গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের আলোচনা থেকে “সাধুর রক্ত ঝরবে ধরণীতে”- প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা হচ্ছিল । সেইসব কথা বলতে গিয়ে আমাদের আলোচনা ভারতের পাঠ্য ইতিহাসের দিকে Turn নিয়েছিল । কিন্তু আজ আবার আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসব । গুরু মহারাজ বলেছিলেন – যুগে যুগে পৃথিবীর মানুষ সাধু-সন্ত-মহাত্মা-মহাপুরুষদের রক্ত ঝরিয়েছে ৷ পৌরাণিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত Reference টেনে এই কথাগুলির সমর্থনে উনি বিভিন্ন উদাহরণের উপস্থাপনা করতেন । তার মধ্যে নৈমিষারণ্যে রাবণের ঋষিহত্যা বা ঋষিরক্ত Collection, দেবতাদের প্রয়োজনে দধীচির আত্মত্যাগের ঘটনা যেমন ছিল – তেমনি ভগবান বুদ্ধপরবর্তী সময়ে একটা ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন – যেখানে সম্রাট অশোকের সময়ে বা তার Just পরে জিন ভিক্ষুর নেতৃত্বে কয়েকশত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু তিব্বত পার হয়ে চীন এবং তার পাশাপাশি দেশগুলিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল । তাদের মধ্যে একমাত্র জিন-ভিক্ষুকে জীবিত পাওয়া যায় । কুড়ি বছর বা আরো বেশি সময় জেল-হাজতে থাকার পর তাকে মুক্তি দিয়েছিল তৎকালীন চীনা সম্রাট । জেলে অসাধারণ Record থাকার জন্যই ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল__ কারণ ওনার সংস্পর্শে যেসব অপরাধীরা ছিল তারাও ভালো হয়ে যাচ্ছিল । ওই সময়ের মধ্যে হান্‌ ভাষা (চীনা ভাষা) সম্পূর্ণ শিখে উনি ত্রিপিটক ওই ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন ৷ ওই জিন ভিক্ষুর হাত ধরেই চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ ঘটেছিল ৷ যাইহোক, এই সব কথা থাক_কিন্তু ওনার সঙ্গে যাওয়া শতাধিক সাধু-সন্তরা সবাই যে কোনোভাবে মারা পড়েছিল ।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণের সময় কল্লন নামক একজন সন্ন্যাসীকে প্রায় মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন_সম্রাটের সামনে মাথা না ঝোঁকানোর জন্য! কিন্তু হঠাৎ করে তাঁর শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটলের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি সেদিন সাধুহত্যা থেকে বিরত হয়েছিলেন।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – আচার্য শঙ্করের সময়কালীন সময়েও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সাথে বৈদিক পরম্পরার বিভিন্ন পন্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞানীদের সংঘাতের কথা ! সেই সময় নিয়ম ছিল – উভয় মতাবলম্বীর মধ্যে তর্কযুদ্ধ হবে – তাতে যে হারবে সে হয় বিজয়ী পক্ষের মত মেনে নেবে অথবা তুষানলে প্রাণ ত্যাগ করবে ৷ সেইসময়েও বহু বৌদ্ধ সাধু এবং বৈদিক পরম্পরার সন্ত-পন্ডিত-ব্রাহ্মণেরা ওইভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৷ আচার্য শঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত কুমারিল ভট্টের – যিনি তুষানলে দগ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে দিতে আচার্য শঙ্করের উত্তর মীমাংসা শ্রবণ করেছিলেন এবং এর স্বীকৃতি দান করে গেছিলেন ৷
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর সময়েও সাধুর রক্ত মাটিতে ঝরেছিল – যখন জগাই-মাধাই নিত্যানন্দ প্রভুকে রক্তাক্ত করেছিল ! তাছাড়াও সেই সময় যেহেতু নদীয়া সমেত সমগ্র গৌড়বঙ্গ মুসলমানদের অধিকারে চলে এসেছিল – তাই বিভিন্নভাবে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত-গোঁসাইদের উপর অত্যাচার খুবই চলতো !
তবে আলাউদ্দিন খলজির পর ভারতীয় প্রাচীন পরম্পরার উপর বা সাধু-সন্ত-পন্ডিতদের উপর সবচাইতে মারাত্মক আঘাত হেনেছিল__ আওরঙ্গজেব ! বিধর্মী হিন্দুদের উপর অত্যাচার তো আওরঙ্গজেব সাঙ্ঘাতিকভাবে করতোই – এমনকি তৎকালীন সুফি-সাধকদের উপরেও তার নির্মম আঘাত নেমে এসেছিল । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – দিল্লীর রাজপথে দারাশুকোর সুফী গুরু -কে প্রকাশ্যে হত্যা করার দিনেই আওরঙ্গজেবের এবং মুঘলদের পতনের নিশ্চয়তা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল ! কারণ ওই সুফী-সাধক প্রকৃতপক্ষে খুবই আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত ছিলেন ! … [ক্রমশঃ]