শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ সিটিং-এ ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক যে সমস্ত আলোচনা করতেন, সেগুলি এখানে বলা হচ্ছিল । আমরা আগের দিন আলোচনা করেছি যে, ভগবান বুদ্ধ কপিলাবস্তু রাজপ্রাসাদে যেদিন গিয়েছিলেন – সেই দিনেই উনি ওনার মাতা, স্ত্রী ও পুত্রকে বৌদ্ধ শ্রমনের পোশাক(চীবর) পরিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে রাস্তায় নামিয়েছিলেন । হাজার হাজার রাজ্যবাসী সেদিন প্রাসাদের বাইরে সমবেত হয়েছিলেন তাদের প্রিয় রাজকুমার সন্ন্যাসীবেশী সিদ্ধার্থকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য ! কিন্তু তাদেরকে যে ওই দৃশ্য দেখতে হবে তারা কেউই স্বপ্নেও ভাবে নি ! রাজ্যবাসী সেদিন অবাক হয়ে দেখেছিল যে বুদ্ধের সহযাত্রী শ্রমনগণের সাথে ভগবান বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসছেন, আর তার পিছন পিছন গেরুয়া (কাষায় বস্ত্রের রং গিরিমাটি দেওয়া কাপড়ের মতো) পরিহিত রাজমাতা গৌতমী, নতনেত্র রাজবধূ যশোধারা এবং বালক রাহুল গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসছে !
এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে সেদিন কপিলাবস্তুর অধিবাসীরা যতটা না বিস্মিত হয়েছিল – তার থেকে বেদনার্ত হয়েছিল বেশি ! এটা কি করলেন তাদের প্রিয় রাজকুমার ? বৃদ্ধ পিতা শুদ্ধোদন-কে সিংহাসনে আসীন রেখে ভবিষ্যতের রাজা (রাহুল)-কে ওই শিশু বয়সেই সন্ন্যাসী করে পথে নামিয়ে দিলেন !!
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের এই ঘটনার সমালোচনা আজও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতেরা করে থাকেন ! এইজন্যেই গুরুমহারাজ বলতেন – “‘পন্ড’- শব্দ থেকে পন্ডিত শব্দটি এসেছে, পণ্ডিতদের কাজই হলো সব পন্ড করা ৷” কিন্তু দেখুন – প্রকৃতপক্ষে ‘আচার্য’ কথাটির অর্থ-ই তো হলো – ” যিনি তার নিজের জীবনে আচরণ করে দেখান এবং তারপর শিক্ষা প্রদান করেন ।” প্রাশ্চাত্যের দার্শনিকরাও বলেছে, ” Charity begains at home ৷” ভগবান বুদ্ধ নিজের পরিবারের লোকেদের যদি স্বমতে না আনতে পারেন, তাদেরকে ‘আর্যসত্যে’-র শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারেন – তাহলে অন্য লোককে তিনি কি শিক্ষা দেবেন, আর তারা তা গ্রহণই বা করবে কেন ? ভগবান বুদ্ধ বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছিলেন যথার্থ আচার্যের সংজ্ঞা ! “আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায় “– বৈষ্ণবদের এই কথা সমস্ত অবতারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য !
একটু অন্য লাইনের কথা হলেও এই প্রসঙ্গে গুরু মহারাজের বলা একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না ! উনি বলেছিলেন – “বর্তমানের সাম্যবাদী আন্দোলন কেন স্থায়ী হবে না জানিস্ – তার কারণ নেতৃস্থানীয় যারা রয়েছে, তাদের নিজেদের জীবনে ওই আদর্শের আচরণ বা প্রতিফলন নাই ! এদের বেশিরভাগই গোপনে উশৃংখল জীবন-যাপন করে, ছেলে-মেয়েদের হয় বিদেশে শিক্ষা করাতে পাঠায় অথবা দেশে রাখলেও সবচাইতে নামী-দামী বিদ্যালয়ে পড়ায়, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকে, দামি দামি ভোগ্যবস্তু গ্রহণ করে, আর বাইরের ঘরে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরীর মতো বানিয়ে সেখানে বিদেশি দার্শনিকদের লেখা বই কিনে ভরিয়ে রাখে – যাতে তার কাছে কেউ এলে, তাকে মহাপন্ডিত এবং Cultural ভাবে! সে শুধুমাত্র ওই বইগুলি এবং তাদের ভাবাদর্শের ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র পড়ে – এর বাইরে পৃথিবীর জ্ঞানরাজির দিকে চোখও বোলায় না ! তাহলে বল্ তো – এদের প্রচারে সাময়িকভাবে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে উচ্ছ্বাস ভরে প্রচুর হাততালি দিতে পারে – কিন্তু এগুলি কি স্থায়ী হবে ? কখনোই হবে না !
