প্রিয় আত্মন্ ! পরমেশ্বরের বোধে বোধ করাই হল মানব-জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, কারণ পরমেশ্বরই একমাত্র নিত্য-শাশ্বত —পরম সত্য ।
প্রশ্ন—আচ্ছা, তাহলে এই জীবন কি ?
উত্তর—জীবন হল পরমেশ্বরের মূর্ত প্রকাশ ।
প্রশ্ন—ঠিক বুঝতে পারলাম না, কৃপা করে একটু বুঝিয়ে বললে ভাল হয়।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্!সেই অনন্ত—অসীম—অমূর্ত আপনাকে সসীমতায় মূর্ত করেছেন। ঐ পরমচৈতন্য প্রতিটি প্রাণীর প্রাণচেতনারূপে বিরাজমান । এই সমগ্র বিশ্বে জড় ও চেতনারূপে তাঁরই প্রকাশ । অতএব তিনিই নানা নাম-রূপ পরিগ্রহ করে চিন্ময়লীলা করছেন ৷
প্রশ্ন—আচ্ছা যদি তাই হয়, তাহলে প্রাণীকুল বা জীবজগৎ তো অনেক এবং অসংখ্য, এই হিসাবে আমরা কি ধরে নেব—তিনিও বহু এবং অসংখ্য ?
উত্তর—না এইরূপ নয়। পরমার্থ-স্বরূপে তিনি একই আছেন, তিনি অনন্ত শক্তির আধার। তিনি আপন মায়াশক্তি দ্বারা এই ত্রিগুণ-জগৎ প্রকাশ করে স্বকীয় চিদাভাস দ্বারা, চিৎশক্তি প্রভাবে প্রাণী-জগৎ রচনা করেছেন । পরম রসিকশেখর আনন্দময় পরমেশ্বর বিশ্বজগৎ জুড়ে পরমরঙ্গে খেলা খেলছেন। তাই এই বিশ্বজগৎ পরম আনন্দঘন পরমেশ্বরের প্রকাশ বা লীলা ।
প্রশ্ন—এই সম্পর্কে আর একটু বিস্তারিতভাবে বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্!পরমার্থ-স্বরূপে তিনি একই অর্থাৎ যথার্থ নিত্য বা চিরন্তন । উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে—যেমন আকাশে একটি সূর্য কিন্তু জলপূর্ণ বিভিন্ন পাত্রের প্রতিটিতেই আলাদা-আলাদারূপে সূর্য আছে বলে মনে হচ্ছে। প্রভেদের কারণ পাত্র, বিভিন্ন পাত্রে বহু সূর্যের প্রতিভাস হচ্ছে, কিন্তু যথার্থ সূর্য একটাই । সেইরূপ পরমেশ্বর যথার্থরূপে পরমার্থ স্বরূপে এক থেকেও অসংখ্য নামরূপে প্রতিভাসিত হচ্ছেন । পরমেশ্বর সূর্যের উপমা, জীবদেহ এক-একটি পাত্রের মতো, আর জীবের স্বভাব বা অন্তঃকরণ হচ্ছে পাত্রস্থিত জলের ন্যায় ।
প্রশ্ন—আচ্ছা, আপনি বললেন- পরমেশ্বরের মায়াশক্তি দ্বারা জগৎ উৎপন্ন হয়ে থাকে—এই জগৎ উৎপত্তির বিষয়টা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ !পরমেশ্বর আপন মায়াশক্তি দ্বারা ত্রিগুণপ্রপঞ্চ এই বিশ্ব-জগৎ রচনা করেছেন । ত্রিগুণের অর্থ—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এবং প্রপঞ্চ হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম । ত্রিগুণের দ্বারা এই পঞ্চভূতের বিকার হতেই এই দৃশ্যমান জড়বিশ্ব ।
প্রশ্ন—জড়বিশ্ব সম্পর্কে আরো একটু পরিষ্কার করে বললে ভাল হয় ।
উত্তর—পরমেশ্বর অপরিবর্তনশীল কিন্তু এই জড়বিশ্ব অর্থাৎ পঞ্চভূতের দ্বারা গঠিত জড়-জগতের বিবর্তন ও পরিবর্তন হচ্ছে সর্বদা । পরমেশ্বর সমস্ত প্রকারের আবর্তন ও বিবর্তনের ঊর্ধ্বে । তিনি স্বমহিমায় নিত্য বিরাজমান ।
প্রশ্ন—এবার এই জড়-বিশ্বের উৎপত্তি কিরূপভাবে সম্ভব হয়—সেই সম্বন্ধে একটু বলুন।
উত্তর—পরমেশ্বর বা পরমাত্মা হতে মহতের উৎপত্তি হয়, মহৎ হতে আকাশের উৎপত্তি, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল এবং জল হতে পৃথিবীর উৎপত্তি হয় এইরূপে পঞ্চসমষ্টির উৎপত্তি হয়ে থাকে—এই হল জড়-বিশ্ব ।
