অনন্তের ইচ্ছায় যুগ-প্রয়োজনে যুগপুরুষ বা মহামানব ধরাধামে অবতীর্ণ হলে, তাঁর জগৎকল্যাণমূলক কর্মে বা ভূভার উদ্ধারকল্পে ও লীলাপুষ্টির নিমিত্ত বহু উচ্চকোটী মহাত্মা, যোগী, সিদ্ধপুরুষ জগদম্বার নিকট হতে প্রাপ্ত স্ব স্ব দিব্যশক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন—তাঁকে সেগুলি অর্পণ করার জন্য। আর এটা ভগবৎ পরিকল্পনা (Divine Plan) অনুসারেই হয়। ঐ পুরাণপুরুষের লীলাকার্যে ও জগদ্ধিতায় মহাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে থাকেন বহু পার্ষদ, মহাপুরুষ, জ্ঞানী, প্রেমী, কর্মী—এককথায় ধর্মবীর ও কর্মবীরগণ – সারা পৃথিবী জুড়ে। সাধারণত সীমিত আয়ুষ্কাল নিয়ে পরমপুরুষ ধরাধামে আবির্ভূত হলেও ঐ মহাজীবন হয় অত্যন্ত গতিসম্পন্ন ও ঘটনাবহুল যা সিদ্ধপুরুষ বা মহাপুরুষের জীবনের তুলনায় অনেকগুণ দ্রুত (Fast)। আর এই কারণেই ঐরূপ যোগযোগেশ্বরের জীবনালেখ্য রচনা করা বা তাঁর শ্রীমুখের কথা নিয়েও তাঁকে প্রকাশ করা একমাত্র ঐ লীলাময় পুরুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ যিনি পূর্ণ, অনন্ত, অব্যক্ত—অসীম, তাঁকে অপূর্ণ বা খণ্ড বোধ নিয়ে সীমিত লেখনীর দ্বারা তুলে ধরা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়—যে কথা শিবমহিম্ন স্তোত্রে মহেশ্বর শিবের মহিমা বর্ণনা করার পর শ্রীপুষ্পদন্ত অতি অপূর্বভাবে ব্যক্ত করেছেন : ‘নীলপর্বত যদি হয় কালি, সাগর যদি হয় মসিপত্র, পারিজাতের শাখা হয় যদি লেখনী, পৃথিবী যদি হয় পত্র আর এইসকল নিয়ে সরস্বতী যদি চিরকাল লিখে যান, তবুও–হে মহেশ্বর, তোমার গুণসমূহের ইয়ত্তা হতে পারে না।’ তবুও বহু যুগ যুগ ধরে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী-মনীষী, দার্শনিক ও ভক্তবৃন্দ ভগবৎ কৃপা সহায়ে প্রয়াস করে চলেছেন বিভিন্ন যুগে আবির্ভূত ঐ মহামানবদের মহিমার কথা গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, জীবনচরিত ও সংকলন গ্রন্থাদির মাধ্যমে প্রকাশ করার—এ যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা সম্পন্নের মতোই অবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না পরমারাধ্য গুরুমহারাজ শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দজীর কৃপাধন্য সন্তান শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ঐরূপ অভূতপূর্ব প্রয়াসের এক মূর্ত ফসল ‘কথা প্রসঙ্গে’ নামক এই সংকলন গ্রন্থ। যা পরমপুরুষ শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীগুরুজীর শ্রীমুখ-নিঃসৃত বাণীরই এক অনবদ্য নির্যাস। সংকলক শ্রদ্ধেয় শ্রীগুরুজীর শরীরত্যাগের ১৬/১৭ বৎসর পূর্ব হতে তাঁর দিব্য সংস্পর্শ ও সান্নিধ্যে আসে ও তাঁর বহু স্থানের মূল্যবান আলোচনা আসরে (Sitting) যোগদান করে বিচিত্রমুখী অমৃত কথা শ্রবণপূর্বক ঐ অনন্ত জ্ঞান ও প্রেমধারার কয়েকবিন্দু তাঁরই নির্দেশক্রমে দিনলিপিতে সঞ্চয় করতে থাকে। ঘটনাচক্রে সংকলক ঐ লেখাগুলি আমাকে পড়ে শোনালে, আমি ওর স্মৃতিশক্তিতে বিস্ময়বোধ করি এবং ‘চরৈবেতি’ পত্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে দেবার জন্য বলায়ও রাজি হয়। তখন গুরুজীর অনুমতিসাপেক্ষে সেগুলি তাঁরই দেওয়া ‘কথা- প্রসঙ্গে’ নামকরণের ভিত্তিতে তা বিগত ১০/১২ বৎসর ধরে ‘চরৈবেতি’তে প্রকাশিত হয়ে পাঠকবর্গকে আনন্দ দিতে থাকে। তারপর কালের অমোঘ নিয়মে—জগদম্বার অঘটন-ঘটন