গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ গিরি যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন – তখনকার কিছু কিছু কথা এখানে সবার সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল ! গুরু মহারাজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন কেন ? সাধারণ মানুষ যেমন এদেশ ওদেশ যায় হয় ভ্রমণ করতে অথবা শিক্ষা গ্রহণ করতে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে – গুরু মহারাজের বিদেশ যাত্রা তো তেমনটা ছিল না ! উনি বিদেশে গিয়েছিলেন আচার্য হিসাবে! ভারতবর্ষের প্রাচীন পরম্পরাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে! প্রকৃতপক্ষে গুরুমহারাজের প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে Divine Plan কাজ করতো ! তিনি কোথায় যাবেন – কোথায় যাবেন না , কাকে কখন কতটুকু কথা বলবেন – কারোকে হয়তো সেসব কথা বলা যাবে না – ইত্যাদি সবই পূর্বনির্দিষ্ট ছিল ! উনি বারবার একটা কথা ব্যবহার করতেন – “আমি তো ঝড়ের মুখে পড়া শুকনো পাতা – ঝড় যখন যেমন আমাকে নিয়ে যায় – আমি সেই রকমই চলি ৷”
গুরু মহারাজের নামের শেষে ‘গিরি’ কথাটি রয়েছে দেখে আমাদের মধ্যে অনেকের মনে হতেই পারে যে তিনি আচার্য শঙ্কর প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়ের ‘গিরি’ পরম্পরার একজন সাধু ছিলেন! কথাটি নিশ্চয়ই সত্য , কিন্তু গুরু মহারাজের ক্ষেত্রে তো কোন সাধারণ নিয়মই খাটে না – এক্ষেত্রেই তাই ঐ নিয়ম খাটবে না ! আজ ইউরোপের আলোচনা থাক্, আজকে একটু এই ব্যাপারেই আলোচনা হোক !
গুরু মহারাজ নিজে এই ব্যাপারে যা বলেছিলেন তা হ’ল – ” এই শরীরে আমার সন্ন্যাস নেবার বা গেরুয়া পড়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না – কারণ ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় ঘুরে বেরিয়ে আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেকধারী , মালাচন্দন ধারী , বিভিন্ন বিচিত্র বর্ণের পোষাকধারীদেরকে খুব কাছ থেকে দেখেছি ! কিন্তু এদের বেশির ভাগের মধ্যেই দেখেছি __তাদের জীবনচর্যায় লক্ষ্যের চাইতে উপলক্ষ্য বড় হয়ে বসে আছে ! ফলে যে উদ্দেশ্য বা আদর্শ নিয়ে তারা একদিন আধ্যাত্মজগতে প্রবেশ করেছিল – সেখান থেকে সরতে সরতে তারা বহু দূরে চলে গেছে! ৪০ বছর , ৫০ বছর সন্ন্যাস জীবন-যাপন করছে, রমতা সাধু – ঘরবাড়ি , আশ্রম-কুঠিয়ার বন্ধনও ত্যাগ করেছে , __তবু সন্ধ্যার সময় দেখেছি ওরা কোন দেবালয়ে বা গাছতলায় চিমটির অধিকার নিয়ে , ধুনির জায়গার অধিকার নিয়ে , দুটি রুটির অধিকার নিয়ে পরস্পরে ঝগড়া করছে – মারপিট করছে, সম্প্রদায় আলাদা বলে একে অপরকে ঘৃণা করছে , ‘নিজে সন্ন্যাসী’- এই বড়াই করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে “নরকের কীট”- বলে সম্মোধন করছে !
হরিদ্বার-হৃষিকেশ অঞ্চলের একজন নামকরা সাধু এবং মন্ডলেশ্বরের বক্তব্য আমি নিজে শুনেছি , যিনি জনগণকে সম্মোধন করতেন – “প্রাণী মাত্র !” বলে ৷ ভাবো তো একবার ! মানুষের প্রতি ঐ মন্ডলেশ্বরের কি ধারণা _কি মুল্যায়ন!! আধ্যাত্মিক বিচারে এরা চেতনায় অনেক নিম্নস্থিতিতে রয়েছে!!