প্রশ্ন—আপনি ‘মহৎ’ সম্পর্কে আমাদের আরও একটু পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! ‘মহৎ’ অর্থাৎ মহাজাগতিক মন অখণ্ড তত্ত্ব হল পরমেশ্বর এবং তা হতে মহৎ নামক মহাজাগতিক মন উৎপন্ন হয় । এটা উৎপন্ন হবার পূর্বে পরাবাক প্রণবরূপে পরমেশ্বরে অবস্থিত থাকে। সমগ্র সৃষ্টির কারণ ঐ প্রণবতত্ত্বে নিহিত থাকে। বিশ্বসৃষ্টির সংকল্প ও প্রয়াস প্রণবেই নিহিত থাকে । যা জড়-বিশ্বরূপে আমরা দেখছি—তা পরমেশ্বরের চৈতন্যময়তার প্রকাশ ৷ জড়পদার্থের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুকণাগুলি বৃহৎ শক্তিতরঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অণুগুলি অপরিমেয় শক্তিতরঙ্গে মিশে শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং পুনরায় কণিকায় পরিণত হচ্ছে। এভাবে অনন্ত বিশ্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে রূপান্তরের কর্ম চলছে নীহারিকাপুঞ্জের ভিতর । অনাদি- কাল হতে জড়জগৎ বা বিশ্বরূপের প্রকাশ হচ্ছে।
প্রশ্ন—আমরা নিশ্চিত হলাম—এই জড়বিশ্ব পরমেশ্বরের শক্তির দ্বারা প্রকট হয়েছে বা তাঁরই শক্তির রূপান্তর এই জড়বিশ্ব। কিন্তু বিজ্ঞানদৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে এটা কি মেনে নেওয়া যায় ?
উত্তর—নিশ্চয়। অবৈজ্ঞানিক কিছুই বলা হয়নি । তোমরা কিভাবছ—জড়-বিজ্ঞানের পর আর কোন বিজ্ঞানই নেই ? – জড়বিজ্ঞানই বিজ্ঞানের শেষ কথা নয় এবং আশাকরি কোন জড়বিজ্ঞানী এখনও এইরূপ ঘোষণা করেন নি। এইজন্য মহাবিশ্বের মৌলিক রহস্য যে বিজ্ঞানের দ্বারা জানা যায়, তাই অধ্যাত্ম বিজ্ঞান। প্রতিটি কার্যের পিছনে কারণ বর্তমান। কারণবিহীন কার্য ঘটানো অসম্ভব । সুতরাং এই জগৎ কার্য-কারণ সূত্রে বাঁধা । একই কারণ হতে অনন্ত কার্যের উৎপত্তি হচ্ছে। কার্য অকস্মাৎ ঘটে না, পিছনে কারণ থাকে । তাহলে দেখা যাচ্ছে কোন পরিকল্পনা বা প্ল্যান ছাড়া কোন সৃষ্টি সম্ভব নয়। এইরূপভাবে এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে এর পরিকল্পনা বা প্ল্যান কোথায় ছিল এবং পরিকল্পনাকারী কে ? নিশ্চয় কোন জড়বিজ্ঞানী নন ? একটু ভেবে দেখ ! প্রিয় আত্মন— সৃষ্টির পূর্বে পরিকল্পনা ছিল এবং পরিকল্পনাকারী যিনি ছিলেন— তিনিই পরমেশ্বর। তাঁরই পরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সম্ভব হয়— কোন কিছুই আচমকা বা অকস্মাৎ ঘটে না ।
প্রশ্ন—এখন আমরা বুঝতে পারলাম সৃষ্টির পিছনে পরমেশ্বর এবং তাঁর পরিকল্পনা বিদ্যমান ।
উত্তর—হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছি—পরমেশ্বরই একমাত্র সত্য—নিত্য— শাশ্বত। একমাত্র তিনিই বিরাজমান। শুধু ভ্রান্তি বা ভীমরতিবশতঃ আমরা অন্য কিছু দেখি বা অস্তিত্ব অনুভব করে থাকি । এই জগৎ-সংসারের যাবতীয় বিষয় পরমেশ্বরের প্রতিফলন বা প্রতিমূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয় ।
প্রশ্ন—আচ্ছা আত্মাদের এই পৃথিবীর জীব-জগতের মধ্যে মানবকে শ্রেষ্ঠ। বলা হয় কেন ? সমস্ত প্রাণীর ভিতর যদি পরমাত্মাই প্রকাশিত থাকেন, তবে মানব কেন শ্রেষ্ঠ হবে ?
