গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – ” মানুষের মৃত্যুতে ব্যথিত হইনি, ব্যথিত হয়েছি মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে।” ঠিকই তো বলেছিলেন উনি– জন্ম এবং মৃত্যু তো ধ্রুব ! যে মুহূর্তে কোনো কিছুর জন্ম বা সৃষ্টি হচ্ছে – সেই মুহুর্তেই তার মৃত্যু নির্ধারিত হয়েই রয়েছে ! – সুতরাং কোন জ্ঞানী ব্যক্তি কেন-ই বা কোন মৃত্যুতে ব্যথিত হবেন ?
কিন্তু গুরুমহারাজ মনুষত্বের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়েছেন – সাধারণ মানুষ যখন কাউকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলছে – তাতেও গুরুমহারাজ ব্যথিত নন – কারণ সেই সব মানুষের মধ্যে এখনো মনুষ্যত্বের বোধ জাগ্রত-ই হয়নি । স্বামী বিবেকানন্দ-ও একবার চিঠিতে এক গুরুভাইকে দুঃখ করে লিখেছিলেন – “মানুষ কি আর মানুষ আছে রে বাপ!” মানুষের মধ্যে মনুষ্যসুলভ যে সমস্ত গুণ অর্থাৎ দয়া-মায়া-করুনা-স্নেহ-মমতা-প্রেম-ভালোবাসা-সহানুভূতি-সহযোগিতা-সহমর্মীতা ইত্যাদি না থাকলে সেই ব্যক্তি মানুষশরীর লাভ করলেও, জানতে হবে_সে এখনো ঠিক ঠিক “মনুষ্য” পদবাচ্য হয়ে ওঠেনি !
ব্যাপারটা কি – একটু বুঝিয়ে বলা যাক ! ৮৪ লক্ষ যোনি অতিক্রম করতে হয় জীবকে, তবে তার Life-cycle সম্পূর্ণ হয় । এর মধ্যে ৮০ লক্ষ বার মনুষ্যেতররূপে (উদ্ভিদজ, স্বেদজ, অন্ডজ, জরায়ুজ এই চার প্রকার প্রজাতিতে কুড়ি লক্ষ করে –> ৪x২০=৮০ লক্ষ এবং ৪ লক্ষ বার নর-বানর রূপে!) ! এবার বিবর্তনে যে বা যারা প্রথম প্রথম মনুষ্য শরীর লাভ করেছে, তার মধ্যে উপরিউক্ত মানবিক গুণ সমূহ প্রকাশ পায় না – তার মধ্যে পূর্ব পূর্ব পশু-পাখি শরীরের সংস্কারসমূহ-ই অধিক ক্রিয়াশীল থাকে – তাই ওই সমস্ত মানুষের আচার-আচরণ, রুচি, স্বভাব, কাজকর্মে আমরা কখনোই প্রকৃতপক্ষে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা কোন ব্যক্তির ন্যায় আচরণ আশাই করতে পারি না । এইজন্যেই অর্থাৎ এই নিম্নচেতনার মানুষ বা সদ্য সদ্য মানবশরীরে আসা মানুষগুলির জন্যই প্রয়োজন হয় মহাপুরুষদের আগমন – যাঁরা টেনে টেনে এই মানুষগুলির নিম্নমুখী মানসিকতাকে টেনে টেনে ঊর্ধ্বমুখে তোলার চেষ্টা করে যান ৷ এদের জন্যই প্রয়োজন হয় আইন-আদালত, থানা-পুলিশ-শাস্তির ! যা সাময়িকভাবে হলেও নিন্মচেতনার মানুষকে কিছুটা শান্ত রাখতে সাহায্য করে !
কিন্তু মুশকিলটা হল – আইন-আদালতের লোকজন, প্রশাসনের লোকজন, রাজনীতির লোকজনেরাই যদি নিম্ন চেতনার হয় – তাহলে কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে ? গুরুমহারাজ এই নিম্নচেতন-মাঝারিচেতন আর উচ্চচেতনা সম্পন্ন মানুষদেরকে বোঝাতেই (তমঃ, রজঃ ও সত্ত্বগুণের কথা বলেছিলেন) তামসিক, রাজসিক ও স্বাত্ত্বিকগুণ সম্পন্ন মানুষদের কথা বলতেন । এখানেই মনুষ্য সমাজে Junior-Senior -এর Concept -টা কার্যকরী ৷
প্রাচীনকালের ভারতীয় সমাজের চিত্র কল্পনার চোখে দেখলে দেখা যায় যে, দেশের রাজা কোন ঋষির পদপ্রান্তে বসে তার নিজস্ব চেতনার উন্নতির সাথে সাথে প্রজাপালনের পাঠ শিখছে এবং সেগুলির বাস্তব প্রয়োগ ঘটাচ্ছে ! সাম্প্রতিককালে মারাঠার শিবাজীর গুরু রামদাস সমর্থের কার্যকারিতা দেখলেও ঋষিদের সময়কার চিত্র অনেকটা বোঝা যায় ।
কিন্তু সমাজের বিবর্তনে পেশিশক্তি, রাজনৈতিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি প্রধান হওয়ায় – ব্রাহ্মণ্য শক্তির অর্থাৎ ত্যাগ,সাধনা, সংযমের দ্বারা আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মানবদের নানাভাবে হেনস্থা করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে – ফলে পৌরাণিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন অর্থাৎ দেবতা-ঋষি-মুনিরা বনেজঙ্গলে বিতাড়িত আর অসুরেরা-দৈত্যেরা সমাজ শাসন করে যাচ্ছে ! যার ফল আজকের গোটা পৃথিবীর মানবসমাজ চরমভাবে ভুগছে! কেউ ভালো নাই – কোথাও শান্তি নাই – সবাই চরম অশান্তিতে রয়েছে, চরম সংকটে রয়েছে, কিন্তু নিজের নিজের ‘গোঁ’ ধরে পড়ে রয়েছে ! এটাই চরম অাহাম্মকি ! এটাই বর্তমান মানব সভ্যতাকে একেবারে প্রায় ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে ৷ যে কোনো সময় এই সাজানো গোছানো বর্তমানের মানবসভ্যতা ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে ৷ বড় বড় শহর-নগর-উন্নতির গৌরব, শক্তির উন্মত্ততা যে কোনো সময় স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে_পাতালে তলিয়ে যেতে পারে !
ছাপোষা-শান্ত-লাজুক স্বভাবের দেখতে সাধারণ অথচ হাড়বজ্জাত শিক্ষিত মানুষরা কেমন যেন এই নির্ঘাত মৃত্যু থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছে, অথবা কোনও না কোনও -ism কে আঁকড়ে ধরে সেটাকেই অবলম্বন করে বেঁচে থাকার একটা দুর্বল প্রয়াস করে যাচ্ছে – এটাকেই গুরুমহারাজ “মনুষ্যত্বের মৃত্যু” বলে বোঝাতে চেয়েছেন !
যারা মানুষ হয়ে ওঠেনি – তারা অমানবোচিত কাজ তো করবেই ! কিন্তু যারা বুদ্ধিমান-শিক্ষিত-সভ্যতার বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকটাই এগিয়ে – তাদের এই চরম নির্লজ্জভাবে মানবসমাজের চরম সংকটের ধারণা থাকা সত্বেও প্রতিনিয়ত বিভেদের-বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা-ই “মনুষ্যত্বের মৃত্যু” ! … [ক্রমশঃ]