গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ সাধু-সন্ন্যাসীর ‘রক্ত-ঝরা’ নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছিলেন । এখন সেইগুলোই এখানে বলা হচ্ছিল । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এক রামমন্দিরকে কেন্দ্র করেই হাজার-হাজার সাধু-সন্তদের রক্ত ঝরেছে । উনি বলেছিলেন – একবার দিল্লিতে গুলজারিলাল নন্দা অস্থায়ীরূপে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ৷ সেইসময় যেভাবেই হোক উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত সাধু-সমাজকে রাম মন্দির নির্মাণের ব্যাপারে উৎসাহিত করে একজোট করা হয়েছিল । সেই সময় বিভিন্ন নাগা (নাঙ্গা) সম্প্রদায়ের সন্নাসীদেরকেও “ভারতবর্ষের ধর্ম-সংকট”- বলে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল (যেহেতু নাঙ্গা সন্ন্যাসীরা কুম্ভমেলা-সাগরমেলা বা এই ধরনের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া কখনোই সমবেতভাবে বাইরে বের হন না)। হাজার হাজার সন্ন্যাসী সেই সময় জড়ো হয়েছিল এবং পুলিশ বা সরকারের সমস্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল । ভয় পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসারেরা গুলি করার Order দিয়ে দেয় – ফলে সেই সময় এককালীন কয়েক হাজার সাধুসন্তের রক্তে রাজপথ সিক্ত হয়েছিল । ইসলামীয় বা ইউরোপীয়রা নয় – দেশীয় পুলিশের হাতেই সেদিন কয়েক হাজার সাধু মারা পড়েছিল ।
আর একটা ঘটনার উল্লেখ করি – সেবার আমরা সবাই গুরুমহারাজের সাথে বাসে করে পুরী গিয়েছিলাম সিঙ্গুর আশ্রমের ছেলেদের ব্যবস্থাপনায়। ফেরার পথে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এক জায়গায় বাসগুলি দাঁড়িয়ে গেল । ড্রাইভার বলল – ওখান থেকেই আমাদের গন্তব্য লালবাঁধ(দীঘি) হেঁটে যেতে হবে । সবাই তখনো বাস থেকে নামেনি _হঠাৎ দেখা গেল গুরুমহারাজ সবার সামনে দিয়েই হন্-হন্ করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছেন ! প্রথমটায় কেউ অতটা বুঝতে পারেনি – কিন্তু যখন সবার সম্বিত ফিরল – তখন খোঁজ – খোঁজ ! কিন্তু খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল – গুরুমহারাজ আর কোথাও নাই !
সেবার গুরু মহারাজের গর্ভধারিনী জননী সহ রায়নার জগাদার মা, বনগ্রামের ন’কাকিমা, সেজোমা, এই ধরনের আরো অনেক বয়স্কা ‘মা’-কে উনি নিজের দায়িত্বে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷ আমরা দেখেছিলাম একেবারে বাধ্য সন্তানের মতো গুরুমহারাজ অতগুলি মা-কে কত সাবধানে এবং প্রচন্ড যত্ন করে করে সমস্ত স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন, পুজো দেওয়াচ্ছিলেন,বাজার করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সমুদ্রে একে একে নিজে কোলে করে করে স্নান করিয়ে দিচ্ছিলেন ! কিন্তু বিষ্ণুপুরে বাস থেকে নেমেই সবাইকে ফেলে – কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে গুরুমহারাজ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন কেন__সবার মনে তখন একটাই জিজ্ঞাসা !!
