গুরু স্বামী পরমানন্দ বলতেন – ” তাঁর চলা পা, আর বলা মুখ “! অর্থাৎ তিনি বেশিদিন একস্থানে থাকতে পারতেন না – মা জগদম্বার নির্দেশে শুধু ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তেই নয় – তাঁকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে পৃথিবীর-এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ! উনি বলেছিলেন – ” এবার মায়ের (মা জগদম্বা) নির্দেশ আছে, আমার এই শরীরটা আমেরিকা মহাদেশে যাবে না ।”– সেইজন্য উনি আমেরিকা মহাদেশের কোন স্থানে বা কোন দেশে পা দেন নি ! কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের প্রায় সমস্ত দেশে (ছোট-বড়, ধনী-গরীব, প্রায় সব দেশেই উনি গিয়েছিলেন), আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে – ওনার রাতুল চরণ পড়েছিল । উনি যেখানেই গেছেন_ ৺রী মায়ের নির্দেশেই গেছেন_এবং গেছেন বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে ! সোভিয়েত রাশিয়ার ভেঙে যাওয়া (U.S.S.R থেকে রাশিয়া), পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, দুই জার্মানির মিলন ইত্যাদি আরো অনেক ঘটনার কথা তখন আমরা যা শুনেছিলাম, সেগুলি গুরু মহারাজের শ্রীচরণ ইউরোপে পড়ার পর-ই সংঘটিত হয়েছিল ।
গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন – ” বর্তমানের কিছু কিছু ধর্মমত যেন ধর্মজগতে ক্যান্সার আক্রান্ত অঙ্গের ন্যায় হয়ে গেছে – এগুলি যত তাড়াতাড়ি কেটে বাদ দেওয়া যায় তত-ই ধর্ম জগতের মঙ্গল হবে ৷” উনি আরো বলেছিলেন – ” এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য বহু উন্নত সাধক সংকল্প গ্রহণ করে বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শরীর নিয়েছেন । ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বজুড়ে ধর্মনৈতিক ভাবে যে সংকট বা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং এর সঙ্গে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার তাগিদ, বিশ্বের শক্তিলালী দেশগুলির রাজনৈতিক নেতৃবর্গের অংশগ্রহণ – খুব শীঘ্রই ওই ব্যাপারটাকে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে – এটা সুনিশ্চিত !”
গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন – “আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যতদিন পাকিস্তানকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে মেনে চলবে – ততদিন ওদেরও দুর্গতি, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিরও দুর্গতি ! ওরা যেদিন সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানকে ছেড়ে ভারতের হাত ধরবে – মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এখানকার সমস্ত রকম অস্থিরতার অবসান ঘটবে ।” সন্ত্রাসবাদ এখন ভারতবর্ষসহ সমগ্র বিশ্বেরই একটা জ্বলন্ত সমস্যা – এই নিয়ে গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হলে উনি বলেছিলেন – ” ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে রয়েছে ! এখন যেটা দেখছিস – এইটা আরো প্রকট হবে । আর তখনই গোটা বিশ্বের শুভকামী শক্তিগুলি একজোট হয়ে এই সন্ত্রাসবাদকে একেবারে উৎপাটিত করে দেবে ! তবে জানবি – সমস্ত কিছুরই বীজ মা মহামায়ার আঁচলে বাঁধা রয়েছে, প্রয়োজনে আবার কোন সময় তা বেরিয়ে আসবে ৷ সভ্যতার ক্রমবিকাশ-ই হলো মহাপ্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম – সেখানে যা বাধাস্বরূপ, তা তো অপসারিত হবেই ! না হলে মা মহামায়ার কাজটি চলবে কেমন করে ?”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমনের সময়কালীন এই বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষের নিদারুন পরিস্থিতির কথা ! আজ থেকে মাত্র ৫০০/৫৫০ বছর আগের কথা – সেই সময় যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিল এই বাংলার – তা বর্ণনাতীত !
ভারতবর্ষের মাটিতে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের সেন্টিমেন্টজনিত সমস্যা বহুকালের ৷ রামায়ণের মতো প্রাচীন গ্রন্থেও ‘শূদ্রকে’র কাহিনী পাওয়া যায় – শুধুমাত্র শুদ্রশ্রেণীর লোক হওয়ায় যার সামান্য অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ! বহুকাল থেকেই ভারতবর্ষের নিম্নবর্ণের লোকেরা সামাজিক বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করতে পারতো না ৷ গোটা বিশ্বের মানুষের মধ্যেই এই মানসিকতা রয়েছে যে, সবল (দৈহিক, অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্নভাবে সবল) ব্যক্তিরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করে, অনাচার করে – তাদেরকে সবসময় দমিত করে, পদদলিত করে রাখতে চায় । এইভাবেই ক্রীতদাস প্রথা, ভূমিদাস প্রথা, বর্ণবিভাগ, শ্রেণীবিভাগ, ধর্মবিভাগ ইত্যাদিগুলি ছাড়াও আরো কতভাবে যে সবলেরা দুর্বলদেরকে dominate করে রাখার ব্যবস্থা করেছিল – তার ইয়ত্তা নেই !