উত্তর—সমস্ত প্রাণী জগতের ভিতর একমাত্র মানুষেরই আপন সত্তা বা স্বরূপের বোধে বোধ করার ক্ষমতা রয়েছে এবং আপন প্রকৃতিকে বুঝবার শক্তি রয়েছে—এই কারণের জন্যই (জীব জগতের ভিতর ) মানবকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। এক কথায় মানব-জীবনেই ঈশ্বর বোধে বোধ হয় এবং পূর্ণতা লাভ হয় । তাই মানব-জীবনই শ্রেষ্ঠ। এই দেহকে কেন্দ্র করে যিনি দেহাতীত, তিনি পরমরঙ্গে খেলা খেলে চলেছেন । এইজন্য এই দেহকে পরমেশ্বরের মন্দির বলা হয় । আর এই দেহতত্ত্বের ভিতর দিয়ে চিন্ময় পরমাত্মার বোধ হয় । সুতরাং এই দেহভাণ্ডেই চিন্ময় পরমাত্মা প্রকাশিত বা প্রতিভাসিত । সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড রহস্য এই দেহভাণ্ডে অবস্থিত। সাধনার মধ্য দিয়ে সাধক এই আধ্যাত্মিক রহস্য অবগত হয়ে থাকেন।
প্রশ্ন—আপনি এবার কৃপা করে ‘দেহতত্ত্ব’ সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্—মানবদেহ পঞ্চভূতের উপাদান দ্বারা গঠিত, তাই একে পঞ্চভূতের সমষ্টি বলা হয়ে থাকে। যেমন—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী—প্রতিটির উপাদান ক্রমানুযায়ী তার পূর্ববর্তী উপাদানজাত । এইগুলির দ্বারা এই পাঞ্চভৌতিক দেহ গঠিত।
পূর্বে তোমাকে বলেছিলাম পরমেশ্বর হতে মহতের উৎপত্তি এবং এইরূপে ক্রমান্বয়ে আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল এবং জল হতে পৃথিবীর উৎপত্তি হয়ে থাকে। এইভাবেই পঞ্চ সমষ্টির পরিণতি এই দেহ ।
প্রশ্ন—এখন আমরা বুঝতে পারলাম এই দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি,কিন্তু ঐ উপাদানসমূহ কেমন করে অনুপ্রবিষ্ট এবং অবস্থিত ? তাদের চিহ্নিত করে আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন ।
উত্তর—মানবদেহেরমধ্যে ঐ পঞ্চ উপাদান পুনর্বার পঞ্চরূপে অবস্থিত রয়েছে। যেমন প্রথম আকাশতত্ত্ব পাঁচটি অবস্থায় অবস্থিত রয়েছে—জ্ঞান, বুদ্ধি, মন, চিত্ত ও অহংকাররূপে। মানবদেহে এরা অতীন্দ্রিয়রূপে অবস্থান করছে, সেইজন্য এরা অতীন্দ্রিয় নামে পরিচিত।
দ্বিতীয়তঃ বায়ুতত্ত্ব—এর পাঁচটি রূপ হল — প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান । মানবদেহে এরা প্রাণধারক বায়ুরূপে অবস্থিত এবং পঞ্চপ্রাণ নামে পরিচিত ।
তৃতীয়তঃ অগ্নিতত্ত্ব—এর পাঁচটি রূপ হল—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক । মানবদেহে এরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়গ্রাম রূপে অবস্থিত এবং পঞ্চ জ্ঞান-ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত।
