গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর নবদ্বীপ লীলা নিয়ে অনেক কিছু কথা বলেছিলেন | সেইগুলিই এখন আলোচনা করার কথা ছিল | কিন্তু তার আগে মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে সিটিংয়ে উনি যেসব কথা বলতেন , সেগুলির মধ্যে আমার যেটুকু মনে আছে_ সেইগুলিকে একজায়গায় করে আপনাদের সকলের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি| তারপর ঐ আলোচনায় যাবো ।
একদম আদিম মানবসমাজ থেকে ধরে গুরু মহারাজ মানব সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে কথা বলতে বলতে আধুনিক সমাজব্যবস্থা পর্যন্ত সমস্তরকম আলোচনা করতেন । আদিম মানব সমাজে যখন মানুষ পোশাকের ব্যবহারও জানতো না – তখন মহিলাদের বক্ষবন্ধনী এবং পুরুষ ও মহিলাদের নিম্নাঙ্গের আবরণ কেন প্রয়োজন হয়েছিল এবং এগুলি লজ্জা নিবারণের মাধ্যম কেন – সেই আলোচনাও গুরুমহারাজ করেছিলেন ৷ আদিম মানব সমাজ নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই সব সময় অনাবৃত অবস্খাতেই থাকতো (আর পাঁচটা সাধারণ পশুপাখি বন্য জীবজন্তুদের মতোই), সেখানে কারো মনে কোন লজ্জার বোধ-ই জাগ্রত হতো না এবং এই নিয়ে কারো কোনো সমস্যাও ছিল না । কিন্তু হল কি – শিকারের পিছন পিছন তাড়া করার সময় জঙ্গলের বন-ঝোপের কাঁটায় নারীশরীরের সব চাইতে নরম অঙ্গ গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হোত সবচাইতে বেশি, বন্যপশুর সাথে লড়াই করার সময় তাদের দাঁত বা নখের আঘাতেও সেই অঙ্গগুলি-ই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো! তাছাড়া ছোটাছুটির সময়েও ঐ অঙ্গগুলি-ই সবচাইতে অসুবিধার ছিল – তাই প্রথম প্রয়োজন হলো, নারীর বক্ষবন্ধনীর ! ফলে লতা-পাতা দিয়ে নারীরা বক্ষ বন্ধন করে রাখতো–বাইরে বেরোনোর সময় । এইভাবে পুরুষের যে অঙ্গগুলি শিকারের সময় বা ছোটার সময় অসুবিধার সৃষ্টি করত, সেইগুলিও বেঁধে রাখার প্রয়োজন হোল | যে অঙ্গগুলি বারবার বিশ্রীভাবে আহত বা রক্তাক্ত হতো, সেই অঙ্গগুলোতে ঘা-ফোঁড়া হয়ে, সেপটিক্ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতো – তাই সেইটি ছিল সমগ্র দলের কাছে চরম সমস্যার – তাই সেইটা ছিল “লজ্জা”-র বিষয় । ফলে, সেই সময়কার প্রতিমুহূর্তের সংগ্রামশীল জীবনের পক্ষে – যা ওই দলের কোনো সদস্যকে দুর্বল করে তুলছে তা তো “লজ্জা”-র বিষয় হবেই ! এই ভাবেই শুরু হয়েছিল লজ্জা নিবারণের আবরণের জয়যাত্রা ! যা পরিবর্তিত হতে হতে আজকের আধুনিক পোশাক !
নারীর নিন্মাঙ্গের আবরণের প্রথম প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল স্বাভাবিক ঋতুচক্রের সময় ৷ কোন গাছের বাকল, শক্ত চওড়া পাতা, পশুর পাতলা চামড়া দিয়ে একটা আবরণ দিয়ে রাখলে ঐ দিনগুলিতে সারাদিন কাজকর্মের অসুবিধা অনেকটা কম হোত ৷ সেই শুরু_ তারপর তো নানান ইতিহাস!
অন্যান্য পশুর থেকে মানুষ বুদ্ধিমান হলো কেন ? এর উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” ওই যে মানুষ খাড়া সোজা হলো ৷ এর ফলে মেরুদন্ড সম্পূর্ণরূপে Vertical হলো এবং Perinium to Penial – বরাবর শরীরে উৎপন্ন এক বিশেষ অভ্যন্তরীন তড়িৎ শক্তির Charging শুরু হলো ৷ মানুষের চিন্তা যত সৃষ্টিশীল হয়, গভীর হয়–মানুষের শরীরে এই শক্তির ক্রিয়া ততো অধিক হয় । এর ফলে যে মস্তিষ্ক-কোষ গুলি বহুকাল থেকে Dormant বা সুপ্ত ছিল – সেগুলি জাগতে শুরু করে ! মানুষের শরীরের বিবর্তন শেষ হলেও এইভাবেই শুরু হয়েছিল মস্তিষ্ক কোষের বিবর্তন, যার পরিণতি সমাজে বুদ্ধিমান মানুষকুলের আবির্ভাব ।
যাইহোক, মানুষ যেই বুদ্ধিমান হলো – অমনি সে প্রথমেই চাইলো প্রাকৃতিকভাবে যে সমস্ত অসুবিধা তাকে (অন্যান্য পশু-পাখিদের মতো) ভোগ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে – সেখান থেকে বেরিয়ে আসার । সারা শরীর খোলা থাকায় [যদিও প্রথম দিকে মানুষের (বিশেষত পুরুষদের) শরীর লোমশ ছিল, ফলে তাতে শীত কিছুটা আটকাতো] শীতকালে মানুষের খুবই কষ্ট হতো । তারা দাবানলের আগুন নিয়ে এসে তাতে শুকনো কাঠ বা ঘাস জ্বালিয়ে তাপ পোহাতো ! কিন্তু সব সময় আগুনের সামনে বসে থাকলে খাবে কি ? তাই বাইরে বেরোতেই হবে – তখনই প্রয়োজন হয়েছিল সমগ্র শরীরের আবরণের ! বড় বড় গাছের শুকনো পাতা, গাছের বাকল, পশুর চামড়া শরীরে বেঁধে রাখলে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচা যায়, পশুর অতর্কিত আক্রমণে শরীরের দুর্বল অঙ্গগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয় না – এই ভাবেই পোশাক পরার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল । আর– ডেরায় সর্বক্ষন আগুন জ্বালিয়ে রাখলে হিংস্র জন্তুদের হাত থেকেত্ত রেহাই পাওয়া যায়, আবার পশু-পাখীর কাঁচা মাংস ঝলসে নরম করে খাওয়া যায়!তাই আগুন হোল তাদের নিত্যসঙ্গী!!
