গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক নানান প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছিল ৷ অনেক বিষয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা এসে পৌঁছেছি গুরু মহারাজের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথায় ! যখন উনি বালক বয়সে বুদ্ধগয়া এবং গয়া অঞ্চল পরিভ্রমণ করছিলেন – সেই সময়কার কথা হচ্ছিল । গুরুমহারাজ তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা সিটিংয়ে হয়তো বেশ কয়েকবার বলেছিলেন (কারণ তখন আমরা দেখতাম কোন একটা প্রসঙ্গের কথা, গুরুমহারাজ প্রথমবার বলার পর বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরে ফিরে সেই আলোচনাতেই ফিরে যেতেন । যদিও প্রতিবার-ই কিছু নতুন নতুন তথ্য তাতে সংযোজিত হতো এবং উনি প্রতিবারই নতুন নতুন আঙ্গিক থেকে কথাগুলো পরিবেশন করতেন ৷
যাইহোক, গুরু মহারাজ প্রথম যেদিন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে বুদ্ধগয়ায় ওনার ঐ বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন (আমি অন্তত সেইদিনই প্রথম শুনেছিলাম) – সেইদিন ওনার জলদগম্ভীর কন্ঠের সেই – “ধ্যান করো – ধ্যান করো – ধ্যান করো” নাদ (সেদিন ওনার এই ধরনের শব্দ গুলি আমার কাছে মনে হয়েছিল ‘শব্দ’ নয় যেন ‘নাদ’!) – যখন আমাদের কানে এসে বাজছিল, তখন যেন সারা শরীরে ওই নাদের Vibration- ছড়িয়ে পড়ছিল এবং শরীরটাকেও ঝংকৃত করে তুলছিল ! সেদিন ব-হু-কষ্টে ওনার সামনে সিটিংয়ে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকতে পেরেছিলাম, কিন্তু যখন গুরুমহারাজ গয়ায় ওনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে – “বিচার করো – বিচার করো – বিচার করো” – এই ‘নাদ’ উচ্চারণ করতে শুরু করেছিলেন, সেই মুহূর্তে ঐ সিটিং-এ উপস্থিত বাকিদের কি অনুভূতি হয়েছিল – তা আমি জানতে পারিনি, কিন্তু আমি আর ওনার সামনে বসে থাকতে পারিনি – আমাকে সিটিং ছেড়ে উঠে চলে যেতে হয়েছিল! চলে যেতে হয়েছিল ওনার তখনকার মাটির ঘরটার পিছন দিকে (তখন ওইসব স্থান ফাঁকা ছিল এবং লোকজন কম থাকায় নির্জন ছিল৷), সেখানে গিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে (ভস্তিকা ক্রিয়া) – অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে সামলাতে হয়েছিল ।
আসলে ঘটনাটা হয়েছিল কি – যখনই গুরুমহারাজ বলতে শুরু করেছিলেন যে বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নিচে বসতেই – ওখানকার মাটি, ওখানকার পরিবেশ থেকে ধ্বনিত হতে লাগল – “ধ্যান করো, ধ্যান করো, ধ্যান করো” – সেই সময় (আমার মনে হয়েছিল) বনগ্রামের আশ্রমের ঐ সিটিং-এর স্থানের মাটি-ও কম্পিত হচ্ছিল এবং এর ফলে শরীরে একটা কাঁপন লাগছিল – মাথাটা যেন হালকা হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল হয়তো আমি বসে বসেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাবো ! এইরকম অবস্থা হতেই আমি নিজেকে স্থির রাখার খুব চেষ্টা করছিলাম এবং নিজেকে শান্ত রাখার জন্য নিজের সঙ্গেই লড়াই চালাচ্ছিলাম । এমন সময় গুরু মহারাজ ওই প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে – এইবার ওনার গয়ার দিকে যাত্রা করার কথা বর্ণনা করতে শুরু করলেন ৷ ফলে সেইটুকু সময়ের জন্য মাটির কম্পন এবং শরীরের কাঁপন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু তারপর উনি বুদ্ধগয়ায় ফল্গু নদীর তীরে একটি বটবৃক্ষের নিচে বসে থাকার সময় কালীন ওনার আবার অন্তর্মুখী অবস্থার কথা বলতে শুরু করলেন ৷ সেবারও আশ্রমের ঐ স্থানের মাটি, সেখানকার পরিবেশ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল সেই ধ্বনি – “বিচার করো, বিচার করো, বিচার করো” !