যাইহোক, গুরুমহারাজকে follow করে বেশিরভাগ মানুষই সেই পথে ছুটতে লাগল –আবার অনেকে হাতের কাছেই দোকান-বাজার পেয়ে মনের সুখে বাজারের দিকে চলে গেল ! বয়স্কা মায়েরা এবং ব্যাগ-পত্র সহ শিশুদেরকে কোলে নিয়ে পিতা-মাতারা খুবই কষ্ট করে প্রায় আধ কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে ওই লালবাঁধে গিয়ে পৌঁছালেন । যারা বাজারের দিকে গিয়েছিল, তাদের অনেকে হারিয়ে গেল, কারণ বাসগুলি কিছুক্ষণ পর অন্য রাস্তা ধরে স্পটে পৌঁছে গিয়েছিল তাই তারা বাস খুঁজে পায়নি বলে সারা দুপুর শুধুই ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে আর উৎকণ্ঠায় ভুগেছে – ইত্যাদি নানান কান্ড ঘটে গিয়েছিল সেদিন ৷ কর্মকর্তাদেরও চরম দুর্ভোগ কারণ যেহেতু লালবাঁধের ওখানেই সকলের রান্না-খাবারের ব্যবস্থা তাই সমস্ত কিছু ঘাড়ে করে করে বয়ে নিয়ে যাওয়াও এক দুরূহ কাজ ছিল । পরে খবর পাওয়া যায় – যে অন্য রাস্তা ধরে একটু ঘুরে গেলে একেবারে স্পট অবধি বাস চলে যাবে – সেটা জানতে পেরে বাসগুলি পড়ে লালবাঁধে পৌঁছে গেছিল।
কিন্তু এসব নানা ঘটনার মাঝেও মূল কথা ছিল – গুরুমহারাজ কোথায় ? তাঁকে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ! সবাই মিলে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল ! প্রায় এক ঘন্টা পর গুরুমহারাজকে দেখতে পাওয়া গেল – পুকুরের পূর্ব পাড়ের দিকে একটা বনজঙ্গল পূর্ণ উঁচু স্থানে__ যেটি হয়তো কোন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ হোতে পারে__সেইটার উপরে চুপচাপ একা বসে আছেন ! কর্মকর্তা-ছেলেদের মধ্যে দু-একজন ধীরে ধীরে গুরুমহারাজের কাছে গিয়ে ওনার সাথে কথা বলে নীচে নিয়ে এল –এবং ওখানেই পূর্ব পরিকল্পনামতো খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন হলো । এবার সুযোগ পেয়ে গুরুজীকে – ‘হঠাৎ করে ওনার অন্তর্ধানের রহস্য’– জানতে চাওয়া হল ! তখনই গুরুমহারাজ বলতে লাগলেন – ” গতকাল অযোধ্যায় রামমন্দির নিয়ে এক জমায়েতে বেশ কয়েকশত মানুষ উত্তর প্রদেশ সরকারের পুলিশের হাতে মারা গেছে – যার মধ্যে একশোরও বেশি সাধুসন্ত ছিল (তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিল মুলায়েম সিং যাদব)! ওই মৃত সাধুদের মধ্যে যারা উন্নত আধারের ছিল,তারা সূক্ষ্মশরীরে আমার কাছে এসে তাদের এইভাবে মৃত্যুর জন্য ‘ন্যায়বিচার’ চাইছিল ! ওরা বলছিল – ” ওদের অন্যায়টা কি ছিল, ওরা তো কারুকে মারেনি – কোন ভাঙচুর করেনি – শুধু সরকারের কাছে তাদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার দাবি জানাচ্ছিল ! ভারতবর্ষ যখন মুসলমান শাসনাধীন ছিল – তখন কোন মুসলমান শাসক(বাবর) কোন অন্যায় করে গেছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছে – কিন্তু এখন হিন্দুস্থানের হিন্দু শাসক কেন তার প্রতিকার করবে না ?” আমি ওদের সব অভিযোগ শুনলাম_তারপর ওই সাধুদেরকে আশ্বস্ত করলাম এবং ওদের মুক্তির ব্যবস্থা করলাম ! এইজন্যেই কিছুক্ষণ আমাকে একান্তে থাকতে হয়েছিল ৷” … [ক্রমশঃ]
আর একটা ঘটনার উল্লেখ করি – সেবার আমরা সবাই গুরুমহারাজের সাথে বাসে করে পুরী গিয়েছিলাম সিঙ্গুর আশ্রমের ছেলেদের ব্যবস্থাপনায়। ফেরার পথে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এক জায়গায় বাসগুলি দাঁড়িয়ে গেল । ড্রাইভার বলল – ওখান থেকেই আমাদের গন্তব্য লালবাঁধ(দীঘি) হেঁটে যেতে হবে । সবাই তখনো বাস থেকে নামেনি _হঠাৎ দেখা গেল গুরুমহারাজ সবার সামনে দিয়েই হন্-হন্ করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছেন ! প্রথমটায় কেউ অতটা বুঝতে পারেনি – কিন্তু যখন সবার সম্বিত ফিরল – তখন খোঁজ – খোঁজ ! কিন্তু খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল – গুরুমহারাজ আর কোথাও নাই !
সেবার গুরু মহারাজের গর্ভধারিনী জননী সহ রায়নার জগাদার মা, বনগ্রামের ন’কাকিমা, সেজোমা, এই ধরনের আরো অনেক বয়স্কা ‘মা’-কে উনি নিজের দায়িত্বে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷ আমরা দেখেছিলাম একেবারে বাধ্য সন্তানের মতো গুরুমহারাজ অতগুলি মা-কে কত সাবধানে এবং প্রচন্ড যত্ন করে করে সমস্ত স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন, পুজো দেওয়াচ্ছিলেন,বাজার করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সমুদ্রে একে একে নিজে কোলে করে করে স্নান করিয়ে দিচ্ছিলেন ! কিন্তু বিষ্ণুপুরে বাস থেকে নেমেই সবাইকে ফেলে – কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে গুরুমহারাজ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন কেন__সবার মনে তখন একটাই জিজ্ঞাসা !!
