গুরু মহারাজ :- দল-টল বোলো না । আমি তো বারবার তোমাদের বলি – দল বেঁধে ধর্ম হয় না ৷ আধ্যাত্মিকতা অর্ন্তজগতের গভীর নির্জন পথে একা একা চলা । গুরু পথপ্রদর্শক । তবে এই কথাটা ঠিকই বলেছ যে, ভক্তকে বড় করে দেখানো হয় – Example হিসাবে যাদেরকে পরবর্ত্তীকালের মানুষ আদর্শ করে তারা ঈশ্বরের খাস লোক । সাধারণ মানুষ কি ঈশ্বরের পরীক্ষা নিতে পারে — না ঈশ্বরের পরীক্ষায় পাশ করতে পারে ? শ্রীবাস মৃত ছেলেকে ঘরে চাপা দিয়ে রেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সঙ্গে নেচে নেচে নামগান করছেন আর মাঝে মাঝে গিয়ে স্ত্রীকে বলে আসছেন যেন জোরে না কাঁদে – তাহলে প্রভুর লীলার ব্যাঘাত ঘটবে ৷ – এটা সাধারণ ভক্তিমার্গের লোক হলে কি পারতো ? লীলা-সহচরদের পক্ষেই এটা করা সম্ভব !
তবে সবসময় এই ধরনের ভক্তরা যে ভগবানের সঙ্গে এসে তার পার্ষদ হয়ে লীলা করে তা নয় — পৃথকভাবেও কোন বিশেষ কাজ করতে তারা শরীর গ্রহণ করেন ৷ প্রকৃতপক্ষে এদের কোন স্বাধীন ইচ্ছা থাকে না — ঈশ্বরের ইচ্ছা বা জগৎ-কল্যাণের জন্য এরা শরীর নিয়ে কিছু কাজ করে যান, তারপর শরীর ছেড়ে দেন । শরীরের প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ থাকে না । আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূত শরীর ছাড়ার আগে এই ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন যে তার মৃত শরীর নিয়ে যেন বেশী বাড়াবাড়ি না হয় — যে কোন ভাবে সৎকার করলেই হোল । শরীর নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথাই ছিল না ৷ দধিচীর কথা তোমরা জানো — দেবতারা বিপন্ন হয়ে যখন তার শরীরের হাড় চাইলেন – আনন্দ সহকারে তা তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলেন ।
Plus World -এর লোকেদের কথা বলা হচ্ছিল! এঁরা সকলেই দধিচী ৷ এমনি এক দধিচীর কথা বলি শোন – এটা আরব দেশের ঘটনা । আল্লার সাথে কথাবার্ত্তা হোত এক ‘ওলি’র। ওলিরা ছিলেন মহাসাধক, মহাভক্ত ৷ কিন্তু এই হেন ‘ওলি’-ও এক ভক্তের কাছে কিভাবে নগন্য হয়ে গেলেন – তারই ঘটনা বলছি শোন ৷
