গুরু মহারাজ :- হ্যাঁ , কথাটা ঠিক ৷ অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দের অনেক বক্তব্য বা লেখা — সেই সময় রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে আসেও নি। এমন শোনা যায় যে ওনার বক্তব্যগুলি যে ছেলেটি সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে রাখতো — সে (গুডউইন) মারা যাবার পর একটা ভর্ত্তি ট্রাঙ্ক তার ইংল্যান্ডের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর মধ্যে কোন Writings ছিল কিনা সেই সময় তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। অনেক পরে যখন রামকৃষ্ণ মিশন সুসংগঠিত হোল — তখন চেষ্টা করেছিল, কিন্তু উদ্ধার হয়নি ৷ তাছাড়া একেবারে প্রথমদিকের যে ভাষণগুলি স্বামীজী আমেরিকায় দিয়েছিলেন — সেগুলি ঠিকভাবে কেউ লেখেনি — কারণ তখনও স্বামীজীর fan-followers তৈরীই হয়নি ওখানে, এসব কে করবে? ওখানকার সংবাদপত্রে ওনার বক্তব্যের যা সংক্ষিপ্তসার বেড়িয়ে ছিল, সেগুলি থেকে কিছু কিছু পাওয়া যায় ৷
আর তুমি যা বলছ — রামকৃষ্ণ মিশনে সংরক্ষিত রয়েছে অথচ ছাপা হয়নি — এমনও হয়েছে! দ্যাখো , স্বামীজী পরাধীন ভারতবর্ষে কাজ করেছেন ৷ ফলে তাঁর কথায়, লেখায় বারেবারে দেশমাতৃকার কথা এসেছে। এখানকার মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে ৷ উনিই বলেছেন – “যত উচ্চ তোমার হৃদয়_তত দুঃখ জানিও নিশ্চয় ৷” স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন সদাজাগ্রত বিবেকের অধিকারী , সুতরাং তাঁর হৃদয় আকাশের মতো বিশাল। আর সেই বিশালতায় তৎকালীন ভারতবর্ষের তথা ভারতবাসীর দুঃখ , ব্যাথা-বেদনা সদা-সর্বদা আঘাত করত , আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে দিতো ৷ নাহলে তিনি বিদেশে ভালো ঘরে ভালো বিছানায় শুতে পারছেন না — মেঝেতে রাত কাটাচ্ছেন — কাদের কথা ভেবে? ভারতের লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি অভুক্ত, গৃহহীন, শয্যাহীন, সাজ-সজ্জাহীন নর-নারীর কথা ভেবে — নয় কি ?
তিনিই তো ভারতবর্ষকে, ভারতের দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষদের চাগিয়ে উপরে তুলে ধরলেন, ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন! তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি – “দরিদ্র ভারতবাসী , মুর্খ ভারতবাসী ….. আমার ভাই , আমার প্রাণ ইত্যাদি কথাগুলি তৎকালীন শিক্ষিত যুবক-যুবতীর প্রাণে নাড়া দিয়েছিল! (আজও অবশ্য নাড়া দেয়) সাধারণ বাবু সমাজ, শিক্ষিত সমাজ এইভাবে কোনদিন ভাবেনি বা এই দৃষ্টিতে কোন দিন গরীবদের দেখেনি! স্বামীজী মানুষের দৃষ্টিটাই ঘুরিয়ে দিলেন, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিলেন। আধুনিক কালে গরীব মানুষ, অবহেলিত শ্রেণীর জন্য শিক্ষিত মানুষের ভাবনার জনক স্বামী বিবেকানন্দ। তাই ভারতবর্ষের জাতির জনক — “স্বামী বিবেকানন্দ” ৷ স্বাধীনতা পূর্বর্ত্তীকালের সমাজনেতারা সকলেই স্বামী বিকোনন্দের ভাবই অনুসরণ করেছেন ৷ “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার” — এটাও স্বামীজীই তরুণ তিলককে বলেছিলেন(পরবর্তীকালে ইতিহাস এই কথাটি তিলকের কথা বলে চালিয়ে দিয়েছে)।
