আদিবাসী সম্প্রদায়ের ‘মারাংবুরু’ ‘শিব’ ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷ হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতেও পশুপতি শিবের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে ৷ স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন – “সারা বিশ্ব ঘুরে এসে দেখলাম যে, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে ‘শিব’ আর ‘শিবানী’-ই পূজিত হয়ে চলেছেন।” গুরুমহারাজ স্বামী পরামানন্দ একবার বলেছিলেন – ” মক্কার কাবা শরীফে মহাকাল শিব ম্লেচ্ছাচারে পূজিত হোচ্ছেন ৷”
ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিটি শাখায় খুব নিষ্ঠা সহকারে শিবের পূজা করা হয় ৷ স্বামী প্রণবানন্দ (ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা)-কে সাক্ষাৎ শিবাবতার বলেই মান্যতা দেন ভক্তেরা ! বারদীর ব্রহ্মচারী লোকনাথ বাবাকেও বলা হয় সাক্ষাৎ শিব বা শিবাবতার ৷ তৈলঙ্গস্বামীকে বলা হোতো কাশীর সচল শিব ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (যুগপুরুষ-যুগাবতার – যিনি ছিলেন সাক্ষাৎ হরির অবতার!)কামারপুকুরের বাড়িতে মা চন্দ্রমনির গর্ভ হতে বাইরে এসেই গড়িয়ে একেবারে প্রসূতি ঘরের এক পাশে থাকা উনোনে পড়ে – একেবারে ছাই-ভস্ম মেখে সদ্যোজাত শিব সেজে নিয়েছিলেন ৷ আরো একবার কিশোর বয়সে গ্রামের যাত্রাপালায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিবের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য মাথায় জটা লাগিয়ে ত্রিশূল হাতে, হাতে ডমরু নিয়ে, নকল বাঘছাল পরে ‘শিব’ সেজেছিলেন। উপস্থিত দর্শকেরাও মনে করেছিলেন – যেন সাক্ষাৎ শিব কৈলাশ থেকে নেমে এসেছে ! আর ঠাকুরের মধ্যেও শিবভাব জাগ্রত হওয়ায় উনি ভাবস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন ৷
এইভাবে প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায় – যেখানে মহাত্মা, মহাপুরুষ, অবতার পুরুষদের মধ্যেও শিবভাবের প্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে ৷৷ স্বামী বিবেকানন্দ, মহাসাধক বামদেব সকলকেই শিবাবতার-ই বলা হয়ে থাকে ৷ এই যে সমস্ত মহাত্মা-মহাপুরুষদের মধ্যেই শিবভাবের প্রকাশ থাকে – এর মানে হোচ্ছে, এনারা সকলেই আজ্ঞাচক্রের স্থিতি থেকে মানবের জন্য বা সমগ্র সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করে থাকেন। এনাদের নিজেদের কোনো কামনা-বাসনা থাকে না, সব তৃতীয় নয়নের উন্মীলনে (জ্ঞানসূর্যের উদয়ে) ভস্মীভূত হয়ে গিয়ে থাকে ৷ ফলে তাঁরা শান্ত অবস্থা, স্থিতাবস্থা লাভ করেন – আর তাইতো তাঁরা তাঁদের সংস্পর্শে আসা সকলকেই শান্তি দিতে পারেন। তবে শুধু এইটুকু বললে ভুল বলা হবে – এই শিবস্থিতির মহাত্মা-মহাপুরুষদের কথা চিন্তা করলেও মানুষের মঙ্গল হয় ৷ তাই শুধু স্থূলে নয় – এনারা সুক্ষভাবেও সকলের কল্যাণ করতে পারেন।
গুরুদেবের প্রণাম মন্ত্রে রয়েছে – “গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বরঃ ৷ গুরু সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ৷৷” আমাদের আশ্রমে (বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন) গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের যে বন্দনা (ওঁ শুদ্ধং বুদ্ধং ….. শ্রী পরমানন্দম্ ….) স্বামী তপেশ্বরানন্দ রচনা করেছেন – সেখানেও প্রতিটি stanza-র শেষে বলা হয়েছে – ” ওঁ হরো হরো সদগুরো মহাদেব ৷” যদিও বনগ্রাম আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে শুনেছিলাম স্বামী তপেশ্বরানন্দ মহারাজ যেহেতু দীর্ঘদিন (প্রায় কুড়ি বছর) ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখায় আচার্য হিসাবে কটিয়েছিলেন – তাই ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের উদ্দেশ্যে রচিত বহুল প্রচলিত ‘প্রণবানন্দ বন্দনা’র অনুকরণেই উনি ‘পরমানন্দ বন্দনা’ লিখেছিলেন ৷ ‘প্রণবানন্দ বন্দনা’ আমার এখনো দেখা হয়নি – তাই কতটা সাদৃশ্য রয়েছে – তা আপনাদের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারলাম না ৷
সে যাই হোক, আমরা দেখেছি যে – ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রাদিতে বিভিন্ন প্রণাম মন্ত্রে উল্লেখিত বন্দনা স্তোত্রে বারবার শিবের কথা এসেছে ৷ এর অন্যতম কারণ হোচ্ছে – মানুষকে সবসময় স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, সবার আদর্শ হোক ‘শিব’ ৷ শিব-কে আদর্শ করে সকলেই ধীরে ধীরে শিবময় হয়ে উঠুক, শিবস্থিতি লাভ করুক_এটাই উদ্দেশ্য ৷ অন্যান্য ধর্মমতের সাথে ভারতীয় সনাতন আধ্যাত্ম চিন্তার এইখানেই বিশেষ পার্থক্য ৷ বাকিরা যেখানে ঈশ্বরকে, পরমেশ্বর (আল্লাহ, গড, জিহোবা ইত্যাদি)-কে ভয় পেতে শেখায়, দূর থেকে স্তব-স্তুতির দ্বারা সন্তুষ্ট করতে শেখায় এবং তার স্থায়ী মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ ভোগ করাটাই পরমপ্রাপ্তি বলে মনে করে ৷ সেখানে আর্যচিন্তায় বলা হয়েছে – “তুমিই সেই !” তুমিই সেই হয়ে ওঠো ৷ তুমিই ঈশ্বর হয়ে ওঠো, আর তার জন্য প্রথমে তুমি শিবস্থিতি লাভ করো ৷৷ তুমি ‘শিব’ হও ৷৷