ঔ ওলি-র তখন খুবই নাম-ডাক, স্থানীয় সমস্ত মানুষ যে কোন সমস্যায় ওনার কাছে যেতো । ওদেশে সেসময় এক নিঃসন্তান ভক্ত দম্পতি বাস কোরতো ৷ তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোন অভাব ছিল না কিন্তু কোন সন্তান না থাকায় তাদের মনে বড়ো দুঃখ ৷ একদিন তারা দুজনে (স্বামী-স্ত্রী) ঐ ওলি’র কাছে গেল ৷ তাকে অনুরোধ করল যে ওলি যেন আল্লাহ্-র সাথে দেখা হলে বা কথা হলে – ওদের দুঃখের কথা জানায় এবং সন্তান হবার আশীর্বাদ নিয়ে আসে ৷ বড় আশা নিয়ে ওরা বাড়ী ফিরে এল, কিন্তু নিরাশ হোল যখন ওরা পরের দিন ওলির কাছে গিয়ে শুনল যে ওলি আল্লাহ্-র কাছে এই দম্পতির দুঃখের কথা নিবেদন করেছিলেন — কিন্তু আল্লাহ্ ওকে বলেছেন যে ঐ দম্পতির এই জীবনে কোন সন্তানাদি হবে না ৷
নিরাশ দম্পতি বাড়ী ফিরে এল – কিন্তু তাতে ওদের আল্লাহ্-র প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব হোল না ৷ কারণ ঐ দম্পতির সন্তান না হবার পিছনে কি কারণ তাও আল্লাহ্ বলেছিলেন ৷ যাইহোক – এইভাবে দিন কেটে যায় ৷ একদিন এক ফকির ঐ দম্পতির বাড়ীর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল আর সে মুখে বলছিল “যে যত কটা রুটি তাকে দেবে – সে তত কটা সন্তান লাভ করবে” ৷ ঐ বাড়ীর মাহিলাটি অপেক্ষাকৃত বেশী ভক্তিমতী ছিল ৷ সে ফকিরের কথা শুনে মনে মনে হাসল। সে সন্তানের আশা না করেও ফকিরটিকে বাড়ীতে ডেকে নিয়ে এল এবং যত্নসহকারে বসিয়ে তাকে পেট ভরে রুটি-তরকারী খাওয়াল । ফকির খুব তৃপ্ত হয়ে যাবার সময় আশীর্বাদ করে গেলেন যে “মা, তুমি আমাকে যটি রুটি দিয়েছ, তোমার সমসংখ্যক সন্তান হবে” ৷ আর কি আশ্চর্য্য ! কিছুদিন পরই মহিলা গর্ভবতী হোল এবং পরপর কয়েকটি সন্তানাদিও লাভ করলো ৷
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে ৷ওলি সাধন-ভজন করতে পাহাড়ের নির্জন স্থানে চলে যাওয়ায় ঐ অঞ্চলে অনেকদিন আসেন নি। একদিন ঐ ওলি পাহাড় থেকে নেমে এসে কোন এক কার্যোপলক্ষ্যে ঐ দম্পতির বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ৷ বাড়ীর প্রাঙ্গনে অনেকগুলি বাচ্ছা ছেলেমেয়ে খেলা করছে দেখে তাঁর কৌতুহল হ’ল ৷ এই পরিবারটিতো নিঃসন্তান, — তাহলে এতগুলি বাচ্ছা-শিশু কোথা থেকে এল ! উনি ভিতরে প্রবেশ করে সমস্ত বৃত্তান্ত জানতে পারলেন — তার মনে মনে আল্লাহ্-র প্রতি প্রচন্ড অভিমান হোল এদের কাছে মিথ্যাবাদী হবার জন্য, আবার কৌতুহলও হ’ল যে তাহলে একটা সামান্য ফকিরের জন্য তার কাছে আল্লাহ্-ও তো মিথ্যাবাদী হয়ে গেলেন ! ব্যাপারটা কি জানতেই হবে !
