গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা বুদ্ধ-বিষয়ক কথা এখানে বলা হচ্ছিল । আমরা বলছিলাম – ভগবান বুদ্ধের অর্হত্ত্ব লাভের দিনটির কথা ! গুরু মহারাজ ওই দিনটিতে গৌতমের ‘বুদ্ধ’ – হয়ে ওঠার ক্ষণ-টিকে এবং তার পরবর্তী সময়কার কথা সবিস্তারে বলেছিলেন । আমি আগেই আপনাদের কাছে স্বীকার করে নিয়েছি যে, সেই মহাপুরুষের অলৌকিক style, ভঙ্গিমা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার সবটা আমি করতে পারবো না – যতটুকু পারি, চেষ্টা করবো । তবে আমার মতই আপনারাও এইটা ভেবে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত এবং আনন্দিত হবেন এই ভেবে যে, ভগবান বুদ্ধের সেই বিশেষ মুহূর্তের কথা ভগবান পরমানন্দ নিজের মুখে বলেছিলেন। অবশ্য তিনি ছাড়া আর বলবেনই বা কে !
গুরুমহারাজের এই ধরনের গভীরতাপূর্ণ সিটিংগুলি শোনার সময় – ওখানে উপস্থিত ভক্তদের মধ্যেও ওনার সেই সময়কার Vibration স্পর্শ কোরতো! ওনার ছোটবেলাকার বুদ্ধগয়া এবং গয়া ভ্রমণকালীন ঘটনার কথা (যেটা আগামী কোন এপিসোডে নিশ্চয়ই বলা হবে) উনি যেদিন সিটিং-য়ে বলেছিলেন, সত্যি কথা বলছি – সেদিন ওনার কথার Vibration আমার শরীরকে এমনভাবে বিব্রত করে তুলেছিল যে, আমি বেশিক্ষণ ওনার সামনে বসে থাকতে পারিনি, সিটিং ছেড়ে উঠে আড়ালে গিয়ে নিজেকে সামলাতে হয়েছিল !
ওসব কথা থাক্ ! আমরা যে কথায় ছিলাম, সেই কথায় ফিরে আসি । ভগবান বুদ্ধের ‘বুদ্ধত্ব লাভে’-র দিনটার কথা বলতে গিয়ে আমরা বলেছিলাম নির্বিকল্প সমাধি ভূমি থেকে নেমে আসার পর – যখন বুদ্ধের শরীরে হুঁশ ফিরে এলো, তখন তাঁর ক্ষুধা ও তৃষ্ণা’র বোধ জেগেছিল । সামনেই নৈরঞ্জনা নদীর স্বচ্ছ সলিলের শব্দে তৃষ্ণা মেটাবার আকুল বাসনা নিয়ে আগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই – তাঁর শরীরটা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল ৷ গুরু মহারাজ সেই সময়কালীন গৌতম বুদ্ধের মনের অবস্থা ঠিক কেমনটি ছিল তা বলেছিলেন।
উনি বলেছিলেন – “গৌতম যখন শারীরিক দুর্বলতার কারণে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলেন, মাত্র কয়েক হাত দূরে নৈরঞ্জনা নদীর জল, কিন্তু এক বুক তৃষ্ণা নিয়েও তার এক আঁজলা জলও মুখে তোলার ক্ষমতা নেই তাঁর ! সদ্য জ্ঞানের চরমভূমিতে পৌঁছানো বুদ্ধ কিন্তু শরীর রক্ষার তাগিদে ফিরে এলেন চরম রূঢ় বাস্তবে ! ওনার পরাজ্ঞান লাভের সাথে সাথে এই বাস্তব জ্ঞানটি হোল যে, _শরীর থাকলে তবেই অর্হত্বের কথা, জ্ঞানের কথা মানুষের কাছে তিনি বলতে পারবেন_তাদেরকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবেন। বুদ্ধের মনে পড়ে গেল কপিলাবস্তুর কথা ! সেখানকার রাজমহলে তার সেবায় নিয়োজিত কত দাস-দাসী ! কত রকমের রাশি রাশি খাবার সেখানে রাজকুমার সিদ্ধার্থের সামনে এবং আশে-পাশে থরে থরে সাজানো থাকতো! আর সেই রাজকুমারের আজ এক মুঠো খাবার, এক আঁজলা জলের অভাবে প্রাণসংকট হোতে বসেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই – বুদ্ধের আহার এবং পানীয়ের অভাবে দুচোখে আঁধার নেমে আসতে লাগল । বুদ্ধ স্থির হয়ে নিশ্চিত চিরান্ধকারের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলেন __আর ঠিক সেই সময়েই বুদ্ধের নাকে ভেসে এলো সদ্য প্রস্তুত সুগন্ধি চাল- ঘরের গাভীর দুধ ও ক্ষেতের আখের গুড় দিয়ে প্রস্তুত গরম পরমান্নের সুগন্ধ ! সেই সুগন্ধেই বুদ্ধের শরীরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্নায়ুরাজি যেন চনমন্‌ করে উঠলো, তাতেই যেন বেশ খানিকটা গায়ে জোর পেয়ে গেলেন তিনি । ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে বসে – ভগবান বুদ্ধ সুজাতাকে বললেন – “মা, এইমাত্র আমি অর্হত্ত্ব লাভ করেছি, কিন্তু আমি এটাও বুঝেছি যে, শরীর রক্ষা করাটাও খুবই জরুরী ! তাই দাও মা – তুমি আমার জন্য যে আহার্য ও পানীয় এনেছো – তা আমাকে দাও ! ঐগুলি গ্রহণ করে আগে আমি আমার শরীর রক্ষা করি! তারপর তোমাকে আমি এইমাত্র যা লাভ করেছি (পরাজ্ঞান) – তা তোমাকে প্রদান করব ৷”
এই কথা ক’টি বলেই ভগবান বুদ্ধ শরীর রক্ষার জন্য সুজাতা এবং অন্যান্য রাখাল বালকের আনা গরম গরম পরমান্ন ও পানীয় গ্রহণ করলেন । তারপরে শরীরে একটু জোর পাবার পর ভগবান বুদ্ধ সুজাতাকে সদ্য প্রাপ্ত জ্ঞানের কথা বলতে শুরু করলেন ৷ বুদ্ধের চারটি প্রধান শিক্ষা বা আর্যসত্য হলো – (১) এই জগত দুঃখময় অর্থাৎ দুঃখ আছে, (২) দুঃখ থেকে মুক্তি আছে ! (৩) দুঃখ থেকে মুক্তির উপায়ও রয়েছে, (৪) মহানির্বাণ বা অর্হত্ত্ব লাভ-ই হলো সেই মুক্তির একমাত্র উপায় । এই সমস্ত শিক্ষা ভগবান বুদ্ধ সুজাতাকেই প্রথম দান করেছিলেন ! সেই অর্থে সুজাতাই ছিল ভগবান বুদ্ধের প্রথম শিষ্যা !