দ্যাখো – ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে! কতকাল ধরে কত মানুষ কত ভাবে কৃষ্ণ সম্বন্ধে সমালোচনা করেছে, গালাগালি দিয়েছে, কুৎসিত মন্তব্য করেছে – কিন্তু তাতে কি ? গোটা পৃথিবীর পণ্ডিতমহল যখন শ্রীকৃষ্ণ ভগবান মুখনিঃসৃত ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’- পড়ে – তখন অবাক হয়, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবনে আচরণ করে – জীবনের আত্মিক উত্তরণ ঘটায় ! এই ভাবেই ভগবান রাম, ভগবান বুদ্ধ, করুণাময় যীশু, হযরত মুহাম্মদ- সহ সমস্ত মহাপুরুষেরাই কালোত্তীর্ণ হয়ে মানুষের মনে অনেককাল বেঁচে থাকে ! আর এইসব গলা-ফোলানো ব্যাঙের মতো ‘হামবড়া’ রাজনেতারা অল্পদিনের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায় !”
কি কথায় কি সব এসে যাচ্ছে, তাই আবার ফিরে আসি আমাদের মূল আলোচনায় ! সেদিন ভগবান বুদ্ধ তাঁর পরিবারের পিতা ছাড়া বাকি সকলকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর পোশাক পরিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাস্তায় বের করে এনেছিলেন ৷ কিন্তু তাঁদেরকে নিয়ে গিয়ে রাখবেন কোথায় ? সমস্যায় পড়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ! তার কারণ যে কজন প্রধান সহচরদের (আনন্দ, সরিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন প্রমুখরা) নিয়ে উনি কাজ শুরু করেছিলেন – তাদের-কে তিনি আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তাঁর এই নতুন ধর্মমতে শুধুমাত্র পুরুষরাই সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করবে এবং ত্যাগী ভক্ত হিসাবে বৌদ্ধধর্ম প্রচার বা প্রসারের কাজটি সম্পন্ন করবে । তিনি সর্বসমক্ষে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, __কোন নারী-কে তিনি কখনোই তাঁর সঙ্ঘে বা সংঘারামে প্রবেশ করতে দেবেন না । কিন্তু তাঁর জননী (গর্ভধারিনী না হলেও তাঁর ধাত্রী এবং পালনকর্তী মাতা ছিলেন গৌতমী ৷) এবং সহধর্মিনী যখন কাষায় পরিধান করে ‘ বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি ‘ – মন্ত্র বলতে বলতে বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন – তখন তাঁদেরকে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা তো একান্তই জরুরী হয়ে পড়ল !
ভগবান বুদ্ধ সেদিন-ই পুনরায় ঘোষণা করলেন – যে এখন থেকে সন্ন্যাসিনীদের জন্যেও পৃথক সংঘারাম তৈরি হবে এবং সেখানে কোনদিনই কোন পুরুষের আধিপত্য থাকবে না, পুরুষের প্রবেশাধিকারও থাকবে না । সেইদিন তিনি এটাও ঘোষণা করেছিলেন যে, নারীদের জন্য নতুন যে সংঘারামটি তৈরি হবে – তার প্রধানা হবেন মাতা গৌতমী ৷ ওই সন্ন্যাসিনী সংঘে এরপর থেকে ত্যাগব্রতী হয়ে যে সমস্ত নারীরা আসবেন – তারা ঐ মা গৌতমীর কাছেই সন্ন্যাস নেবেন ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – নারীদের সংঘারাম প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে মা গৌতমী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নারীসংঘ গুলিকে (পরবর্তীতে একাধিক নারীসংঘ গড়ে উঠেছিল) খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছিলেন ৷ সেই যুগের শতশত অভাগিনী-দুঃখিনী নারীর চোখের জল মুছিয়ে – তাদের জীবনে শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছিলেন মাতা গৌতমী । যশোধারাও ভিক্ষুণী হিসাবে মাতা গৌতমীকে খুবই সাহায্য করতেন । সর্বোপরি বুদ্ধ-পুত্র রাহুলও তাঁর পরবর্তী জীবনে একজন আদর্শ বৌদ্ধভিক্ষু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন । [ক্রমশঃ]