উঁচু পাহাড়ের মাথায় ঐ ওলি-র কুঠিয়া ছিল, ওখানেই উনি সাধন-ভজন করতেন । আর ওখানেই ওঁর আল্লাহ্-র সাথে কথাবার্ত্তা হোত ৷ সেদিনও সাধন-ভজন শেষে আল্লাহ্-র সাথে কথার শুরুতেই ওলি ঔ দম্পতি ও ফকিরের কাহিনী তুললেন এবং আল্লাহ্ স্বয়ং মিথ্যাবাদী কেন হলেন — তা জিজ্ঞাসা করলেন । আল্লাহ্ কোন কথার উত্তর না দিয়ে ওলিকে একটি ধারালো ছুরি এবং একটি পাত্র দিয়ে বললেন – ” আমি খুবই ক্ষুধার্ত্ত, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব নরমাংস নিয়ে এসে আমার ক্ষুধার নিবৃত্তি করো”। ভক্ত সাধক ওলি আল্লাহ্-র ক্ষুধার কথা শুনে জিজ্ঞাসা-উত্তর এসব ভুলে দৗেড়ে বেড়িয়ে পড়ল নরমাংসের সন্ধানে ৷ নিকটবর্ত্তী লোকালয়ে গিয়ে তিনি তার বক্তব্য কাতরভাবে গ্রামবাসীর কাছে নিবেদন করলেন । স্থানীয় মানুষেরা তাকে মান্য করত খুবই – কিন্তু নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান হবার পর থেকে কোথাও একটু এই ব্যাপারে বিশ্বাসের ভাটা পড়ছিল – “আল্লাহ্ নরমাংস খাবে, তোমরা তোমাদের গায়ের মাংস কেটে দাও” – একথা শুনে আর ধারালো ছুরিসহ পাত্র দেখে তারা ভাবল যে – ওলির পাহাড়ে-পর্বতে-নির্জনে থেকে থেকে মাথাটা গেছে, ওকে মেরে ধরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দাও! যা ভাবা তাই কাজ ! ওলি সেই গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য আরো দু-একটি গ্রামে গিয়ে কাতর স্বরে আল্লাহ্-র ক্ষুধার ব্যাপারে ও তা নিবৃত্তির জন্য নরমাংসের প্রয়াজনীয়তার ব্যাপারে সবিস্তারে বললেন ৷ কিন্তু সেই গ্রামগুলিতেও উনি একই ব্যাবহার পেলেন । যে সব মানুষেরা ওনাকে এত মান্য করতো — তারাই আজ তাঁকে দুর-দুর করে তাড়িয়ে দিলো ।
শ্রান্ত, ক্লান্ত, অপমানিত হয়ে ওলি এক গাছতলায় বিশ্রাম করার জন্য বসলেন ৷ এমন সময় সেই ফকিরটি সেখানে হাজির ৷ ফকির ওলিকে জিজ্ঞাসা করল “হুজুর! আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে – আপনি কোন সমস্যার মধ্যে আছেন, আমাকে বলুন আপনার সমস্যাটা কি। সম্ভব হলে আমি তা সমাধান করে দেব।” ওলি কাতরকণ্ঠে ফকিরকে আল্লাহ-র ক্ষুধার কথা এবং কিভাবে তা নিবৃত্তি হবে সে কথাও জানালো ৷ ওলির কথা শেষ হতে না হতেই ফকির বলে উঠল “আরে, এর জন্য এত চিন্তা করছেন ? আমার শরীরের যেখানে যেখানে নরম নরম মাংস আছে, সব কেটে আল্লাহ্-কে নিবেদন করুনগে যান”। ওলি দেখল ফকিরের শরীর কঙ্কালসার, নিরন্নভাবে পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে শরীরে মাংস বলে কিছুই নাই, শুধু হাড় আর চামড়া ৷ একমাত্র পাছার কাছে একটু নরম মাংস রয়েছে, ওলি সেখান থেকেই খানিকটা মাংস কেটে পাত্রে রাখল ৷ তারপর ফকিরকে বিদায় জানিয়ে আল্লাহ্-র উদ্দেশ্যে চলে যাবার জন্য যেই এক পা বাড়িয়েছে অমনি রক্তাক্ত ফকির আর্তকন্ঠে বলল “দাঁড়ান ভক্তপ্রবর ! আল্লাহ্ আমার প্রাণের প্রাণ, আমার প্রিয় অপেক্ষা প্রিয়তম – জীবনে এই প্রথম তাঁকে কিছু দেবার সৌভাগ্য হ’ল – তাও পাছার মাংস? আল্লাহ্-কে তো সর্বোত্তম সামগ্রী দিতে হয়, আমার শরীরের সর্বোত্তম অঙ্গ কলিজা (হৃৎপিন্ড), আপনি আমার কলিজাটিকে নিয়ে গিয়ে আল্লাহ্-কে দিন ।”