ছাত্র তিলক ট্রেনে স্বামীজীকে ইংরাজীতে কয়েকজন সাহেবের সাথে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ও পরে আলাপ করেছিলেন ৷ তিলক বলেছিল “সাধুরা তো জটাজুটধারী , ভেকধারী হয় আর দু-চারটে সংস্কৃতে শ্লোক বলতে পারে — আপনার চুলদাড়ি বিন্যস্ত , পোষাক-পরিচ্ছদ গেরুয়া হলেও ধোপদুরস্ত , আর তাছাড়া আপনি পরিচ্ছন্ন ইংরাজী বলছেন ৷ তাহলে আপনি তো শিক্ষিত? শিক্ষিত হয়েও অাপনি সাধু-সন্ন্যাসী হলেন কেন ?” তিলকের ধারণা ছিল সাধু-সন্ত মানেই অশিক্ষিত , হয়তো একটু-আধটু সংস্কৃত জানে ৷ স্বামীজী ওর ভুল ভেঙে দিলেন। বলেছিলেন — প্রকৃত সাধুরা হল Cream of the Society , সমাজের সবচাইতে উন্নত ব্যক্তিটিই সাধু বা সন্ত হবার উপযুক্ত ৷ ভোগসর্বস্ব এই জগতে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করা বা করতে পারাটা বীরের কাজ , কাপুরুষের কাজ নয় ৷ তারপর উনি তিলকের শরীর-স্বাস্থ্য মজবুত দেখে বা ওনার দেশ সম্বন্ধে আগ্রহ দেখে ওনাকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে দেশের সম্বন্ধে অনেক কথা বলেন ৷
ভারতবর্ষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা করেন ৷ এরই ফলস্বরূপ আমরা পরবর্ত্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাল-গঙ্গাধর তিলককে পাই ৷ স্বামীজীর লেখাগুলি সেই সময়কার তরুণ বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করতো, তারা গীতা থেকে আর স্বামীজীর লেখাগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই দেশের জন্য প্রাণ দিতে পেরেছিল। নেতাজী সুভাষ , অরবিন্দ থেকে শুরু করে সকল তৎকালীন নেতা-রই আদর্শ ছিল স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজীর শিক্ষায় নিবেদিতা তো প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত ছিল। এটা কি গুরুদেবের নির্দেশ ছাড়া সম্ভব হতে পারে !!
যাইহোক , কথা হচ্ছিল স্বামীজীর লেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে ৷ উনি তৎকালে বিভিন্ন প্রবন্ধে বা পত্র-পত্রাদিতে দেশের কথা , স্বাধীনতার কথা লিখতেন — এগুলি তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের চোখে আইনত দন্ডনীয় ছিল ৷ স্বামীজীর লেখাগুলি যখন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত করা শুরু হয়েছিল — বেলুড় মঠ তখন সবে গড়ে উঠেছে। এমনিতেই প্রচুর ঝামেলা , মামলা-মোকদ্দমা, তাতে রাজরোষ পড়লে মিশনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এই ব্যাপারটি তৎকালীন মঠের নেতৃত্ব স্থানীয়দের নজরে রাখতে হয়েছে বলেই রাজরোষে পড়তে পারে এমন লেখা ছাপা হয়নি ৷
