গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বুদ্ধ বিষয়ক বলা কথাগুলি শেষ হতে না হতেই ভগবান শ্রী চৈতন্যের একটি লীলা-কাহিনীর কথা আমাদের আলোচনায় এসে গেছে – এইটা শেষ করেই আবার আমরা ভগবান বুদ্ধের কথা-তেই ফিরে যাবো ! মহাপ্রভুর ঘটনাবলীতে আমরা পরে আসবো।
আমরা আগের দিন আলোচনা করেছিলাম যে শ্রীবাসের বাড়িতে মহাপ্রভু পুরুষোত্তম-ভাবে শচীমাতার মস্তকে পদস্থাপন করেছিলেন এবং তাঁকে বৈষ্ণব অপরাধ থেকে মুক্ত করেছিলেন । এই ঘটনাটি গুরু মহারাজের মুখ থেকে শুনে (বৈষ্ণব গ্রন্থাবলীতেও নিশ্চয়ই ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে ৷) আমাদের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল ৷ ভগবান বুদ্ধের সামনে পিতা শুদ্ধোদনের নতজানু হয়ে বসা-টা তবুও মানতে পেরেছিলাম, কিন্তু শচীমাতার ঘটনাটা আমাদের মনকে খুবই ভারী করে তুলেছিল । আমরা গুরু মহারাজকে ওই ঘটনার উল্লেখ করে এর সঠিক ব্যাখ্যাটি জানতে চেয়েছিলাম । উনি বলেছিলেন – ” যেহেতু অদ্বৈত আচার্যের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাঁর বড়ছেলে বিশ্বরূপ গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বিশ্বম্ভর বা নিমাইও অদ্বৈত আচার্যকেই শিক্ষাগুরু হিসাবে গ্রহণ করার পর থেকেই সংসারে উদাসীন হয়েছিলেন – সেইজন্য শচীমাতা অদ্বৈত আচার্যকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না ! তিনি কোন কারনে ওনাদের বাড়িতে এলে বা রাস্তাঘাটে দেখা হলে শচীমাতা অদ্বৈত আচার্যকে উল্টোপাল্টা বাক্য বলে অপমান করতেন!
আর এই ভয়েই অদ্বৈত আচার্য নিমাই-এর বাড়িতে কখনো আসতেই চাইতেন না ৷ অদ্বৈতের সাথে সব সময় এক ঝাঁক বৈষ্ণব থাকতো – তাই নতুন কোন বৈষ্ণবকে দেখলেও শচীমাতা তাকে ভর্ৎসনা করতেন ৷ এই ব্যাপারগুলি সবই তার পুত্র নিমাই জানতো – কিন্তু যতক্ষণ ভগবান পুত্র-ভাবে আছেন, ততক্ষণ তিনি মাতাকে কিছু বলতে পারেন না! অথচ এদিকে তাঁর গর্ভধারিনী জননী দিনদিন বৈষ্ণব অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন – যার প্রারব্ধ ফল শচীমাতাকেই ভোগ করতে হবে, এইসব বিবেচনা করেই মহাপ্রভু ভগবৎ-ভাবে বা পুরুষোত্তম-ভাবে শচীমাতার মস্তকে পা দিয়ে তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ৷
পুরুষোত্তম-ভাব অবস্থায় তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, আর জগতের যা কিছু সে সবই তাঁর থেকে সৃষ্ট – তাই এই অবস্থায় স্থূল-সম্পর্কের কোনো স্থানই নেই ! সুতরাং সাধারণ চোখে দেখলে ব্যাপারটি খারাপ লাগলেও চিন্তার গভীরে গেলে বোঝা যায় – মহাপ্রভুর জীবনে এটিও ছিল ভগবানের লীলার অন্যতম একটি অঙ্গ !