আর সেই মুহুর্তেই বনগ্রামের গুরু মহারাজের ঘরের সামনের মাটি আবার প্রকম্পিত হতে শুরু করছিল ৷ আবার সেই কম্পন শরীরকে কাঁপাতে শুরু করেছিল – চেতনাকে কোথায় যেন নিয়ে চলে যাচ্ছিল – প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল যেন অচেতন হয়ে যাবো ! কিন্তু তেমনটা হলে অতগুলো লোকের সামনে একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যেতে পারে – এই ভেবে চরম অভদ্র বা অসভ্যের মতো একরকম দৌড়ে গুরুমহারাজের সামনে থেকে উঠে যেতে হয়েছিল !!
সেই দিনের পর থেকে গুরু মহারাজের সিটিং-এ বসে এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমার আর কখনও হয়নি (হয়তো গুরুমহারাজ-ই ঐরকম ভাব নেবার অনুপযুক্ত ভেবে আর কোনদিন হতে দেন নি) । চরৈবেতির সম্পাদক স্বামী স্বরূপানন্দ আমার ওইভাবে দৌড়ে উঠে যাওয়াকে খেয়াল করেছিলেন – উনি পরে আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন ৷ আমি গুরুমহারাজের ঐ সিটিং-এর ভয়ঙ্কর Vibration সহ্য না করতে পারার কথা ওনাকে বলায় – উনি ব্যাপারটা বুঝেছিলেন ।
যাইহোক, এসব কথা থাক ! আমার মনে হয় গুরু মহারাজের কাছে তখন যারাই যেতেন, তাদের বেশিরভাগ জনেরই এই ধরনের কোন না কোন অভিজ্ঞতা রয়েছে ! আর থাকবেই না-ই কেন ? স্বয়ং ভগবানের সান্নিধ্যে থাকলে কখন যে কি লীলা ঘটে যায় – তার কি কোনো সাধারণ নিয়ম আছে ? যখন খুশি – ওনার যা মন চায় – তাই ঘটতে পারে ৷ তিনি যে লীলাময় – লীলাবিলাস তো হয়েই চলেছে, যার যেমন ভাব – তার তেমন লাভ হয় !
গুরুমহারাজ সেদিন ওই দুটি ঘটনার পরপর উল্লেখ করে__ দুটি ঘটনার-ই ব্যাখ্যাও করেছিলেন । উনি বলেছিলেন ভগবান বুদ্ধের ওই বোধিবৃক্ষের নিচে অর্হত্বলাভ হয়েছিল – ফলে ঐ স্থানটির ভূমির high vibration তো ছিলই, তাছাড়া পরবর্তীকালের শত শত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী-সাধকেরা ওই স্থানে সাধন-ভজন করেছে, বুদ্ধের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছে – ফলে ওখানকার ভূমি-তে এখনও সেই সবকিছুর অদৃশ্য ‘ছাপ’ রয়ে গেছে ! উপযুক্ত আধার ঐ সব স্থানে গেলেই সেগুলির প্রভাব ঐ শরীরে পড়ে । এমনটাই হয়েছিল গুরু মহারাজের ক্ষেত্রে ! গুরুমহারাজ (বালক রবীন) ওই স্থানে একটু বিশ্রামের জন্য বসতেই – হু-হু করে ওই স্থানের Vibration গুরু মহারাজের শরীরে এসে গিয়েছিল এবং গুরুমহারাজের ওই দিনে ওই স্থানে বসেই অর্হত্ত্ব লাভ হয়ে গিয়েছিল (অবশ্য গুরু মহারাজের অর্হত্ব-বুদ্ধত্ব সবই হওয়াই ছিল, তবু আর একবার করে ঝালাই করে নেওয়া) ।
এরপরে গুরুমহারাজ যখন গয়াধামে গেলেন এবং বিষ্ণুর পাদপদ্ম দর্শন করে ফল্গু নদীর তীরে একটি বটবৃক্ষের নিচে বসেছিলেন – তখন ওখানকার ভূমির Vibration ওই পবিত্র আধারে ( গুরু মহারাজের শরীরে) প্রবেশ করতে শুরু করছিল । বহু পূর্ব পূর্ব কাল থেকে ওই স্থানে ঋষি-মুনি, মহাত্মা-মহাপুরুষগণ বেদান্তের বিচার এবং ষড়দর্শনের বিচার করেছিলেন । সেইগুলির সম্মিলিত রূপ গুরু মহারাজের কাছে প্রকট হয়েছিল এবং বেদ-বেদান্ত ষড়দর্শনের যাবতীয় জ্ঞান ওই অল্প বয়সেই (তখন ওনার এই স্থূলশরীরের বয়স ১১/১২ বছর ছিল) ওনার মধ্যে প্রবেশ করেছিল ।। …. [ক্রমশঃ]