এছাড়া যে কোন মহাপুরুষ -“প্রজ্ঞা” বা প্রকৃষ্ট জ্ঞান লাভ করেন সাধনার দ্বারা অথবা জানবে তিনি নিত্যসিদ্ধ। এই প্রজ্ঞালোকে অবস্থান করলে অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক কিছু ইচ্ছামাত্রই দেখা যায় বা জানা যায় ৷ এইজন্য ঋষিকুলকে সত্যদ্রষ্টা বলা হয়েছে ৷ সত্য কি তা অতীতেরই হোক বা ভবিষ্যতের — তিনি বলে দিতে পারেন। আর শুধু পারেন তাই নয়, অনেকক্ষেত্রে বলেও থাকেন ৷ বেদে ‘ঋত’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে , যা সত্য তা যখন উপলব্ধ হয় — তখন তা হয় ‘ঋত’ ৷ বেদমন্ত্রে রয়েছে “সত্যম্ বদিষ্যামি , ঋতম্ বদিষ্যামি ।” কিন্তু মানবসমাজ যতই সভ্যতা-সংস্কৃতির গর্ব করুক না কেন — সত্যকে মেনে নেবার মত উপযুক্ত হয়েছে কি ? এখনও হয়নি ৷ তোমরাই দেখ না — যারা এখানে বসে আছ , তোমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক সত্যঘটনা আমি জানি , যদি সকলের সামনে দু-চারটে সেইরকম Negative ঘটনার কথা বলে দিই — তুমি কি আমাকে নিতে পারবে ? সকলের সামনে লজ্জায় পড়ে যাবে এবং আমার কথার প্রতিবাদ করবে ৷ যদিও অন্তরে তুমি জানছ যে আমি ঠিক বলছি — কিন্তু মুখে তুমি তা মানবে না! সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ঠিক এইরূপই হয়। মানুষ হয়তো বুঝতে পারে কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় — কিন্তু কোন না কোন Sentiment বজায় রাখতে গিয়ে প্রতিবাদ করে, লড়াই করে, হানাহানি-রক্তপাত করে ৷
স্বামীজী ছিলেন একালের ঋষি – সত্যদ্রষ্টা – কালদ্রষ্টা পুরুষ । তিনি তাঁর অন্তর্জগতে প্রবেশ করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অনেক সত্য দেখেছিলেন ৷ হয়তো কোন কোন পত্রে তার কোন প্রিয়জনকে এবং কোন কোন প্রবন্ধে সেই সত্যের কিছু কিছু প্রকাশও করেছেন। কিন্তু মুস্কিল হোল সেগুলি Publicly প্রকাশনার সময় ! After স্বামীজী, মিশন যখন বিভিন্ন ভক্তের কাছে স্বামীজীর পত্রগুলি চাইল , যেগুলি স্বামীজী তাঁর প্রিয় ভক্তদের লিখেছিলেন — তখন ভক্তরা সবরকমের চিঠিই হয়তো মঠকে দিয়েছিল।কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাছ-বিচার করে অনেক চিঠি ছাপতে পারলেন না। সম্ভবত হজরথ মহম্মদ ও যীশুখ্রীষ্ট সম্বন্ধে স্বামীজী যেসব কথা জানিয়েছিলেন — সেগুলির বেশিরভাগ ছাপা হয়নি ৷ মুসলিম সমাজ তো ঐ একটা ব্যাপারে এত Sensitive যে একটুখানিতেই ‘গেল’ ‘গেল’ রব্ তুলে দেয়! আর যেহেতু তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন বা খ্রীষ্টীয় শাসকেরা ছিল তাই যীশুখ্রীষ্টের সম্বন্ধে কোন Comments শাসক-রা সহ্য করবে না। এইসব চিন্তা করেই অনেক তথ্য ছাপা হয়নি।
তবে উনি যা বলেছিলেন তার দু-একটা Example দিচ্ছি — উনি বলেছিলেন যীশুর ক্ষেত্রে যেমন তৎকালীন রাজন্যবর্গ যীশুর পেছনে লাগল , চক্রান্ত করল এবং শেষে প্রাণে মেরে ফেলল বা তার চেষ্টা করল , — হজরথের ক্ষেত্রে তার ঠিক উল্টো হয়েছিল ৷ সেক্ষেত্রে তৎকালীন অারবের শাসকেরা ওনাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে মহম্মদকে Highlighted করেছিল ।