যাইহোক, আমরা আবার বুদ্ধ বিষয়ক কথায় ফিরে আসি । আমরা আগের আলোচনায় ছিলাম কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথায় ! রাজা শুদ্ধোদনের সাথে ভগবান বুদ্ধের স্থূল সাক্ষাৎকার এবং কথাবার্তার কথাও আগে একটু-আধটু আলোচনা হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা তো হয় অন্যরকম । ঘটনাটা হয় কি জানেন – ‘ উপযুক্ত সময়’ হয়ে গেছে – তাই সেদিন ভগবানের রাজপ্রাসাদে আগমন! না হলে এতদিন আসেন নি কেন ? ওই দিনই বা আসলেন কেন ? বাবা শুদ্ধোদন, মা গৌতমী যশোধারা এবং রাহুলকে ‘কৃপা’ করার ‘সময়’ – এসে গেছে, ওনাদের ক্ষেত্রে ‘কাল’ প্রসন্ন হয়ে গেছে _তাই সেই দিনই, সেই বিশেষ ক্ষণেই তারা ভগবানের কৃপা লাভ করবে !
এটাই হল আসল রহস্য ! আমরা এই জন্মের বিচারে ওদেরকে কারুকে দেখছি ভগবানের মা, কারুকে বাবা অথবা স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তো ওরা সকলেই ভগবানের ভক্ত । জন্ম-জন্ম ধরে তপস্যা করে -সাধনা করে ওরা ভগবানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য চেয়েছিল। মাতা হিসাবে – পিতা হিসাবে_ স্ত্রী অথবা পুত্র হিসাবে শরীর নেবার জন্যই সাধনা করেছিল – তাই তো এই জন্মে ওরা ভগবানের মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র ! সুতরাং ভগবানের _ভক্তের মাথায় ‘পা’ চাপাতেও খারাপ লাগে না অথবা ওদেরকে পদতলে নতজানু হতে দেখেও তিনি বিচলিত হন না ৷ এগুলি তো কোন জন্মে ওই ভক্তেরই চাওয়া_তাইতো পাওয়া!
সুতরাং যাতে ঐ ভক্তটির জন্ম-জন্মান্তরের চাওয়া পূর্ণতা পায়, তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হয় – ভগবান সেই কাজটি করেন । সাধারণ মানুষ ঘটনাটির যে ব্যাখ্যাই করুক না কেন – তাতে কি-ই বা আসে যায়!
শিশু অবস্থায় আদর করার সময় সব সন্তানেরই পদাঘাত তাদের পিতা-মাতাকে সহ্য করতে হয় – কিন্তু সেটা স্নেহ ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ থাকে বলে পিতা-মাতার মনোজগতে কোন বিপরীত ছাপ তো ফেলেই না – বরং তাদের কাছে তা নিতান্ত আহ্লাদের কারণ হয় । ভক্তির জগতে ভগবানকে পুত্ররূপে পাবার সাধনায় রত সহস্র সহস্র ভক্তের কাছে – ‘ভগবানের চরণ মস্তকে পাবার বাসনা’ – যেন মুক্তি বা মোক্ষলাভের চাইতেও বেশি পাওয়ার ! তাই ‘ভক্তে’র কাছে ওই ঘটনাগুলি নিয়ে কোনো সংশয়, কোন বিপরীত ভাবনার উদ্রেক করে না – এগুলো ভাবায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে !
তা ভাবাক – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলেছেনই – “লোক না পোক !” মহামানবরা আমাদেরকে যখন দেখেন তখন এইরকমটাই দেখেন – আমাদের মনের মধ্যে কামনা-বাসনা, লোভ-হিংসা, মায়া-মোহের যে অজস্র কীট বা পোকা (পোক) কিলবিল করছে – সেইগুলো সব তাঁদের চোখের সামনে পরিস্ফুট হয়ে যায়! গুরুমহারাজের সিটিং-এ এইজন্যেই তো আমরা দেখতাম –কোন ব্যক্তি, হয়তো সে রাজনৈতিক নেতা, যে সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে, বাড়িতে হয়তো লাইব্রেরী রয়েছে – প্রচুর পড়াশোনা, কথায়-কথায় দেশি-বিদেশি দার্শনিকদের কোটেশন্ ফটর-ফটর করে বলতে পারে, রাস্তায় বেরোলে দশ-বিশজন অনুরাগী, মোসাহেব সঙ্গ ধরে – সেই হেন ব্যক্তিটিও গুরু মহারাজের সামনে এলেই, কেমন যেন অসহায় বোধ করতো ! যেন মনে হতো – তার সব জারি-জুরি, তার সব পড়াশোনা, তার সব বিদ্যে-বুদ্ধি গুরুমহারাজের সামনে এসে একদম Zero হয়ে গেছে !