পটীয়সী লীলায় গুরুমহারাজের মহাপ্রয়াণের পর যখন পরমানন্দ ভক্তমণ্ডলীর পরমানন্দবিহনে জলবিহীন মাছের মতো এক অব্যক্ত যন্ত্রণাময় অবস্থা, তখন শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘কথা প্রসঙ্গে’র প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যথোচিত বিবেচনা করে আমাদের কথামতো সংকলক তার ডাইরীতে সঞ্চিত অপ্রকাশিত অংশগুলির মধ্যে থেকে মূলত গুরুজীর মহাজীবন-সংক্রান্ত অংশগুলিকে একত্র করে এই ‘কথা প্রসঙ্গে’ (১ম খণ্ড) গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। গ্রন্থটি আনুপূর্বিক পাঠ করলে দেখা যায় সংকলক প্ৰথম পর্যায়ে গুরুমহারাজের জগতে অবতরণের উদ্দেশ্য, জগদম্বার ইচ্ছানুসারে ঐ উদ্দেশ্য পালনের উপযোগী আধারগ্রহণ ও তাঁর অবতরণ-লীলাপ্রসঙ্গ, গর্ভে অবস্থানকালীন তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা পরম্পরায় তাঁর দিব্য মানসিক প্রকাশ ও মহাকুণ্ডলিনী-শক্তির জাগরণ, রোগ-ব্যাধিতে ও জীবনের সংকটময় অবস্থায় ও নানা ঘটনাচক্রে বহু সাধু-মহাত্মা, বাউল- বাউলিনী, ভৈরব-ভৈরবী ও যোগী-পুরুষের সঙ্গে সংযোগ, সংস্পর্শ ও সান্নিধ্যলাভের ঘটনা ও তাঁদের আশীর্বাদপ্রাপ্তি এবং সর্ববিধ সংকট মোচনের কথা, সাধারণ ভাবের অন্তরালে সুউচ্চ জ্ঞানের স্থিতিতে দ্রষ্টাবৎ অবস্থান, জগদম্বার দিব্যদর্শন ও সমাধিলাভ—ইত্যাদি সম্পর্কে শ্রীগুরুজীর মুখনিঃসৃত কথাগুলিকে সন্নিবেশিত করেছে। তারপর ২য় পর্যায়ে পারিবারিক অভাবের তাড়নাকে উপলক্ষ্য করে শ্রীগুরুজীর বাউলভাবে বিভিন্নস্থানে পরিভ্রমণ, হিমালয় ভ্রমণ, সেখানে বহু উচ্চকোটী মহাত্মা-মহীয়সীদের সাহচর্যলাভ, বিভিন্ন যোগশিক্ষা ও তাঁদের কাছে দিব্যশক্তি প্রাপ্তি, এছাড়া দেবতাত্মা হিমালয়ের অপূর্ব রহস্যপূর্ণ ঘটনার মধ্যে ভালো-মন্দ নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, দুর্গম হিমালয় ভ্রমণের সময় প্রাণসংশয়পূর্ণ নানাবিধ ঘটনার সম্মুখীন ও উদ্ধারলাভ, নাঙাবাবাদ্বয়ের সাহচর্যে মানসসরোবরে গমন ও হর-পার্বতীর দর্শনলাভ, গুহ্যস্থানসকল পরিদর্শন ও মাহাত্ম্য-কথা, আর্য সম্পর্কে প্রামাণিক আলোচনা, নাম-তত্ত্ব, সর্প-তথ্য ও তত্ত্ব এবং শেষে গুরুমহারাজের কর্মজীবনের কিছু মহিমাময় ঘটনা—ইত্যাদি সম্বন্ধে সংকলক শ্রীগুরুজীর শ্রীমুখ থেকে যেমন শুনেছিল, তা যথাসম্ভব গ্রন্থটিতে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করেছে। গুরুজীর ভাব-ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গীর সঠিকভাবে বজায় রাখার প্রয়াস সংকলকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া শ্রীগুরুজীর মনোরম কয়টি ছবি গ্রন্থটির মধ্যে স্থান পাওয়ায় এটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। পরিশেষে বলতে হয়—দিব্য তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে সুসমৃদ্ধ ‘কথা-প্রসঙ্গে’ ১ম গ্রন্থটি যে কোন মননশীল ও অধ্যাত্মপথের পাঠকদের নিকট পাথেয়স্বরূপ। গ্রন্থটি একাগ্র সহকারে পাঠ করলে শ্রদ্ধে গুরুমহারাজ ও ঈশ্বরকোটীপুরুষদের প্রতি যেমন পাঠকবৃন্দের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে, তেমনি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জগতের বহু দুর্লভ তথ্য ও তত্ত্ব প্রাপ্ত হয়ে তাঁরা তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডারের পুষ্টিসাধন করতেও সক্ষম হবেন বলে মনে করি ৷৷