গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ, ভারতবর্ষের জনবিস্ফোরণ নিয়ে মাঝে মাঝেই যেসব চিন্তা ব্যক্ত করতেন – সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এখানে বলার চেষ্টা করা হচ্ছিল ! কিন্তু মাঝখানে মহারাষ্ট্রের সালের জেলার একটি গ্রামে দুজন নিরীহ সাধু কে ২/৩ ঘন্টা আটকে রাখার পর_ যেভাবে পুলিশ ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গ্রামের জনগণ শুয়োর ঠ্যাঙানো করে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললো__ এই ঘটনা হৃদয়কে খুব‌ই ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। তাই দুদিন ধরে আর কোন লেখায় হাত দেওয়া হয় নি! এইজন্যই দেরি হোল। কিন্তু ধারাবাহিক লেখা ছেদ পড়লে পাঠকদের একটু অসুবিধা হয়_তাই অনিচ্ছাকৃত ত্রূটির জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি !
গুরু মহারাজ একদিন বললেন – “ভারতবর্ষের সমস্ত জনগণ যদি লম্প-হ্যারিকেন জ্বালায়, তারজন্য যে তেল খরচ হবে – তাতে U.S.A-র যত লোকের গাড়ি আছে – তারা সবাই চালালেও অত তেল পোড়াতে পারবে না !” এরপরেই বললেন – ” অতিরিক্ত লোকসংখ্যা একটা দেশের পক্ষে অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নয় !”
লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই বন-জঙ্গল কেটে আরো আরো বেশি জনবসতি গড়ে তোলা – পশুপাখিদের ঘর ছাড়া করা অথবা তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেওয়া। অধিক জনসংখ্যা মানেই আরো আরো বেশি কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি ! এতে উৎপাদন বাড়ে কিন্তু বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের Source-টাকে নষ্ট করে দেওয়া হয় !
এরপরেই আসছে — এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য ঘরবাড়ি তৈরির সরঞ্জাম, আসবাবপত্রের প্রয়োজন মেটানো, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন – ইত্যাদি! আর এগুলির সরঞ্জামের জন্য তৈরি হতে লাগল একের পর এক কারখানা ! বেরোতে লাগলো গলগল্ করে ধোঁয়া যা আকাশ বাতাসকে দিনের-পর-দিন বিষাক্ত করতে লাগল ! যত বেশি শিক্ষিত মানুষ,সভ্য মানুষ _তত বেশি নগরসভ্যতার রূপায়ণ ! নগরের সংখ্যা মত বাড়লো _ ততবেশি বাতাস দূষিত হতে শুরু করলো, কলকারখানার বর্জ্যপদার্থ নদীর জলে মিশে নদীগুলিকে দূষিত করতে লাগলো, কৃষিক্ষেত্রের রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক বৃষ্টির জলের সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে স্থির জলাশয়গুলি অর্থাৎ ডোবা, পুকুর, দীঘির জল দূষণ করতে লাগলো ! শুরু হোল _ মাটি দূষণ, জল দূষণ, বায়ু দূষণ …. শুধু দূষণ, দূষণ আর দূষণ !
নগর সভ্যতার উন্নতিতে মাল্টি ন্যাশন্যাল কোম্পানিগুলির হাত ধরে যেই হাজারে-হাজারে, লাখে-লাখে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদিরা এসে গেল – অমনি সৃষ্টি হতে লাগলো ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা CFC! এতদিন কারখানা নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার-ট্রাই-অক্সাইড – ইত্যাদিরাই ছিল বায়ু দূষণের মুখ্য উপাদান ৷ এইবার এই ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ধীরে ধীরে বায়ুর উপরিস্তরে পৌঁছে ওজোন স্তরকে দুর্বল করে দিতে লাগলো !
যার ফলস্বরূপ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বিনা বাধায় ঢুকে পড়ছে পৃথিবীতে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা-প্রাণীকুল, মানুষের মধ্যে ক্যান্সার জাতীয় রোগের প্রবণতা বাড়ছে ।
তাছাড়া এর আরেকটি কুফল বিশ্বউষ্ণায়ন।পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে – জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে – অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি-ঝড়-সাইক্লোন-টর্নেডো-টাইফুন-সুনামি বারবার আঘাত হানছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ! মেরুপ্রদেশে এবং পর্বতশীর্ষের বরফ দ্রুত গলছে – বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর, বহু দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র তলিয়ে যাবার মুখে ! – হায় রে সভ্যতা ! হায় তথাকথিত সভ্য মানুষ !
এটা কি হলো ! এতো মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া এই সভ্যতার সৃষ্টি করে বা তার জয়গান গেয়ে কি লাভ_ বাছা- মূর্খ কালিদাস (গাছের যে ডালের ডগায় বসে আছে সেই ডালটার গোড়া কাটছে)!!
এই সবকিছুর পিছনে আসল সমস্যা বিশ্বের জনবিস্ফোরণ ! মানুষ যদি একটু সচেতন হোত – পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা যদি এই চরম সঙ্কটের প্রতি সচেতন হোত – তাহলে তারা সকলে মিলে বসে এই সমাধান কল্পে একজোট হোত, এটাকেই সবচাইতে প্রধান সমস্যা এবং এর আশু সমাধান কল্পে কোন নীতি নির্ধারণ করতো । কিন্তু তা হয়নি ৷ রাষ্ট্রনেতারা সবাই নিজেকে নিয়ে ভেবেছে – তারা রাজনেতা হয়ে রয়ে গেছে – রাষ্ট্রনেতা হতে পারেনি ! আর কেউ কেউ রাষ্ট্রনেতার পর্যায়ে গেলেও – বিশ্বনেতা হয়ে উঠতে পারেনি !
যদিও গোটা বিশ্বের কথা ভাবার জন্য বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়েছিল – কিন্তু সেখানেও পক্ষপাতিত্ব ! সেখানেও লোকদেখানো কিছুটা কল্যাণমূলক কাজ হয় – প্রকৃত কাজের কাজ কিছুই হয় না ।
তাহলে আসল সমস্যাটা কোথায় ? গুরুমহারাজ এর উত্তরে বলে দিয়েছিলেন – ” আসলে পৃথিবী গ্রহের মানুষের মানসিকতা এখন শিশু অবস্থায় রয়েছে, যেন হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থা থেকে সদ্য উঠে দাঁড়াতে শিখেছে ৷” তাহলে সাধারণ মানুষের কথা না ধরলেও পৃথিবীর উন্নত, শিক্ষিত, সভ্য মানুষ গুলোর কাছ থেকে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে-অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে সমাজ আর কি-ই বা বেশি কিছু আশা করবে ?
এখনই যদি জনসচেতনতা বাড়িয়ে এবং সমাজ জীবনে আইন-কানুন প্রয়োগ করে – জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম না টানা হয় তাহলে প্রকৃতি মা বাধ্য হবে – ধ্বংসলীলা চালিয়ে আবার সবকিছুর balance আনতে ! যার সূচনা আগেই হয়েছিল – এখন চলছে তার Continuation ! … [ক্রমশঃ]