সব মহাপুরুষের ক্ষেত্রেই এটা হয় – এই জন্যেই তো গুরু মহারাজ বলেছিলেন, “পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বারবার সম্রাটের উদ্ধত রাজমুকুট, পর্ণকুটিরে বসবাসকারী সন্ন্যাসীর পদতলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ।” পার্থিব বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-শিক্ষা দিয়ে কি অপার্থিব বিষয়ের তল পাওয়া যায় ? কোনদিনই পাওয়া যায় না ! শুধুমাত্র এই কথাটা বুঝতেই বহু মানুষের– বহু জন্ম লেগে যায় ! বামপন্থী, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী, আধুনিকতাবাদী, প্রগতিশীল – ইত্যাদি বিভিন্ন নামের পন্ডিত মহলের দিকে তাকিয়ে দেখুন – দেখবেন সেখানে কত আস্ফালন – কত হাঁকডাক – কত কথার কচকচানি ! প্রথমটায় ওসব শুনতে খুব একটা খারাপ লাগবে না – মনে হবে, ” বাঃ ! বেশ ভালই তো বলছে !” এবার যদি আপনি ওই ব্যক্তির (ব্যক্তিগণের) ঘনিষ্ঠ হতে পারেন – তার ব্যক্তিগত জীবনচর্যা দেখেন – তাহলেই আপনার সব ভক্তি ছুটে যাবে!
তাই এরা (নেতা, বুদ্ধিজীবীরা) মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয় সমকালীন, আর মহাপুরুষগণ হ’ন চিরকালীন ! এই বুদ্ধিজীবীরা ওই মহাপুরুষগণের সমালোচনা করে, কিন্তু সমালোচক এবং সমালোচনা হারিয়ে যায় – কালের বুকে উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকে ” যাঁকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে ” তাঁর নাম । এইভাবেই ভগবান রাম, ভগবান কৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের নাম মহাকালের বুকে লেখা হয়ে রয়েছে । [ক্রমশঃ]
আমরা আগের দিন আলোচনা করেছিলাম যে শ্রীবাসের বাড়িতে মহাপ্রভু পুরুষোত্তম-ভাবে শচীমাতার মস্তকে পদস্থাপন করেছিলেন এবং তাঁকে বৈষ্ণব অপরাধ থেকে মুক্ত করেছিলেন । এই ঘটনাটি গুরু মহারাজের মুখ থেকে শুনে (বৈষ্ণব গ্রন্থাবলীতেও নিশ্চয়ই ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে ৷) আমাদের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল ৷ ভগবান বুদ্ধের সামনে পিতা শুদ্ধোদনের নতজানু হয়ে বসা-টা তবুও মানতে পেরেছিলাম, কিন্তু শচীমাতার ঘটনাটা আমাদের মনকে খুবই ভারী করে তুলেছিল । আমরা গুরু মহারাজকে ওই ঘটনার উল্লেখ করে এর সঠিক ব্যাখ্যাটি জানতে চেয়েছিলাম । উনি বলেছিলেন – ” যেহেতু অদ্বৈত আচার্যের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাঁর বড়ছেলে বিশ্বরূপ গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বিশ্বম্ভর বা নিমাইও অদ্বৈত আচার্যকেই শিক্ষাগুরু হিসাবে গ্রহণ করার পর থেকেই সংসারে উদাসীন হয়েছিলেন – সেইজন্য শচীমাতা অদ্বৈত আচার্যকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না ! তিনি কোন কারনে ওনাদের বাড়িতে এলে বা রাস্তাঘাটে দেখা হলে শচীমাতা অদ্বৈত আচার্যকে উল্টোপাল্টা বাক্য বলে অপমান করতেন!
