গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ__ স্বামী বিবেকানন্দের কথা উল্লেখ করে প্রায়ই বলতেন _”গতিশীলতাই জীবন- স্থিতিশীলতাই মৃত্যু”! কোন ব্যক্তি, কোন দল, কোন সমাজ, কোন জাতি, কোন দেশ যখনই কোন আদর্শে-কোন শিক্ষায়-কোন সংস্কারে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে বেঁধে আটকে পড়ে __সঙ্গে সঙ্গেই জানতে হবে তার মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে! এইবার ওই “শবদেহ” সমাজে যতদিন থাকবে _ ততদিন শুধু দুর্গন্ধ‌ই ছড়াবে এবং ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটাবে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ 100 বছর আগে বলেছিলেন, “আমার মতটাই সবচাইতে ভালো, আর বাকিদের টা খারাপ _এই মত ভালো নয়! সবাই ভাবে তার ঘড়িটাই ঠিক চলছে কিন্তু মাঝে মাঝে সূর্য-ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিতে হয়”! দেখেছেন _অধ্যাত্মবিজ্ঞানী যুগপুরুষের বিধান!
গুরুদেব স্বামী পরমানন্দ‌ও বলেছিলেন, _”বদ্ধ জায়গায় জল দীর্ঘদিন একই ভাবে থাকলে পচে যায়, দুর্গন্ধ যুক্ত হয়, তাতে পোকা কিলবিল করে এবং সেখানে বিভিন্ন রোগের বাহক তৈরি হয়। কিন্তু স্রোতস্বিনীর জল গতিশীল হ‌ওয়ায় কখনোই এমনটা হয় না” ! “সম্ভবামি যুগে যুগে” কথাটির মূল্য কি এখনো পৃথিবী গ্রহের মানুষ দিতে পারবে?
ভারতীয় শাশ্ত্রাদিতে রয়েছে, যে কোন বস্তুর 6 টি অবস্থা প্রাক-উৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় এবং লয়! জীববিজ্ঞানে রয়েছে_ বিবর্তনের ধারায় এককোষী থেকে বহুকোষী হয়ে উন্নততর প্রাণীতে শরীর গ্রহণের জন্য এগিয়ে যাওয়া! শুক্রাণু- ডিম্বাণু -জাইগোট- গর্ভাবস্থা- শৈশব -শৈশব- কৈশোর- যৌবন -প্রৌঢ়ত্ব- বার্ধক্য- মৃত্যু_ শুধু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উত্তরণ! তাছাড়াও জীবনে রয়েছে চেতনার উৎক্রমণ, বুদ্ধির উপযোগিতা এবং জ্ঞানের উৎকর্ষতা ! সর্বত্র শুধুই গতি, গতি এবং গতি! পৃথিবী গতিশীল_ সূর্য গতিশীল_ সমগ্র নক্ষত্রমন্ডল গতিশীল_ শুধুই গতি! গুরু মহারাজ বলেছিলেন,_ “এই মহাবিশ্বের অমোঘ নিয়ম গতিশীলতা_ এগিয়ে চলা”! সেই গতিশীলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে যে না পারছে_ সে মহাবিশ্ব প্রকৃতির নিয়মের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ হয়ে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আরো অনেকের গতিকে স্তব্ধ করার কারণ হচ্ছে!
পুরাণাদি শাস্ত্রে দেবাসুরের সংগ্রামের কথা রয়েছে_ শুভ-শক্তির সাথে অশুভ-শক্তির লড়াই! যুগে যুগে এই সংগ্রাম-ই হয়ে চলেছে! আর_ চলবেও এখনো বহুকাল! কারণ এই সংগ্রাম যে জীবের অন্তর্জগতে রয়েছে_ শুধু মাঝে মাঝে বাইরে প্রকাশিত হয় এইমাত্র! পুরাণে লেখা আছে দৈত্য, দানব, রাক্ষস, অসুরেরা বার বার স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিয়েছে এবং দেবতাদের বনে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিয়েছে।যে ঋষিরা একান্তে তপোবনে বসে বিশ্ববাসী সকলের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করছেন_”সর্বে ভবন্তু সূখীন_সর্বে সন্তু নিরাময়া…!” বড় বড় খাঁড়ার মত অস্ত্র নিয়ে দানবেরা সেখানেও গিয়ে হাজির হয়ে তপোবন তছনছ করে_ যজ্ঞবেদী চুরমার করে_ ঋষিদের শরীরের রক্ত, “কর” হিসাবে আদায় করে নিয়ে চলে যাচ্ছে!
