন। সারাদিনের অনশন ও ভিক্ষান্বষেনের ক্লান্তি, বার্ধক্যের ব্যাধি ইত্যাদিকে উপেক্ষা করেও ঐ বৃদ্ধা মহিলা শুধুমাত্র তার সন্তান(ভগবান বুদ্ধ) _এখনও কিছু খায় নি, এইটা ভেবেই ছুটছিল!
অতিকষ্টে বুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছেও তাকে ওনার সেবকেরা আটকে দিল। একে তো সারাদিন ভগবান বুদ্ধ ক্লান্তিহীন ভাবে এক আসনে বসে হাজার হাজার ভক্তদের দান গ্রহন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা বর্জন করেছেন! দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে সেবকেরা আর কাউকে তাঁর কাছে যেতে allow করছিল না, কিন্তু ভগবান বুদ্ধ নিজেই ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে ভিতরে ঢোকার জন্য ডেকে পাঠালেন। ভিতরে ঢুকে ভগবানের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে, কাপড়ের আঁচল থেকে ঐ পাখি ঠোকরানো (কিন্তু ভালো করে ধোওয়া এবং পরিস্কার করা) ফলটি বের করে বুদ্ধের হাতে দিয়ে ঐ বৃদ্ধা বলল _”বাবা! সারাদিন কিছু খাও নি, আমার বাড়ির গাছের ফল, খুব মিষ্টি __একটু খাও বাবা! ”
অত্যধিক আগ্রহে ভগবান বুদ্ধ ঐ বৃদ্ধা মা-টির কাছ থেকে সেই ফলটি নিয়ে তার কিছু অংশ গ্রহণ করলেন এবং তা করেই তিনি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, দুহাত প্রসারিত করে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন _”বাজাও ধর্মভেরি!! এইমাত্র আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান গ্রহণ করেছি! এবার শুরু হবে ধর্মবিজয়! ”
ভগবানের আদেশ এবং নির্দেশ পেয়ে বাদকের দল জোরে জোরে ভেরি(জয়ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র) বাজাতে লাগল, তুমুল শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে গেল, ভগবানের ব্রত ভাঙার আনন্দে ভক্তরা আনন্দে নাচানাচি করতে শুরু করল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটি সম্পন্ন করে ঐ বৃদ্ধার প্রানহীন শরীর লুটিয়ে পরল ভগবান বুদ্ধের শ্রীচরনে।।(ক্রমশঃ)