আর যীশু বা খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজীর vision ছিল অন্যরকম । এই ঘটনাটা অবশ্য অনেকটাই Printing -ও হয়েছে । উনি একবার ইউরোপে ঘোরার সময় সমুদ্রপথে জাহাজে ক্রীট দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন । এই সময় তাঁর একটি অদ্ভুত দর্শন হয় ৷ তিনি দেখলেন যে , দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ঐ দ্বীপ থেকে জলের উপর দিয়ে হেঁটে এসে ওনার সাথে দেখা করলেন ৷ ওনাকে তাঁরা বললেন যে , খ্রীষ্টধর্ম বলে আলাদা কোন ধর্ম-ই নাই ৷ বৌদ্ধধর্ম-ই এখানে যীশুর দ্বারা বা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে খ্রীষ্টধর্মে রূপ নিয়েছে ৷ ওনারা বোঝালেন যে বৌদ্ধধর্মের বোধিবৃক্ষ-ই — খ্রীষ্টধর্মে ক্রিসমাস্ ট্রী ৷ খ্রীষ্টধর্মে যে তিনটি প্রদীপ জ্বালানোর ব্যাপার রয়েছে — ওটা বৌদ্ধধর্মের ত্রিশরণ অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি , সংঘম্ শরণং গচ্ছামি , ধর্মং শরণং গচ্ছামি” — থেকে নেওয়া ৷ খ্রীষ্টধর্মের প্রার্থনা-গৃহ বা গীর্জা , এছাড়া প্রার্থনা এগুলি সবই বৌদ্ধধর্মের-ই আচার শুধু ভিন্নতা ভাষায় ও মন্ত্রের কথায় ৷ এইভাবে বৌদ্ধদের আচার-আচরণ দেশ পাল্টে , ভাষা পাল্টে, অন্য আঙ্গিকে খ্রীষ্টধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ৷
এবার বলো , তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত সমাজে , যেখানে পাদ্রীরা তখন দিকে দিকে গীর্জা বানাচ্ছে আর মানুষজনকে Baptish করছে , সেসময় এইসব কথা প্রকাশিত করা যেতো ! এমনিতেই স্বামীজীর বিভিন্ন শিষ্য বা রামকৃষ্ণ মিশনের উপর ব্রিটিশের গোয়েন্দাদের নজর ছিল ৷ বিশেষত: স্বামীজীর শিষ্যা মিস্ মার্গারেট নোবেল বা সিষ্টার নিবেদিতা প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মদত দিতেন । শুধুমাত্র ইউরোপীয়ান বলে ব্রিটিশ আইন ওনার উপর কার্যকর হত না — তাই রক্ষে! তখন ভারতবাসীদের জন্য আলাদা আইন ছিল — সেই আইনে যে কোন ব্যক্তিকে সন্দেহ হলে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে Arrest এমনকি যে কোন শাস্তি-ও দিতে পারতো ৷ ব্যক্তিটি কোন defence করতে পারতো না ৷ কিন্তু মার্গারেট ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত ৷ তখন Great Bretain -এর অন্তর্গত ছিল Scotland ও Ireland! ফলে বৃটিশ হিসাবেই ওরাও পরিগণিত হোত ৷ এই আইনের সহায়তায় নিবেদিতা তৎকালে ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন বা বৃটিশ-বিরোধী লেখা সাময়িক পত্র-পত্রিকায় লিখতে পারতেন।
যদিও অনেকবার মার্গারেটকে ব্রিটিশ Government , threat করেছিলেন বা সরকারী চিঠিও ধরানো হয়েছিল ৷ কিন্তু স্বামীজীর মন্ত্রশিষ্যা এই বিদেশীনী সন্ন্যাসিনী কিন্তু দমেন নি ৷ জীবনের শেষকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের জন্যই কাজ করে গেছেন ৷ যদিও পরবর্ত্তীকালে মিশন বা ভারতের জনগণ এই মহিয়সী রমণীকে সেভাবে মূল্যায়ন করে মানুষের কাছে তুলে ধরেনি ৷ সেটা হয়ত বিদেশীনী বলেই !!