গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে যে সিটিং করতেন, সেই সময় উপস্থিত ভক্তজনের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন। ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা বা রুচির মানুষ আর তাই তাদের জিজ্ঞাসাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন । ফলে একই দিনের সিটিং-এ নানান বিষয়ের উপর জিজ্ঞাসা আসতো এবং সেই অনুযায়ী ওনার উত্তরও হোত আলাদা আলাদা বিষয়ের উপর ৷ উনি নিজেই একবার বলেছিলেন _”এক একটা সিটিং-এ আমার চেতনাকে কয়েক light year ওঠানামা করতে হয়।
এই ব্যাপারটা দেখেই সিটিং-এ উপস্থিত শিক্ষিত মানুষেরা অবাক হয়ে যেতো ! তারা ভাবতো, ‘এই আশ্চর্য মানুষটা’ –এত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর এতো নিখুঁত ভাবে আলোচনা করছেন কি করে ? __আপনারা যারা গুরু মহারাজের যে কোনো বই পড়েন বা কোন ভক্তের কাছ থেকে তাঁর করা আলোচনা শোনেন (যারা তাঁকে স্থূলচোখে দেখেন নি তাদের কথা বলছি) – তখন নিশ্চয়ই আপনারাও অবাক হ’ন, নিশ্চয়ই ভাবেন ‘গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ’– ব্যক্তিটির প্রচুর পড়াশোনা ছিল – উনি বিরাট পণ্ডিত ছিলেন – ওনার প্রচুর বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল !
কিন্তু – না ! ওনার এসব কিছুই ছিল না । গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সাবলীলভাবে-ই কথাগুলি বলতেন বা যে কোন মানুষের যে কোনো জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন । অবশ্য এটা আমরা দেখতাম যে, প্রায় একই জিজ্ঞাসা বা একই ধরণের জিজ্ঞাসার Repeatation হলে উনি কিন্তু সেইসব জিজ্ঞাসার যে সবসময় হুবহু একই ধরনের উত্তর দিতেন – তা কিন্তু নয় ! স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তাঁর উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হোত! এইজন্যেই আপনারাও দেখবেন, আমরা – যারা তাঁর কথাগুলো লেখার চেষ্টা করি, তাদের লেখাতেও একই ধরনের জিজ্ঞাসার পুনরাবৃত্তি হলে – গুরু মহারাজের উত্তরটা কিন্তু সামান্য পৃথক!
এটা কেন হতো ? – তার কারণ জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তিটির মানসিক Level বা চেতনার Level অনুযায়ী-ই উনি তাকে উত্তর দিতেন ৷ না হলে সে তো কথাগুলি বুঝতেই পারবে না ! আবার অনেক সময় দেখেছি জিজ্ঞাসাকরীর হয়তো মানসিক Level অতটা উন্নত নয় কিন্তু সেদিনকার সিটিং-এ অনেকগুলো ভালো ভালো মানুষ উপস্থিত রয়েছে – সেদিন উনি একটা অতি সাধারণ জিজ্ঞাসা-কে ধরেই অতি উচ্চ স্তরের আলোচনায় চলে যেতেন!
যাইহোক, আমরা আবার ফিরে যাই গুরু মহারাজের করা ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক আলোচনায় ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন নগরনটী আম্রপালির কথা । তখনকার দিনে শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা কোন রাজ্যে জন্মালে, পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে, রাজ্যের খরচায় তাদেরকে ছোট অবস্থা থেকেই নানা রকম Training দিয়ে রাজধানীতে রাখা হতো ‘নগরবধূ’ বা ‘নগরনটী’ হিসাবে! এরা ছিল ওই রাজ্যের রাজস্ব-রোজগারের একটি অন্যতম মাধ্যম । একে তো ওই নারীরা অসাধারণ সুন্দরী_তাছাড়া লাস্যময়ী, সংগীত ও নৃত্য পটিয়সী, কামকলা পটিয়সী(সমস্ত রকম training থাকতো তাদের) হওয়ায় রাজ্যের ধনী শ্রেষ্ঠী, জমিদার বা যে কোন ধন্যাঢ্য ব্যক্তিরা ঐ নারীর কাছে আসতে চাইতো, তার সান্নিধ্য লাভ করতে চাইতো ! কিন্তু তখনকার দিনেই হয়তো এই সব নারীর এক রাতের মূল্য ছিল হাজার স্বর্ণমুদ্রা বা আরো বেশি ! প্রাচীন গ্রন্থে এই ধরনের নগরবধূর যে সব নাম পাওয়া যায় তাতে দেখবে লক্ষহীরা ইত্যাদি নাম রয়েছে – এইসব নাম দেওয়া হয়েছিল এইজন্যেই যে ওই নারীর এক দিনরাত্রির মূল্য হয়তো ছিল এক লক্ষ মুদ্রা !
ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, ওই ধরনের নগরবধূদের কাছে সাধারণ মানুষ যেতে পারতো না । এরা রাজার দ্বারা নিরাপত্তা পেতো, প্রাসাদ বা অন্যান্য সমস্ত রকমের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো – আর বিনিময়ে ওদের দ্বারা যে বিপুল পরিমাণ আয় হতো, তার বেশিরভাগটাই রাজস্ব হিসাবে রাজকোষে জমা পড়ে যেতো ৷
ভগবান বুদ্ধ যখন উত্তর-পশ্চিম-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় খুব সম্ভবত বৈশালী নগরীতে ‘আম্রপালী’ নামে ওই ধরনের একজন নগরবধূ বাস করতেন । আম্রপালীর বর্তমান জীবন নগরবধূ হিসাবে কাটলেও তার পূর্ব পূর্ব জীবনের সাধন-সংস্কার নিশ্চয়ই ছিল – হয়তো কোনো অপরাধের ফলভোগ করার জন্যই তার ওই কয়েক বৎসর নগরবধূর জীবন যাপন ! যাইহোক, আমরা ভগবান বুদ্ধের কথায় আসি ! সেদিন সন্ধ্যা আগতপ্রায় – বুদ্ধ তাঁর ভক্তদের নিয়ে নগরের পথ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলে যাচ্ছেন – রাত্রিযাপনের জন্য নগরের বাইরে কোন স্থানের (কোন ফাঁকা স্থান বা বৃক্ষতল) সন্ধানে ! হঠাৎ ভগবান বুদ্ধ নগর প্রান্তের একটি মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন – তারপর তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করে বললেন – “তোমরা চলে যাও, কোন উপযুক্ত স্থান দেখে রাত্রিতে বিশ্রাম করো ! আমার কিছু কাজ রয়েছে, সেই কাজগুলি সেরে আমি ওখানেই তোমাদের সাথে মিলিত হবো !” এই বলে উনি একটি নির্দিষ্ট দিকে হাঁটতে লাগলেন ৷
ভগবানের মুখে একথা শুনে অবাক বিস্ময়ে উপস্থিত সকলে ওনার গন্তব্যের দিকে চেয়ে দেখলো – উনি যেদিকে হাঁটছেন সেদিকে তো নগরবধূ আম্রপালীর প্রাসাদ ! ওদিকে তো সাধু-সন্ত, ধার্মিক ব্যক্তির যাওয়া একেবারেই মানা !! তাহলে ভগবান ওদিকে যাচ্ছেন কেন ? বুদ্ধ ভক্তেরা হায়-হায় করে উঠলো, কৌতুহলী জনগণের চোখ চকচক করতে লাগলো, খবরটা নগরে মুহুর্তের মধ্যে চাউর হতে সময় লাগলো না ! বুদ্ধের সহযাত্রী শিষ্য-ভক্তেরা ওই মোড় থেকে কিছুটা দূরেই তাঁর আদেশ মেনে একটি ফাঁকা স্থান দেখে সেখানেই ভগবান বুদ্ধের ফেরার জন্য প্রতীক্ষা করতে শুরু করলেন । নগরের বদ-লোকেরা, বুদ্ধের সমালোচকেরা সেখানে এসে ভিড় জমালো – মজা দেখার জন্য, পরদিন সবার কাছে মজাদার খবর পরিবেশনের জন্য ! ওখানে উপস্থিত সকলেই সেই রাতটি বিনিদ্র অবস্থায় কাটিয়ে দিল –তবে ভগবানের ভক্তরা যন্ত্রনার সঙ্গে এবং সমালোচকেরা কৌতুহলমিশ্রিত মজাদার ও রসালোচনায় !
প্রতিদিনের মতো সেদিনও ভোরের আকাশ তখন সবে একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে, কুসুম-কাননে দু-একটা পাখি সবে একটা-দুটো শিস দিতে শুরু করেছে, ভোরের মৃদু শীতল বাতাস ধরণীকে স্নিগ্ধতার পরশ এনে দিচ্ছে ! এমন সময় সবার কানে গেল একটি মধুর আওয়াজ – ” বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।” উপস্থিত সকলে সেই আওয়াজ অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল ধীর পদক্ষেপে ভগবান বুদ্ধ শান্তভাবে হেঁটে হেঁটে আসছেন আর পিছনে মুণ্ডিত-মস্তক কাষায় পরিহিত নতমস্তক, সন্ন্যাসীনী বেশে লাবণ্যময়ী- লাস্যময়ী আম্রপালী ! যার মুখ থেকেই ওই ত্রিশরণ মন্ত্র অনর্গল উচ্চারিত হয়ে চলেছে !
এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে বুদ্ধের ভক্তরা ভগবান বুদ্ধের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকল – সমালোচকের দল যারা মজা দেখতে এসেছিল, তারা ‘মজা হলো না’ – দেখে অচিরেই স্থানত্যাগ করে চলে গেল ৷৷ [ক্রমশঃ]