আদিম মানবসমাজ থেকে কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থায় আসতে দীর্ঘদিন সময় লেগেছিল – হয়তো বেশ কয়েক হাজার বছর ! একদম প্রথমে খুব ছোট ছোট দলে থাকতো আদিম মানুষেরা । তখন পৃথিবী ছিল অখন্ড অর্থাৎ মাঝখানে সমুদ্র ঢুকে পড়ে বিভিন্ন মহাদেশ সৃষ্টি করেনি (অনেক পরে মহাবিশ্বপ্রকৃতির Expansion হয়ে চলার কারণে অথবা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প বা পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ প্লেট-গুলির সরা-নড়ার কারণে বর্তমানের মহাদেশগুলি উদ্ভব হয়েছে) । ফলে একই ভূখণ্ডে বিভিন্ন দলে ঘুরে বেড়াতো সদ্য সৃষ্টি হওয়া মানুষদের পূর্বপুরুষেরা ! আধুনিক জীববিজ্ঞানীরা প্রমান করেছেন যে, মানুষকুলের আদি মাতার বর্ণ ছিল ‘কালো’, এবং অবশ্যই তিনি ছিলেন নির্বসনা ! তাই ভারতীয় প্রাচীন বিজ্ঞানীরা অর্থাৎ ঋষিরা যে ‘মা-কালী’র মূর্তির (মাতৃরূপকে শক্তিরূপিণীও বলা হয় ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” শক্তি সবসময়-ই অনাবৃত – তাই শক্তির কোন আবরণ হয় না ।”) যে রূপদান করে গেছিলেন – এইটা দেখে আধুনিক বিশ্বের জীববিজ্ঞানীরা ‘অবাক’ হয়ে যান । এইসব কারনেই ইউরোপ-আমেরিকার জীববিজ্ঞানীরা এখন আরো বেশি বেশি করে ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রাদি থেকে গবেষণার বিষয় খুঁজে খুঁজে বের করছে !
মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই সমাজব্যবস্থায় শক্তিশালী ব্যক্তি ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির মধ্যে একটা আঁতাত হয়ে গিয়েছিল | শক্তিশালীদের পরিবর্তিত রূপ পরে আমরা যেগুলি পেয়েছি , সেগুলি হোল–দলপতি, সর্দার, জমিদার, রাজা, নবাব, বাদশা, বর্তমানের MLA, MP, নেতা-মন্ত্রী হিসাবে । বুদ্ধিমানরা পরবর্তীতে হয়েছে – পন্ডিত, শিক্ষক, দার্শনিক, মন্ত্রী, মহামন্ত্রী এবং বর্তমান যুগে কবি-সাহিত্যিক-লেখক-ডাক্তার-উকিল-আমলা ইত্যাদি ! কিন্তু বুদ্ধিমান চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকে প্রথম থেকেই বহির্মুখীনতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের অন্তরের গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে ডুব দিয়েছিল । আর রত্নাকরের গভীরে ডুব দিয়ে যেমন ডুবুরিরা মানিক-রতন নিয়ে আসে, ঠিক তেমনি ওই ভোগবাদের জগৎ থেকে সরে এসে ত্যাগ মন্ত্রে দীক্ষিত ওই মানুষগুলিও তাদের নিজ নিজ অন্তর্জগতের গভীর থেকে তুলে আনতে শুরু করেছিল – জ্ঞানভান্ডার রূপ রত্নরাজি ! জীবন রহস্য- জগৎ রহস্য অবগত হোতে থাকল তারা। সৃষ্টি হতে লাগলো শ্রুতি! যেখান থেকে পরে আমরা লিখিত আকারে পেয়েছিলাম _বেদ-বেদান্ত, দর্শন শাস্ত্রাদি !
সেই অন্তর্মুখী মানুষগুলি-ই প্রাচীন ভারতের আচার্য্যগণ এবং ঋষিগণ । জ্ঞানের ধারা অব্যাহত রাখতে, জ্ঞানীগনকে লক্ষ্যে অবিচল রাখতে এবং সাধারণ ভোগসর্বস্ব মানুষকে জীবন ও জগতের রহস্য অবগত করিয়ে তাদেরকেও নিজ নিজ অন্তর্জগতের রত্নরাজির সন্ধান দিতে_এই পৃথিবীগ্রহে শুরু হলো ঈশ্বরের অবতরণ ! কখনও ঈশ্বরের দূত, কখনও ঈশ্বরের বন্ধু, কখনো ঈশ্বরের অবতার বা তাঁর পার্ষদ হয়ে, ঈশ্বর স্বয়ং শক্তিশালী মানুষরপে- মানুষের শরীরে অবতরণ করেন – আর মানবের এবং মানব সমাজের বিবর্তনের অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখেন ।। ….. [ক্রমশঃ]