চতুর্থতঃ জলতত্ত্ব—এর পাঁচটি রূপ হল—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ওগন্ধ । মানবদেহে এই পাঁচটি সূক্ষ্মভাবরূপে অবস্থিত। এরা পঞ্চতন্মাত্রা বলে পরিচিত।
পঞ্চমতঃ পৃথিবীতত্ত্ব—এর পাঁচটি রূপ, যেমন—বাক্, পাণি, পাদ উপস্থ ও পায়ু । মানবদেহে এরা পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় নামে পরিচিত। এই পঞ্চ উপাদান দ্বারা শরীর গঠিত হয়।
প্রশ্ন—তাহলে পঞ্চ উপাদান দ্বারা আমাদের স্থূল মানবদেহ উৎপন্ন হয়েছে—আর যা ভৌতিক বিকার হতে উৎপন্ন, তা অবশ্যই বিনাশ হবে। তাহলে এই স্থুল দেহ বিনাশের পর কি আমাদের আর কোন দেহ থাকে ? যদি থাকে তাহলে আপনি সবিস্তারে তার বর্ণনা করুন।
উত্তর—হ্যাঁ থাকে, সূক্ষ্ম ও কারণ দেহ । পূর্বে যে পঁচিশটি তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে তা একটি একক। তাকে তিনটি অবস্থা বা শরীরে ভাগ করা হয় । এই পঁচিশটি তত্ত্ব যে অবস্থায় থাকে তার নাম স্থূল দেহ। এর অপর নাম বিশ্ব এবং এই অবস্থাকে বলা হয় জাগ্রত অবস্থা।
প্রশ্ন—এবার আপনি আমাদের সূক্ষ্ম শরীর সম্বন্ধে কিছু বলুন।
উত্তর – পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ, পঞ্চ তন্মাত্রা এবং মন ও বুদ্ধি —এই সতেরটি তত্ত্ব দ্বারা গঠিত যে শরীর তাকেই সূক্ষ্ম শরীর বলা হয়। এর অপর নাম তৈজস, এই অবস্থাকে বলা হয় স্বপ্নাবস্থা ।
প্রশ্ন—এবার আমাকে কারণ শরীর সম্পর্কে কিছু বলুন ৷
উত্তর—জ্ঞাত আর চিত্ত নিয়ে হয় কারণ শরীর অর্থাৎ জ্ঞাত-এর সঙ্গে চিত্ত সংযুক্ত হয়ে আছে। এর অপর নাম প্রাজ্ঞ । এই অবস্থাকে সুষুপ্তি অবস্থা বলে ।
প্রশ্ন—আচ্ছা এর পরও কি শরীর আছে ? যদি থাকে অনুগ্রহকরে বলুন।
উত্তর—হ্যাঁ, এর পরও আর একটি অবস্থা আছে, কেউ কেউ এই অবস্থাকে মহাকারণ শরীরও বলেন। কিন্তু এটা অবিমিশ্রিত তত্ত্ব। প্রাথমিক তত্ত্বের মিশ্রবিহীন শুদ্ধ চৈতন্য—সাক্ষীস্বরূপ । এর অপর নাম হিরণ্যগর্ভ । এই অবস্থাকে তুরীয় অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থা সমস্ত অবস্থার পরে, সেই কারণে একে অক্ষর পুরুষরূপে বর্ণনা করে থাকেন অনেকে।
প্রশ্ন—এর পর কি আছে—তা আমাকে বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! এর পর সেই পরমেশ্বর বা পরব্রহ্ম—যিনি সমস্ত কিছু বর্ণনার অতীত, ক্ষর ও অক্ষরের ঊর্ধ্বে —খণ্ডতে ব্যাপ্ত থেকেও স্বমহিমায় অখণ্ডে বিরাজমান রয়েছেন। সমস্ত কিছু তাঁতেই ওতপ্রোত—তা কেবল বোধে বোধ— ভাষা তাকে ব্যক্ত করতে অক্ষম । কারণ পরিপূর্ণ বোধের স্থিতি ভাষায় ব্যক্ত করার অবকাশ কোথায়!