যাইহোক, গুরুমহারাজকে follow করে বেশিরভাগ মানুষই সেই পথে ছুটতে লাগল –আবার অনেকে হাতের কাছেই দোকান-বাজার পেয়ে মনের সুখে বাজারের দিকে চলে গেল ! বয়স্কা মায়েরা এবং ব্যাগ-পত্র সহ শিশুদেরকে কোলে নিয়ে পিতা-মাতারা খুবই কষ্ট করে প্রায় আধ কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে ওই লালবাঁধে গিয়ে পৌঁছালেন । যারা বাজারের দিকে গিয়েছিল, তাদের অনেকে হারিয়ে গেল, কারণ বাসগুলি কিছুক্ষণ পর অন্য রাস্তা ধরে স্পটে পৌঁছে গিয়েছিল তাই তারা বাস খুঁজে পায়নি বলে সারা দুপুর শুধুই ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে আর উৎকণ্ঠায় ভুগেছে – ইত্যাদি নানান কান্ড ঘটে গিয়েছিল সেদিন ৷ কর্মকর্তাদেরও চরম দুর্ভোগ কারণ যেহেতু লালবাঁধের ওখানেই সকলের রান্না-খাবারের ব্যবস্থা তাই সমস্ত কিছু ঘাড়ে করে করে বয়ে নিয়ে যাওয়াও এক দুরূহ কাজ ছিল । পরে খবর পাওয়া যায় – যে অন্য রাস্তা ধরে একটু ঘুরে গেলে একেবারে স্পট অবধি বাস চলে যাবে – সেটা জানতে পেরে বাসগুলি পড়ে লালবাঁধে পৌঁছে গেছিল।
কিন্তু এসব নানা ঘটনার মাঝেও মূল কথা ছিল – গুরুমহারাজ কোথায় ? তাঁকে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ! সবাই মিলে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল ! প্রায় এক ঘন্টা পর গুরুমহারাজকে দেখতে পাওয়া গেল – পুকুরের পূর্ব পাড়ের দিকে একটা বনজঙ্গল পূর্ণ উঁচু স্থানে__ যেটি হয়তো কোন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ হোতে পারে__সেইটার উপরে চুপচাপ একা বসে আছেন ! কর্মকর্তা-ছেলেদের মধ্যে দু-একজন ধীরে ধীরে গুরুমহারাজের কাছে গিয়ে ওনার সাথে কথা বলে নীচে নিয়ে এল –এবং ওখানেই পূর্ব পরিকল্পনামতো খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন হলো । এবার সুযোগ পেয়ে গুরুজীকে – ‘হঠাৎ করে ওনার অন্তর্ধানের রহস্য’– জানতে চাওয়া হল ! তখনই গুরুমহারাজ বলতে লাগলেন – ” গতকাল অযোধ্যায় রামমন্দির নিয়ে এক জমায়েতে বেশ কয়েকশত মানুষ উত্তর প্রদেশ সরকারের পুলিশের হাতে মারা গেছে – যার মধ্যে একশোরও বেশি সাধুসন্ত ছিল (তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিল মুলায়েম সিং যাদব)! ওই মৃত সাধুদের মধ্যে যারা উন্নত আধারের ছিল,তারা সূক্ষ্মশরীরে আমার কাছে এসে তাদের এইভাবে মৃত্যুর জন্য ‘ন্যায়বিচার’ চাইছিল ! ওরা বলছিল – ” ওদের অন্যায়টা কি ছিল, ওরা তো কারুকে মারেনি – কোন ভাঙচুর করেনি – শুধু সরকারের কাছে তাদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার দাবি জানাচ্ছিল ! ভারতবর্ষ যখন মুসলমান শাসনাধীন ছিল – তখন কোন মুসলমান শাসক(বাবর) কোন অন্যায় করে গেছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছে – কিন্তু এখন হিন্দুস্থানের হিন্দু শাসক কেন তার প্রতিকার করবে না ?” আমি ওদের সব অভিযোগ শুনলাম_তারপর ওই সাধুদেরকে আশ্বস্ত করলাম এবং ওদের মুক্তির ব্যবস্থা করলাম ! এইজন্যেই কিছুক্ষণ আমাকে একান্তে থাকতে হয়েছিল ৷” … [ক্রমশঃ]