গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ইউরোপীয়দের ভারতে আগমন নিয়ে বলেছিলেন,_ “ওটা হয়েছিল মহাবিশ্ব প্রকৃতির ইচ্ছায়”! ভারতবর্ষে বহুকাল থেকেই বহিরাগতরা লুটপাট অত্যাচার করেছে, এদের মধ্যে দরায়ুস- সাইরাস ইত্যাদিরা আলেকজান্ডারের‌ও আগের আক্রমণকারী!গুরু মহারাজের কাছে শুনেছিলাম,_ মহাভারতে উল্লেখিত “নিবাত কবচ” (বা নেবুকান্নেজার), কালযবন(যবন_কথাটি গ্রিক ইউনান বা শুভ্র থেকে এসেছে) প্রভৃতি রাও বহিরাগত আক্রমণকারী ছিল। মুসলমানদের সঙ্গে ইউরোপীয় বণিকদের তুলনা টানতে গিয়ে গুরুমহারাজ বলেছিলেন_ “ইউরোপীয়রা ভারতের যা কিছু সম্পদ এমনকি পুঁথিপত্র, প্রাচীন গ্রন্থাদি জাহাজ ভর্তি করে নিজের দেশের নিয়ে গিয়েছিল। ফলে সেগুলো বিশ্ব থেকে হারিয়ে যায় নি,সেগুলোর utilisation হয়েছে বা আজো হচ্ছে(শত শত স্কলার ঐ পুঁথিপত্র গুলি নিয়ে গবেষণা করছে)! আর মুসলমানরা এদেশের মন্দির, স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল_প্রাচীন পুঁথিপত্র বা গ্রন্থ গুলিকে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল!
ইতিহাসে রয়েছে নালন্দা এবং রাজগৃহের গ্রন্থাগারগুলিতে এত সহস্র সহস্র গ্রন্থ ছিল যে,শত শত খলজী সৈন্যরা বর্ষার সময় তিন মাস ধরে এগুলি কে পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাদের খাদ্য রান্না করেছিল! এইভাবে ওরা শুধু ভারতবর্ষের‌ই নয়_সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির এক বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার নষ্ট করেছিল !
ইসলামীয়দের ধর্মান্তরকরণের কথাও আগেরদিন হয়েছিল। ইউরোপীয়রাও অবশ্য এ ব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না! কিন্তু সেই সময় রামমোহনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সর্ববিধ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল (একে নবজাগরণের সূচনাও বলা হয়)!ইংরেজি শিক্ষা চালুর ব্যাপারে রামমোহনের উদ্যোগকে বহু বাধা বিঘ্নের পর হিন্দু সমাজের বেশিরভাগ অংশ গ্রহণ করলেও_ মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিয়ে এটাকে একেবারেই গ্রহণ করেনি! ফলে ওই সমাজের আজও পর্যন্ত আধুনিক শিক্ষার যে পশ্চাৎগতি__ তার এটাই ছিল প্রধান কারণ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন_ “রামমোহন যখন পৌত্তলিকতা বিরোধী ব্রাহ্মধর্মের প্রচলন করলো, তখন ইংরেজরা খুবই খুশি হয়েছিল! ওরা ভেবেছিল _পৌত্তলিকতা বিরোধী, নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা অনেকটাই খ্রিস্ট ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে মেলে! তাই ব্রাহ্ম ধর্মীয়রা বীজ বপন করে শস্য লাগাক, আমরা কর্তন করবো”! অর্থাৎ “সমস্ত ভারতবাসী ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হয়ে গেলে আমরা গিয়ে সেখানে যিশুখ্রিস্টের স্টাম্প মেরে দেবো”। কিন্তু সবার সব সাধের বাদ সাধল _আট হাত ধুতি পড়া গ্রাম্য, অশিক্ষিত, কৈবর্তদের কালীবাড়ির পুরোহিত_ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ!শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ একবার শরীর ধারণ করে সামগ্রিক ভাবে ধর্মান্তকরণের হাত থেকে পূর্ব ভারতকে রক্ষা করেছিলেন, আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ খ্রীষ্টীয়দের হাত থেকে আর একবার সনাতন ধর্মকে রক্ষা করলেন_পুরো ব্রাহ্ম movement-টাকে ভেঙে দিয়ে!
ভারতের নবজাগরণের সূচনা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পর্যন্ত সমস্ত কর্মকান্ডের পুরোভাগে ছিল বাংলা_কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবার পর থেকেই তৎকালীন নেতৃত্বের___ বাঙালিদেরকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। এই ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের হাত ধরে ভারতবর্ষে বামপন্থা ঢুকে পড়ে (যদিও ভারতীয় বামপন্থীদের কাছে মানবেন্দ্রনাথ ব্রাত্য হয়ে রয়ে গিয়েছেন)। নেতাজীর প্রতি চরম অন্যায় _বাঙালিদের কে আরো বেশি করে বামপন্থী করে তুলেছিল।
কিন্তু _”এ নেশা কি যে নেশা”! গুরু মহারাজকে একজন বলেছিল _” জানেন তো কার্ল মার্ক্স বলেছে _ধর্ম হোল আফিমের নেশা!” গুরু মহারাজ উত্তরে বলেছিলেন _” তাহলে মার্ক্সপন্থী হ‌ওয়াটা হেরোইনের নেশা”!
পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি_গুরুমহারাজের কথার যথার্থ রূপ! সমগ্র body-র সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে, শুধু skeleton-টা পড়ে আছে_ সেইটাকেই নিয়েই চিনের গৌরবে ভারতীয় বামেদের (বিশেষত বাঙালি!) *বাম* দিকটা _চিন্ চিন্_ করেই চলেছে!!
গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল_ভারতবর্ষের বেদ-বেদান্তের মহান শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা অন্য ধর্মমত গ্রহন‌ই বা করল কেন এবং বিদেশি দর্শনকেই বা মেনে নিল কেন?
উত্তরে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ব্রাহ্মন্যবাদের বাড়াবাড়িতে বেদ-বেদান্তের জ্ঞান লাভের সুযোগ থেকে দেশের অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত ছিল! বরং উচ্চবর্ণের অত্যাচারে তারা চরম বিরক্ত হয়ে
ছিল_তাই বিকল্প যা পেয়েছে,তাকেই আঁকড়ে ধরেছিল!
গুরু মহারাজকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল–“কিন্তু এখন? এখন তো সবকিছুই open to all–তাহলে ধর্মীয় গোঁড়াপন্থীরা অথবা বামপন্থীরা সনাতন চিন্তাধারার মূলস্রোতে ফিরে আসছে না কেন?
উনি একটা গল্পের মাধ্যমে এর উত্তর দিয়েছিলেন! গল্পটা হোল —
একবার একটা গুবরে পোকার সাথে একটা ভ্রমরের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল ৷ উভয়েই কালো রঙের, আর প্রায় অনেকটা একইরকম দেখতে! ভ্রমর পদ্মবনে পদ্মমধু খেয়ে আসে আর গুবরে পোকা সবসময় গোবর খেয়ে মরে! প্রতিদিন গুবরে পোকার গোবর খাওয়া দেখে ভ্রমরের মনে খুব কষ্ট হয় ৷ মনে ভাবে – ” হায় ! যদি আমি আমার বন্ধু ঐ গুবরে পোকাকে পদ্মমধু খাওয়াতে পারতাম !”
এরপর থেকে প্রায়ই ভ্রমর গুবরে পোকাকে ওর সাথে পদ্মবনে যাওয়ার জন্য বলে, যাতে করে সেও একটু পদ্মমধু খেতে পারে – কিন্তু গুবরে পোকা রাজী হয় না, নানা বাহানায় এড়িয়ে যায় !
এইভাবে বলতে বলতে একদিন গুবরে পোকা ভ্রমরের সাথে পদ্মবনে যেতে রাজী হয়ে যায় ৷ সেখানে গিয়ে ভ্রমর অন্যান্য ভ্রমরদের সাথে পদ্মফুলের মধু পান করতে শুরু করল, আর বন্ধু গুবরে পোকাকেও একটা সদ্য ফোটা ফুল দেখিয়ে তার মধু পান করতে বলল । খানিকক্ষণ এফুলে ওফুলে মধু পান করার পর ভ্রমর ভাবল_ একটু বন্ধুর খবর নেওয়া যাক্! বন্ধুর দিকে তাকাতেই সে দেখে যে, গুবরে পোকা ব্যাজার মুখে এক জায়গায় বসে আছে!
ভ্রমর তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল – ” কি ব্যাপার বন্ধু ! পদ্মমধুর Taste তোমার ভাল লাগছে না ? কেমন আস্বাদ বুঝলে ?” ব্যাজার মুখে গুবরে পোকা বলল – ” কই আর আলাদা আস্বাদ ! এ তো গোবরের মতোই !” ভ্রমর অবাক হোল — “কি!পদ্মমধুর Taste গোবরের মতো?” সে গুবরে পোকার কাছে এগিয়ে এসে তাকে বলল – ” এই তোমার মুখটা হাঁ করো তো ! দেখি, তোমার মুখে কি আছে ?”
গুবরে পোকা মুখ হাঁ করতেই দেখা গেল গুবরে পোকার মুখের ভেতরে জিভের তলায় একদলা গোবর ভরা! ভ্রমর তাকে জলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল – ” আগে ‘ওয়াক্ থু’ করো ! তারপর মুখে জল নিয়ে কুলকুচি করে মুখটা পরিষ্কার করে নাও ৷ এবার পদ্মমধু খাও – দ্যাখো তো মধুর Taste পাও কিনা ?” গুবরে পোকা বন্ধুর কথা পালন করল! এরপর মধুর Taste পেয়ে সে ধন্য হোল।
তাই যে কোন গোঁড়ামি (ধর্মীয় বা রাজনৈতিক)_মানুষ যদি অন্তরে পুরে রাখে_তাহলে ঋষিদের উপলব্ধ সত্যের বোধ হবে কি করে? আগে মুখের ভিতরে থাকা গোবর টাকে “ওয়াক্ থু”_করতেই হবে!!