আর এই ভয়েই অদ্বৈত আচার্য নিমাই-এর বাড়িতে কখনো আসতেই চাইতেন না ৷ অদ্বৈতের সাথে সব সময় এক ঝাঁক বৈষ্ণব থাকতো – তাই নতুন কোন বৈষ্ণবকে দেখলেও শচীমাতা তাকে ভর্ৎসনা করতেন ৷ এই ব্যাপারগুলি সবই তার পুত্র নিমাই জানতো – কিন্তু যতক্ষণ ভগবান পুত্র-ভাবে আছেন, ততক্ষণ তিনি মাতাকে কিছু বলতে পারেন না! অথচ এদিকে তাঁর গর্ভধারিনী জননী দিনদিন বৈষ্ণব অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন – যার প্রারব্ধ ফল শচীমাতাকেই ভোগ করতে হবে, এইসব বিবেচনা করেই মহাপ্রভু ভগবৎ-ভাবে বা পুরুষোত্তম-ভাবে শচীমাতার মস্তকে পা দিয়ে তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ৷
পুরুষোত্তম-ভাব অবস্থায় তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, আর জগতের যা কিছু সে সবই তাঁর থেকে সৃষ্ট – তাই এই অবস্থায় স্থূল-সম্পর্কের কোনো স্থানই নেই ! সুতরাং সাধারণ চোখে দেখলে ব্যাপারটি খারাপ লাগলেও চিন্তার গভীরে গেলে বোঝা যায় – মহাপ্রভুর জীবনে এটিও ছিল ভগবানের লীলার অন্যতম একটি অঙ্গ !
যাইহোক, আমরা আবার বুদ্ধ বিষয়ক কথায় ফিরে আসি । আমরা আগের আলোচনায় ছিলাম কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথায় ! রাজা শুদ্ধোদনের সাথে ভগবান বুদ্ধের স্থূল সাক্ষাৎকার এবং কথাবার্তার কথাও আগে একটু-আধটু আলোচনা হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা তো হয় অন্যরকম । ঘটনাটা হয় কি জানেন – ‘ উপযুক্ত সময়’ হয়ে গেছে – তাই সেদিন ভগবানের রাজপ্রাসাদে আগমন! না হলে এতদিন আসেন নি কেন ? ওই দিনই বা আসলেন কেন ? বাবা শুদ্ধোদন, মা গৌতমী যশোধারা এবং রাহুলকে ‘কৃপা’ করার ‘সময়’ – এসে গেছে, ওনাদের ক্ষেত্রে ‘কাল’ প্রসন্ন হয়ে গেছে _তাই সেই দিনই, সেই বিশেষ ক্ষণেই তারা ভগবানের কৃপা লাভ করবে !
এটাই হল আসল রহস্য ! আমরা এই জন্মের বিচারে ওদেরকে কারুকে দেখছি ভগবানের মা, কারুকে বাবা অথবা স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তো ওরা সকলেই ভগবানের ভক্ত । জন্ম-জন্ম ধরে তপস্যা করে -সাধনা করে ওরা ভগবানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য চেয়েছিল। মাতা হিসাবে – পিতা হিসাবে_ স্ত্রী অথবা পুত্র হিসাবে শরীর নেবার জন্যই সাধনা করেছিল – তাই তো এই জন্মে ওরা ভগবানের মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র ! সুতরাং ভগবানের _ভক্তের মাথায় ‘পা’ চাপাতেও খারাপ লাগে না অথবা ওদেরকে পদতলে নতজানু হতে দেখেও তিনি বিচলিত হন না ৷ এগুলি তো কোন জন্মে ওই ভক্তেরই চাওয়া_তাইতো পাওয়া!
সুতরাং যাতে ঐ ভক্তটির জন্ম-জন্মান্তরের চাওয়া পূর্ণতা পায়, তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হয় – ভগবান সেই কাজটি করেন । সাধারণ মানুষ ঘটনাটির যে ব্যাখ্যাই করুক না কেন – তাতে কি-ই বা আসে যায়!