তাহলে আজকের সমাজ চিত্র আর নতুন কোথায়?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~`~~`
গুরুজীর নিজের লেখা:—
_____________________
প্রিয় আত্মন,
মুসলমান হইলে যদি খোদার অনুভূতি হয় , খ্রিষ্টান হইলে যদি God- এর অনুভূতি হয় , হিন্দু হইলে যদি পরমেশ্বর-এর অনুভূতি হয় কিংবা বৌদ্ধ হইলে যদি পরম নির্বাণ লাভ হয় , তাহা হইলে আমি তাহাই হইতে রাজী। আমি তো ঐ পরম সত্য স্বরূপ পরমেশ্বর-এর অনুভূতির কাঙাল। বাদ বা বিবাদ করিবার অবকাশ কোথায় ! আমি বাদ বিতন্ডার কবলে পড়িতে চাহি না, আমি চাই সেই পরমতত্ত্বের উপলব্ধি। যেখানে সমস্ত বাদের পরিসমাপ্তি হয় – যেখানে পরম বোধের উপলব্ধি হয়- আমি সেখানে যাইতে চাই। সেইজন্য আমি করজোড়ে প্রার্থনা করি–” হে পরমেশ্বর! আমাকে এমন স্থানে নিয়ে চল- যেখানে সাম্প্রদায়িক চেতনা, গোষ্ঠীচেতনা এবং মতবাদ নিয়ে কোন বিরোধ নাই এবং বাদবিবাদ ও স্বার্থবুদ্ধির কোন স্থান নেই। যে পরমেশ্বর, যেখানে শুধু তোমার উপলব্ধি বিদ্যমান এবং সেখানে শুধু তুমিই বিরাজমান।”
বাদ সমস্ত বিবাদের মূলে। জগতে যত রকমের দুর্ঘটনা, বিবাদ ও সংঘর্ষ- তাহাদের মূলে ঐ বাদ। কোন বাদকে ভিত্তি করিয়া হয় রাষ্ট্রবিপ্লব, আবার আসে নুতন বাদ। বাদের বিরুদ্ধে হয় সংঘর্ষ- বিনষ্ট হয় বাদ, আবার নুতন কোন বাদের অভ্যুদয় ঘটে। এইভাবে বাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়,কারন মানব হীন-স্বার্থবুদ্ধিতে বাদগ্রস্ত বা আচ্ছন্ন।যতদিন না মানব স্বার্থবুদ্ধি ত্যাগ করিয়া সহজ হইতেছে, ততদিন মানবের বাদগ্রস্ততার পরিসমাপ্তি হইবে না।সেই হেতু মানবকে সর্বপ্রথম সহজ হইতে হইবে এবং সমস্ত বাদের উর্ধ্বে পরম বোধকে অনুভব করিতে হইবে।
প্রিয় আত্মন, প্রত্যেকটি মানবের মধ্যে রহিয়াছে সমুন্নত হইবার ও দেবত্ব লাভের সম্ভাবনা। সুতরাং কোন মানবই হেয় বা অবজ্ঞার পাত্র নয়। মানবকে হীন বা তুচ্ছ বলিয়া উপেক্ষা করা মোটেই সমীচীন নয়। মানব-মহান, পরমাত্মার প্ৰকাশ।
মানব মহাপুষদের অনুসরণ করিয়া মহাপুষদের সমকক্ষ হউক। মানবের ক্রোমোন্নতির ধারা বলিষ্ঠ হউক , মানবের আত্মভাব প্রতিষ্ঠা হউক- ইহাই আমার একান্ত ইচ্ছা।