গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল ৷ বিভিন্ন সময়ে _শক্তিতে উন্মত্ত মানুষজনেরা, শাসকেরা সাধুসন্তদেরকে যুগে যুগে মেরে ফেলেছে । গুরুমহারাজ অবশ্য বলেছিলেন – সাধুরাই তো মরবে ! কারণ তারা যে নির্ভীক – তারাই তো প্রকৃত বীর ! লজ্জা-মান-ভয়-কুল-শীল ইত্যাদি অষ্টপাশ মুক্ত হবার জন্যই সাধনা ! সাধনা করেন – ইষ্টকে সাধেন – তাইতো তিনি সাধু ! সাধুর জীবন তো ধূপের মতো – শুধু পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে সমাজের জন্য – সংসারের জন্য সুগন্ধ ছড়িয়ে দেওয়া ! সুতরাং সমাজকল্যাণের জন্য বা মানব কল্যাণের জন্য সবার প্রথমে সাধুই তো এগিয়ে আসবে ! যদি প্রাণ দেবার প্রয়োজন হয় – তাহলে সাধুই তো আগে প্রাণ দেবে । আর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে এটাই হয়ে এসেছে ৷ এইভাবেই আর্কিমিডিস, সক্রেটিস, গ্যালিলিও (এনারা দার্শনিক বা পন্ডিত হলেও এরা সাধু-ব্যক্তিই ছিলেন) প্রমুখ কত সাধু-ব্যক্তি যে শাসকের রোষানলে প্রাণ দিয়েছেন – তার ঠিক নাই !
আগের দিন যে দারাশুকোর সুফীগুরুর নিধনের কথা বলা হচ্ছিল – সেদিনকার ঘটনা আনুপূর্বিক বলেছিলেন গুরুমহারাজ ! তখন দারাশুকো, সুজা এবং মুরাদ এই তিন ভাইকে হত্যা করা সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল আওরঙ্গজেবের ! পিতা শাহজাহান এবং দিদি জাহানারাকে প্রাসাদের চিলেকোঠা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়ে গেছিল – যাতে করে দিল্লি-আগ্রার অতিরিক্ত গরমে তাদের‌ও নিশ্চিত মৃত্যু হয়।ফলে নিশ্চিন্ত হয়ে মনের আনন্দে সেদিন আওরঙ্গজেব মন্ত্রী-সেনাপতিদের নিয়ে দিল্লির রাজপথে বেরিয়েছিলেন একটু ফুরফুরে হাওয়া খেতে – আর প্রজাদের কাছে নিজেকে সম্রাট হিসাবে জাহির করতে !
কিন্তু সেদিনকার সমস্ত আনন্দে বাদ সেধেছিল ওই গুরুদেব সুফী-সাধক । তিনি শিষ্য দারাশুকোকে নৃশংস ভাবে মরতে দেখে খুবই দুঃখিত ছিলেন । তিনি জানতেন বাদশা আওরঙ্গজেব সেদিন ওই পথ ধরেই সেপাই-সান্ত্রী-মন্ত্রী-পরিষদের নিয়ে বিজয় মিছিল করতে বেরোবে ! তাই উনি ওই রাজপথের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন । হঠাৎ করে কনভয় দাঁড়িয়ে যাওয়ায় – ক্ষুব্ধ আরঙ্গজেব মন্ত্রীদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন – যে একজন ফকির বা সাধু রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হা – হা করে হাসছে, আর সম্রাটের উদ্দেশ্যে কিছু বলছে ! আওরঙ্গজেব শকট থেকে নেমে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই সাধুর ! কিন্তু তাঁর জ্বলন্ত চোখের চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারেননি – চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন । আর ওই ফকিরবাবা হা – হা করে হাসতে হাসতে আওরঙ্গজেবকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – ” এই লোকটা একটা মূর্খ ! ও নিজের ভালোটাও বোঝে না !” সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের চোখের দৃষ্টি একটু কুঁচকে গিয়েছিল – ওটাই ছিল সংকেত এবং যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল – সাধুর তাজা রক্তে দিল্লির রাজপথ রাঙা হয়ে ওঠা !
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – কোন কোন ঘটনায় মহাপ্রকৃতিও কেঁপে ওঠেন ! আর সেই প্রতিক্রিয়ায় জগতে বিশাল বিশাল ঘটনা ঘটে যায় – অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটে যায় মহাকালের বুকে ! যে ঘটনাটা হয়তো পড়ে ঘটতো – সেটার সময় এগিয়ে আসে বা হয়ত তাৎক্ষণিক ঘটে যায় ৷ … [ক্রমশঃ]