বুদ্ধগয়ার নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে ঐ মহাপুরুষ টির জ্ঞানের সেদিন যে প্রকাশ ঘটেছিল –তার শুভসূচনা হয়েছিল অত্যন্ত সাধারণভাবে, মাত্র কয়েকটি গ্রাম্য বালক-বালিকার সম্মুখে। এরপর ওই শিশুর দলের কাছ থেকে খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা ওই মহাপুরুষকে সসন্মানে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সেবা শুশ্রূষা করে তাঁকে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছিলেন ৷
এইভাবে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ওই মহাপুরুষ তাঁর জয়যাত্রা অতি সাধারণভাবে শুরু করলেও তার গভীরতা এত বেশি ছিল যে, স্থান-কালের সীমা ছাড়িয়ে ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা ও বাণী সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল । আজ গোটা পৃথিবীর মনীষীরা বুদ্ধের শিক্ষাকেই নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে নিজের জীবনে যোজনা করে-ই মহান হয়েছেন, আজও পৃথিবীর মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণীয়। বুদ্ধ পরবর্তী মহাপুরুষ ন্যাজারেথের যীশুর প্রচারিত শিক্ষার মধ্যেও বুদ্ধের বাণীর অনুরণন পাওয়া যায় । স্বামী বিবেকানন্দ তো ঠারে-ঠোরে বলেই গেছেন যে, খ্রিস্টধর্ম বলে কোন আলাদা কোন ধর্মমত নাই, ওটি বৌদ্ধ ধর্মের-ই অঙ্গ ! জাহাজযোগে ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েকজন প্রাচীন জ্ঞানী মানুষ আবির্ভূত হয়ে স্বামীজীকে দর্শন দিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা বহুকাল আগে এইসব দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের কাজে এসেছিলেন৷”
গুরুমহারাজ ভগবান বুদ্ধের কথা আরও বলেছিলেন – সেগুলি বলছি ৷ ইতিহাসে একটা প্রসিদ্ধ গল্পকথা চালু আছে যে, একটি ছাগশিশুকে ‘বলি’ দেওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য, তার বিনিময়ে ভগবান বুদ্ধ নিজের জীবন দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এই ব্যাপারটি যে বুদ্ধের জীবনে ঐ একবারই ঘটেছিল তা নয়। যে সময়টায় ভগবান বুদ্ধ উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় ভারতবর্ষে শক্তি-সাধনার ব্যাপক প্রচলন ছিল । শক্তি সাধকদের একটা প্রচলিত বিশ্বাস ছিল (বিভিন্ন অভিচার ক্রিয়ায় এসবের বিধান রয়েছে) যে, শক্তির দেবী (বা দেবতার)-র সামনে পশু বা নরবলি দিলে দেবী (বা দেবতা) প্রসন্ন হবেন এবং তিনি ওই সাধককে শক্তি দান করবেন ৷ আর সেই অলৌকিক বা অতিলৌকিক শক্তিলাভ করে ঐ সাধক মহাশক্তিধর হয়ে সবার উপর কর্তৃত্ব করতে পারবে, চাই কি – দেশের রাজাকেও নিজের বশীভূত করতে পারবে ৷ কোন কোন সাধক অবশ্য শক্তিলাভ করার চেষ্টা করতো মানব কল্যানের উদ্দেশ্যে ! কিন্তু একবার শক্তিলাভ হয়ে গেলে সেই উদ্দেশ্যও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হতো !
যাইহোক, এগুলি ছিল ধর্মজগতের গ্লানি। আর ধর্মজগতে যখনই গ্লানি আসে তখনই সেই স্থানে শরীর ধারন করেন কোন না কোন মহাপুরুষ! ভগবান বুদ্ধ সেইসময় শরীর গ্রহন করে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিজে গিয়ে এই অকারণ পশু হত্যা বন্ধ করেছিলেন।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _এখন যেখানে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন, সেখানকার বটগাছটির তলায় বসে উনি রাত্রি কাটিয়েছিলেন এবং ওখানে থাকাকালীন সময়ে উনি ন’কাকা দের বাড়ির (মুখার্জি বাড়ির) কালীক্ষেত্রের কালীর(বর্তমানের করুনাময়ী কালীমূর্তি নয়) কালীপূজার বলি ও বন্ধ করেছিলেন।। (ক্রমশঃ)