এখন কথা হচ্ছে এই উচ্চশ্রেণী কারা ? এরা কি মঙ্গল গ্রহের বা অন্য গ্রহের মানুষ ? না তা নয় – তারাও এই পৃথিবী গ্রহেরই মানুষ ! যে কোনো ভাবে দৈহিক শক্তিকে বা বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে – তারা একবার ‘বল’ (দেহের বল, জনবল, ধনবল, বুদ্ধিবল ইত্যাদি) সঞ্চয় করে নিয়েছিল – এইবার শুরু হলো তাদের থেকে কম বল-সম্পন্নদেরকে তাদের স্বমতে আনার প্রচেষ্টা ! এই ভাবেই শুরু হয়েছিল উচ্চ-নিচের ভেদাভেদ এবং অত্যাচার ও অনাচার!!
আদিম মানব সমাজে তো এখনকার মতো এত ধর্মমত, এত রাষ্ট্র বা দেশ, এত পারমানবিক বোমা – এই সবিকছু ছিল না ! কিন্তু তখনো বিরোধ ছিল । কি নিয়ে সেই বিরোধ – দলের কর্তৃত্ব নিয়ে, নারীর অধিকার নিয়ে, খাদ্যের অধিকার নিয়ে, এলাকার দখল নিয়ে _চরম বিরোধ ছিল ৷ ধীরে ধীরে মানবের বিবর্তন ঘটলো, সমাজের বিবর্তন ঘটলো ! তারা একটু একটু সভ্য হলো, সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে লাগলো !জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে আদিম মানুষেরা গ্রাম নগর করে তুলল ! পোশাকের ব্যবহার, আগুনের ব্যবহার ইত্যাদি শিখল! এইবার তাদের মধ্যে জাগল আবিষ্কারের নেশা ! তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে জিজ্ঞাসা তুলতে শুরু করল – এটা কি? ওটা কি ? ওটা অমন কেন? এটাকে কি পরিবর্তন করা যায় ? আমাদের জীবনে এটাকে কি আরো উপযোগী করা যায় ? এই ভাবেই শুরু হল আবিষ্কার — চাকার আবিষ্কার, নৌকার আবিষ্কার, পশুপালন ও কৃষি কার্যের মানসিকতা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয জিনিসপত্রের আবিষ্কার, ঘরবাড়িগুলোকে আরও মজবুত করার প্রয়োজনীয়তা এবং বিভিন্ন উপকরনের আবিষ্কার ! আর এইসব আবিষ্কারের কাজগুলি যারা করত তারাই ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী, পন্ডিত, দার্শনিক, মুনি, ব্রাহ্মণ, উচ্চবর্ণ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হোল । কিন্তু সবার উপরে ছিল দলপতি, সর্দার ইত্যাদিরা ৷ পরবর্তীতে আরো বড় আকারে এরাই জমিদার বা রাজা নামে পরিচিত হয়েছিল । যে কোন দলের সবচাইতে শক্তিমান বা বলবান ব্যক্তি হত ওই দলের সর্দার (পশুজগতে আজও এই নিয়ম রয়েছে) ! পরে গায়ের বল এবং বুদ্ধিবল এই দুটি বিবেচনা করেই _সর্দার, দলপতি ইত্যাদি নির্বাচিত হোত । অনেকসময় কোন দলে অত্যাচারী-অহংকারী ব্যক্তি, স্বঘোষিত দলপতি হয়ে বসতো কিন্তু সেইসব দলে ঝগড়া-অশান্তি লেগেই থাকতো । এই দলের অন্য সদস্যরা সুযোগ পেলেই অন্য দলে চলে যেতো – আবার অনেকে সুযোগ সুবিধার আশায় সর্দারের পদলেহন করে পড়ে থাকতো । এইভাবেই মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেনীর সৃষ্টি হয়ে ছিল ।এরা সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো এবং সাধারন প্রজাদের উপর নির্যাতন করতো| নায়েব ,গোমস্তা ,রাজকর্মচারী এইসব নামে মানুষ এদেরকে চিনতো|
[মানবসমাজের বিবর্তনের.ইতিহাস ও গুরুমহারাজের কাছে যা শুনেছিলাম সেগুলি আলোচনা করে মহাপ্রভূর কথায় ফিরবো ।] (ক্রমশঃ)