অথচ বৃন্দাবনে স্বামী যাদবানন্দের কাছে যখন গেলাম , তখন দেখলাম ওনার ছোট কুঠিয়া , আবরণ-আভরণের কোন আড়ম্বর নাই , শুধুমাত্র এক টুকরো সাদা পোষাক পড়নে রয়েছে কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্য যেন ঝলমল করছে!! এত `প্রেম`- যেন ধরে রাখতে পারছেন না, বাইরে বেরিয়ে আসছে ! কুঠিয়ার ভিতরে যে বিগ্রহ মূর্তিগুলি ছিল – তাঁদেরকে তাঁর অন্তরের ঐশ্বর্য দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন ! সর্বদা তাঁদেরকে নিয়েই রয়েছেন – তাঁদের সাথে কথা বলছেন , খাওয়াচ্ছেন , ঘুম পাড়াচ্ছেন ! তাঁদের সুখে সুখী হচ্ছেন – তাঁদের খুনসুটিতে বিরক্ত হচ্ছেন !”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” আমার তখন ছোট বয়েস ! বৃন্দাবনে ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় আশ্রমে (যেখানে অনেক ঐশ্বর্য , অনেক লোক , অনেক খাবার-দাবার) গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে খেতে বা থাকতে দিল না – তাড়িয়ে দিল ! সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে যমুনার দিকে হাঁটছি – পথের পাশেই ঐ কুঠিয়া থেকে (বন্ধ দরজা) কথোপকথনের আওয়াজ আসছিল ! কেউ যেন ঘরের মধ্যে তার অতি আদরের শিশু পুত্র-কন্যাদের স্নেহপূর্ণ শাসন করছেন , বকাবকি করছেন , আবার কিছু খাওয়ার জন্য অনুযোগ করছেন !! আমি একটুখানি সময় ওনার দরজার সামনে দাঁড়াতেই _বোধহয় উনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন! হটাৎ করে সাধুবাবা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে ভেতরে যাবার অনুমতি দিলেন ! ওনার সাথে ঐ ঘরে আমি ৭/৮ দিন ছিলাম – দেখেছিলাম ওনার প্রেমে ওই ঘরে থাকা বিগ্রহগুলি সব জীবন্ত হয়ে উঠেছে ! সত্যি সত্যিই এটা আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম।”
যাইহোক, কি কথা বলতে গিয়ে কি প্রসঙ্গ চলে এলো ! মোদ্দা কথা হল এই যে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা বা উন্নত মহাপুরুষেরা কখনোই কোনো বাহ্য আড়ম্বরে বা কোন নিয়মের নিগড়ে নিজেদেরকে আবদ্ধ রাখেন নি ! তাই গুরু মহারাজেরও এই ব্যাপারে কোন উৎসাহ ছিল না যে ওনাকে ‘ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে’ , ‘সন্ন্যাস নিতে হবে’ – ইত্যাদি ! কিন্তু একদিন নৌকাযোগে বেলুড় মঠ থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার পথে (অথবা উল্টোটা !) ওনার স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন হয়েছিল ! উনি দেখেছিলেন যে সামনের গঙ্গাটা গেরুয়ার সমুদ্রে পরিণত হয়ে গেল এবং সেই সাগর থেকে এক একটা গেরুয়ার তরঙ্গ উঠে আসছে এবং তারা সেই সাগরেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে ! এদের এক-একটি এক একজন মহাপুরুষের রূপ পরিগ্রহ করছিল ! তারপর উনি দেখেছিলেন – তরঙ্গ থেকে উত্থিত হয়েছিল গেরুয়া পোষাক পরিহিত স্বামী বিবেকানন্দের বিরাট রূপ ! উনি সেই রূপের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই _সেই বিরাট রূপ, ছোট হতে শুরু করেছিল এবং উনি দেখেছিলেন যে ওনার শরীরটা তখন ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করেছিল! তারপর স্বামীজীর শরীর ওনার শরীরে মিশে গিয়েছিল। আর এটা হবার সাথে সাথেই গেরুয়ার সমুদ্র vanish!!
এই সকল ঘটনা ঘটার সময়ে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে গুরুমহারাজের কিছু কথোপকথনও হয়েছিল। স্বামীজী গুরুমহারাজকে গেরুয়ার প্রতি অনীহা ত্যাগ করে _গেরুয়া পোষাক গ্রহন করতে বলেছিলেন। এরপরেই গুরুমহারাজ হিমালয়ের উত্তরকাশীতে গিয়ে ওনার পূর্বনির্দিষ্ট গুরু রামানন্দ অবধূতের কাছে সন্ন্যাস গ্রহন করেন! রামানন্দজী যখন ওনাকে দীক্ষা দেন _তখন অবধূতজীর আনুমানিক বয়স ছিল ১৫০-বছর! রামানন্দজীর নির্দেশেই গুরুমহারাজ ঋষিকেশের কৈলাস আশ্রমে বিদ্যানন্দ গিরি মহারাজের কাছ থেকে সন্ন্যাস-সংস্কার(শাশ্ত্রোক্ত বিধিবৎ ক্রিয়াদি) করেছিলেন। আর এইজন্যেই গুরুমহারাজর সন্ন্যাস নাম হয়েছিল স্বামী পরমানন্দ গিরি! (ক্রমশঃ)