ওলি ফকিরের বুক চিরে রক্তপূর্ণ হৃৎপিন্ডটি বের করে পাত্রে ভরে নিয়ে চলল আল্লাহ্-র উদ্দেশ্যে ৷ আর ফকির হাসিমুখে আল্লাহ্-কে স্মরণ করতে করতে শরীর ছেড়ে দিলেন । ওলির এত দেরী করে আসা দেখে আল্লাহ্ প্রথমেই তাকে দেরীর কারণ জানতে চাইলেন ৷ ওলি সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক আল্লাহ্-কে নিবেদন করলেন এবং অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য গুণাহ্ মাফ্ করার কথা বললেন ৷ তখন হাসিমুখে আল্লাহ্ ঐ রক্তমাখা পাত্রটি হাতে নিয়ে বললেন – “ওলি ! যে ফকিরের জন্য আমায় মিথ্যাবাদী হতে হয়েছে বা তোমাকেও মানুষের কাছে ছোট হতে হয়েছে – এই সেই ফকির ! নরমাংস খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল আমার একটা ছল __ তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য বা তোমাকে বোঝানোর জন্য । কারণ আমার ক্ষুধার ব্যাপারটা তো তুমিই প্রথম শুনেছিলে — তুমি যদি আমাকে প্রকৃত ভালোবাসতে তাহলে তো তুমিই তোমার শরীরের মাংস কেটে আমাকে নিবেদন করতে পারতে! কিন্তু তুমি নিজেকে বাদ দিয়ে গ্রামবাসীর কাছে গেলে আমার জন্য খাদ্য আনতে, এই অপরাধে তোমার শারীরিক নির্যাতন সইতে হোল । আর ভক্ত হিসাবে, সাধক হিসাবে তোমার মনে যে অহংকার জন্মেছিল তা ভেঙে দিল আমার পরমপ্রিয় ভক্ত ঐ ফকির ; সে যেকোন সময় হাসতে হাসতে আমার প্রীতির জন্য তার শরীরের কলিজাটাও উপড়ে দিতে পারে । তাই তার কাছে হারতে, তার জন্য মিথ্যাবাদী হতে আমার লজ্জা কি ? এইরকম ভক্তের কথা রাখতে, মান রাখতে আমি বারবার মিথ্যেবাদী হতে রাজী !!”
এই ঘটনাটির অবতারণা করলাম এইজন্য যে, তুমি বলছিলে না – ভগবানের পার্ষদরই প্রকৃত ভক্ত ইত্যাদি । দ্যাখো, প্রকৃতপক্ষে “ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ” -অবস্থাই ভক্তের অবস্থা, প্রকৃত, অপ্রকৃত ইত্যাদি বিশেষণ দাও আর না দাও – ভক্ত – ভক্তই । আর ঈশ্বরের মহিমা ভক্তের দ্বারাই প্রকাশিত হয় ৷ ঈশ্বরের অবতাররাও তো বেশীরভাগ সময়ে ভক্ত অবস্থাতেই থাকেন । দ্যাখোনা – তাঁরা নিজেদেরকে কখনই “আমিই ঈশ্বর”, “আমিই ভগবান” – বলেন না ! ঈশ্বরের প্রতিনিধি, পুত্র, সখা, সন্তান ইত্যাদি কোন না কোন ভাব আরোপ করেন । ব্যতিক্রম শ্রীকৃষ্ণ – উনি বিভিন্ন ভাবে নিজেকে প্রকাশিত করেছিলেন — গীতা বলার সময় বা আরও অনেক সময় পুরুষোত্তম ভাব-কেও আশ্রয় করেছিলেন ৷
যাইহোক, যা বলছিলাম __এইজন্যই বলা হয় – ঈশ্বরের লীলার কোন শেষ কথা হয় না, কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না ৷ কোন একটা ঘটনা দিয়ে বা কাহিনী দিয়ে তাঁকে বর্ণনা করা বা বোঝানো যায় না ৷ অনির্বচনীয়কে কি ভাবে বলা যাবে বল ? অবাঙমনসোগোচর -কে কিভাবে বাক্যে বা মনে আনবে?
শুধু একটা কথাই ভক্ত বলতে পারে __
“প্রভু ! তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক,
প্রভু ! তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক,
প্রভু ! তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক” ৷
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ৷৷