প্রশ্ন—আপনি দেহাতীত পরতত্ত্বের কথা যা বললেন—তা অপরোক্ষ অনুভূতিসাপেক্ষ— বা বোধে বোধ। কিন্তু আমরা ঐ তত্ত্ববোধে উপনীত হতে পারছি না কারণ আমাদের এই স্থূল দেহে প্রতিনিয়ত বৃত্তিসকল উদয় হচ্ছে। আর আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি—এই অবস্থা আমাদের মধ্যে কেন হচ্ছে ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন্—মানবদেহ পঞ্চভূত দ্বারা গঠিত আর ঐ ভূতাদি বিকার হতে বৃত্তি উদয় হচ্ছে। যথাক্রমে চিত্তমল হতে চিত্ত বিক্ষেপ। তাই এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি । সাধনা বা যোগ অভ্যাস দ্বারা চিত্তমল নাশ হলে চিত্ত নির্মল হয়। ঐ অবস্থায় ব্রহ্মকারা বৃত্তির উন্মেষ হয়, তখন আর ঐ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থাকে না। সুতরাং চিত্তশুদ্ধির জন্য তপশ্চর্যা বা সাধনার প্রয়োজন । প্রশ্ন—আচ্ছা আমাদের চিত্ত বিক্ষেপ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এরা কেমন ভাবে আকৃতি নিচ্ছে এবং এদের গুণাবলীর পরিচয় কি কি ?—এই সন্বন্ধে অনুগ্রহ করে সবিস্তারে বর্ণনা করুন ।
উত্তর—পঞ্চভূত কেমন করে মানবদেহে আকৃতি নিচ্ছে—প্রথমে তাই শ্রবণ করঃ– আকাশ তত্ত্ব হতে কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ ও মাৎসর্য আকৃতি নেয় বায়ুতত্ত্ব হতে কার্যকলাপ, গতিবিধি, আবেগ, লজ্জা ও ভয় আকৃতি গ্রহণ করে ।অগ্নিতত্ত্ব হতে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য ও মৈথুন আকৃতি গ্রহণ করে। জলতত্ত্ব হতে রক্ত, মূত্র, লালা, শ্লেষ্মা ও মস্তিষ্ক, আকৃতি গ্রহণ করে ।আর পৃথিবী তত্ত্ব হতে আকৃতি গ্রহণ করে মেদ, শিরা, অস্থি, চর্ম ও কেশ । এই রকম ভূতাদি বিকার হতে বৃত্তি উদয় হচ্ছে।
প্রশ্ন—তাহলে ঐ রকম গঠনের জন্যই মানব এত জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে ? কারণ মানবের বহু রকমের দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা লক্ষ্য করা যায় ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, মানবের সকল রকমের কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণার মূল হল সমষ্টিগত ঐ গুণাবলীকে কেন্দ্র করে আর এদের মূলে হল দেহজ ব্যসন, মনজ ব্যসন, ধনজ ব্যসন ও কামজ ব্যসন । মানবের সমস্ত প্রকারের কামনা-বাসনা—এই চারটির ওপর ভিত্তি করে। অভিমানী মানব এই চারটি ব্যসন দ্বারা আক্রান্ত ।
প্রশ্ন—সাধারণতঃ মানব যে অভিমান করে থাকে তা কি কি ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! মানবের অভিমানের মূলে চারটি গর্ব, যথা কুল গর্ব, ধন গর্ব, যৌবন গর্ব ও পাণ্ডিত্য গর্ব । সকল দম্ভের মূলে ঐ চারটি। ঐ গর্বগুলিকে কেন্দ্র করে মানব সমস্ত রকমের অহমিকা প্রকাশ করে থাকে । এই অহংকার বা ত্রিগুণ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে দিনপাত করছে সাধারণ মানব । এই অহংকার নাশ না হলে পরমতত্ত্বের বোধে বোধ খুবই দুরূহ। ঐ কারণে মানবের দুঃখ-কষ্টও শেষ হতে চায় না । সুতরাং শরীরের নির্মাণানুসারে বৃত্তিসকল আকৃতি নেয়। কিন্তু মানব যখন তপশ্চর্যা বা যোগাভ্যাস সহায়ে সত্ত্বগুণ আশ্রয় করে তম ও রজঃ গুণের প্রভাব হতে মুক্ত হয়, তখন তার বিশুদ্ধভাবের উদয় হয় এবং ঐ অবস্থায় চিত্তশুদ্ধি হয়ে বিশুদ্ধভাব প্রাপ্ত হয়। তখন আর বিভ্রান্তিকর অবস্থা আসে না । সুতরাং তপশ্চর্যার দ্বারা দেহশুদ্ধি এবং যোগ অভ্যাস দ্বারা চিত্তশুদ্ধির একান্ত আবশ্যক।