শিশু অবস্থায় আদর করার সময় সব সন্তানেরই পদাঘাত তাদের পিতা-মাতাকে সহ্য করতে হয় – কিন্তু সেটা স্নেহ ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ থাকে বলে পিতা-মাতার মনোজগতে কোন বিপরীত ছাপ তো ফেলেই না – বরং তাদের কাছে তা নিতান্ত আহ্লাদের কারণ হয় । ভক্তির জগতে ভগবানকে পুত্ররূপে পাবার সাধনায় রত সহস্র সহস্র ভক্তের কাছে – ‘ভগবানের চরণ মস্তকে পাবার বাসনা’ – যেন মুক্তি বা মোক্ষলাভের চাইতেও বেশি পাওয়ার ! তাই ‘ভক্তে’র কাছে ওই ঘটনাগুলি নিয়ে কোনো সংশয়, কোন বিপরীত ভাবনার উদ্রেক করে না – এগুলো ভাবায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে !
তা ভাবাক – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলেছেনই – “লোক না পোক !” মহামানবরা আমাদেরকে যখন দেখেন তখন এইরকমটাই দেখেন – আমাদের মনের মধ্যে কামনা-বাসনা, লোভ-হিংসা, মায়া-মোহের যে অজস্র কীট বা পোকা (পোক) কিলবিল করছে – সেইগুলো সব তাঁদের চোখের সামনে পরিস্ফুট হয়ে যায়! গুরুমহারাজের সিটিং-এ এইজন্যেই তো আমরা দেখতাম –কোন ব্যক্তি, হয়তো সে রাজনৈতিক নেতা, যে সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে, বাড়িতে হয়তো লাইব্রেরী রয়েছে – প্রচুর পড়াশোনা, কথায়-কথায় দেশি-বিদেশি দার্শনিকদের কোটেশন্ ফটর-ফটর করে বলতে পারে, রাস্তায় বেরোলে দশ-বিশজন অনুরাগী, মোসাহেব সঙ্গ ধরে – সেই হেন ব্যক্তিটিও গুরু মহারাজের সামনে এলেই, কেমন যেন অসহায় বোধ করতো ! যেন মনে হতো – তার সব জারি-জুরি, তার সব পড়াশোনা, তার সব বিদ্যে-বুদ্ধি গুরুমহারাজের সামনে এসে একদম Zero হয়ে গেছে !
সব মহাপুরুষের ক্ষেত্রেই এটা হয় – এই জন্যেই তো গুরু মহারাজ বলেছিলেন, “পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বারবার সম্রাটের উদ্ধত রাজমুকুট, পর্ণকুটিরে বসবাসকারী সন্ন্যাসীর পদতলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ।” পার্থিব বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-শিক্ষা দিয়ে কি অপার্থিব বিষয়ের তল পাওয়া যায় ? কোনদিনই পাওয়া যায় না ! শুধুমাত্র এই কথাটা বুঝতেই বহু মানুষের– বহু জন্ম লেগে যায় ! বামপন্থী, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী, আধুনিকতাবাদী, প্রগতিশীল – ইত্যাদি বিভিন্ন নামের পন্ডিত মহলের দিকে তাকিয়ে দেখুন – দেখবেন সেখানে কত আস্ফালন – কত হাঁকডাক – কত কথার কচকচানি ! প্রথমটায় ওসব শুনতে খুব একটা খারাপ লাগবে না – মনে হবে, ” বাঃ ! বেশ ভালই তো বলছে !” এবার যদি আপনি ওই ব্যক্তির (ব্যক্তিগণের) ঘনিষ্ঠ হতে পারেন – তার ব্যক্তিগত জীবনচর্যা দেখেন – তাহলেই আপনার সব ভক্তি ছুটে যাবে!
তাই এরা (নেতা, বুদ্ধিজীবীরা) মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয় সমকালীন, আর মহাপুরুষগণ হ’ন চিরকালীন ! এই বুদ্ধিজীবীরা ওই মহাপুরুষগণের সমালোচনা করে, কিন্তু সমালোচক এবং সমালোচনা হারিয়ে যায় – কালের বুকে উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকে ” যাঁকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে ” তাঁর নাম । এইভাবেই ভগবান রাম, ভগবান কৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের নাম মহাকালের বুকে লেখা হয়ে রয়েছে । [ক্রমশঃ]