একবার আমাদের কাটোয়া অঞ্চলের গ্রাম-গঞ্জের চলিত ভাষা এত সুন্দর ও যথাযথ উচ্চারণ করে বললেন যে আমরাই অবাক হ’লাম — যেন মনে হ’ল উনি বোধয় এই অঞ্চলেরই born and brought up . বাক্যটা উনি বললেন , যেন একজন চাষী নালার ধারে গরু চরাচ্ছে , গরুগুলোর শরীর-স্বাস্থ্য অতটা ভালো নয় হয়তো নালার ধারে স্লিপ কেটে কাদায় পড়ে গেছে , তাই রেগে গিয়ে চাষী গরুগুলোকে উদ্দেশ্য করে গালাগালি দিয়ে বলছে – ” ভাগাড়ে – নেলার গেবায় গেবায় যেচে – ভাগাড়ে ! খেচে দেচে গায়ে বল পেচে না — ভাগাড়েরা !!”
একদিন হিন্দী ভাষা নিয়ে আলোচনা করছিলেন ৷ হিন্দী ভাষাকে যে জোর করে সমগ্র ভারতবর্ষে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তা উনি সেদিন বলেছিলেন ৷ উনি আরো বললেন -” South এবং East হিন্দী কে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আজও মেনে নেয়নি ! তবে বিভিন্ন রাজ্যে যাদের কাজে যেতে হয় কিম্বা ভ্রমণপিপাসু মানুষের হিন্দী ভাষাটি শিখে রাখা উচিৎ । এতে তারই সুবিধা হয় ৷ স্বাধীনতার পর থেকে শুধু হিন্দীভাষীরাই দিল্লীর মসনদে রয়েছে তাই এটার তেমন প্রতিবাদ হয়নি”৷ উনি আরো বলেছিলেন – ” বলা হয় যে ভারতবর্ষের বেশীরভাগ মানুষই হিন্দীভাষী , কিন্তু তোমরা রেডিও বা T.V. -তে খবরের সময় সবাই যে হিন্দী শোন বা অটলবিহারী বাজপেয়ী (তখন প্রধানমন্ত্রী ছিল) যে হিন্দী বলে ওটা ঠাঠি হিন্দী ! তোমরা কদাচ ভেবো না সমগ্র হিন্দী বলয় ঐ ভাষায় কথা বলে ! হিন্দীভাষী সমস্ত রাজ্যে-র পৃথক পৃথক একাধিক dialect রয়েছে ৷
এই বলে দিল্লী অঞ্চলের dialect,মধ্যপ্রদেশের dialect,ছত্রিশগড়িয়া হিন্দী, ভোজপুরী হিন্দী, বিহারের ভিন্ন ভিন্ন জেলার ভিন্ন ভিন্ন টানের হিন্দী ,হিমাচল প্রদেশের বা উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ী দের হিন্দী dialect,রাজস্থানীদের চলিত হিন্দী ইত্যাদি কতরকম যে সেদিন বললেন ,তাঁর ইয়ত্তা নাই ! আমরা শুধু মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতাম -শুধু অবাক হয়ে সেই অনুপমের মুখের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া – আর কি-ই বা করতে পারা যায়! যে কোন কিছু তুলনা দিয়ে তাঁকে বর্ণনা করার বা বোঝানোর চেষ্টা করা হবে- তাই অপ্রতুল হয়ে যাবে তাঁর কাছে !সুতরাং সে চেষ্টায় কাজ নাই- শুধু তিনি কেমন চলতেন,কেমন বলতেন-আমি যতটুকু শুনেছি বা দেখেছি তাই বলার চেষ্টা করি! তবে এটা সবসময়ই মনে রাখতে হবে -এ যেন ঘুলঘুলি দিয়ে জগৎ দেখা ! যতটুকু দেখা যায় ততটুকু! এর বাইরেও বিরাট জগৎ পরে রয়েছে !স্বামী পরমানন্দ -ও তেমনি ই ।উনি ওনার লীলার প্রয়োজনে যাকে যতটুকু দেখিয়েছেন ,সে ততটাই দেখেছে। যাকে যতটুকু বুঝতে সুযোগ করে দিয়েছেন সে ততটাই বুঝেছে । কেউ যদি বলে সেই সবটা বুঝেছে -জানতে হবে সে আহাম্মক অথবা ভ্রান্ত ! কারণ নিজে সম্পূর্ণ না হলে পূর্ণের বোধ কি করে হবে ! আর যার বোধে বোধ হয়েছে -সে কি আর বকবক করবে ??
তাই আমরা যতটুকু দেখেছি বা বলা ভালো যতটুকু দেখার সুযোগ উনি করে দিয়েছেন -সেটুকু বলারই চেষ্টা করি ! কথা হচ্ছিলো বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক(dialect ) ভাষা নিয়ে । গুরুমহারাজ যে শুধু বিভিন্ন জায়গার ভাষা বলতেন তাই ই নয় -তিনি সেই স্থানের মানুষজন, তাদের সাজপোষাক, সেখানকার উৎপন্ন ফসল ও মানুষের খাদ্যাভ্যাস -অনায়াসে বলে যেতেন । ঝরঝর করে ঝর্ণার ধারার মতো তাঁর শ্রীমুখ থেকে কথার ধারা বেরিয়ে আসত । আবার মুল সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন ভাষায় কথাগুলি বা শব্দগুলি কিভাবে ও কেন পরিবর্তিত হয়েছে তাও বলতেন । ব্রাহ্মীলিপি কেন সরলরেখা যুক্ত আর খরোষ্ঠী লিপি কেন আঁকাবাঁকা তাও একদিন আলোচনা করলেন । বললেন আর্যরা সরকাঠি বা হাঁসের পাখার গোঁড়ার দিক ইত্যাদি sharp বা ছুঁচোলো কলম ব্যবহার করতো ফলে ব্রাহ্মীলিপিতে সরলরেখা বা সরু সরু সুক্ষ টান সম্পন্ন রেখার প্রয়োগ হয়েছে ।
অপরপক্ষে দ্রাবিড়রা লিপির জন্য ভোঁতা কলম ব্যবহার করতো বলে টান দেবার সময় মোটা মোটা বা গোল গোল লিপির সৃষ্টি হয়েছে । সুক্ষ সরলরেখা হয়নি । উড়িয়া রা খরোষ্ঠী লিপি গ্রহণ করেছে বলেই ওদের লিপিও গোল গোল পাকানো পাকানো কিন্তু ওদের কথা বা ভাষার সঙ্গে বাংলার প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে ।গুরুমহারাজ বিভিন্ন বাংলা শব্দ এবং উড়িয়া শব্দের মিল দেখিয়ে নিজে বিভিন্ন বাক্য বাংলায় ও উড়িয়া ভাষায় উচ্চারণ করে করে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলেন । বললেন “ধর তুই বলতে চাইছিস -‘আমাকে মারলে তোকেও মারবো ।’ -ওটা উড়িয়ায় হবে ‘মোকে মারিবি তো তোকে মারিব’ ।”
গতকাল থেকে ভাষা নিয়ে অনেক কথা হলো! আসলে গুরুমহারাজ যখন যেটা ধরতেন তখন সেটার একেবারে শেষ অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তবে ছাড়তেন । তখন আমাদের মধ্যে একটা কথা খুবই চালু ছিল যে, ‘গুরুমহারাজ কোন বিষয়কে ধরলে তাকে ব্রহ্মে লীন না করা পর্যন্ত ছাড়েন না”। যে কোন ব্যক্তিকে ধরলেও তাই করেন, কিন্তু উনি বলেছিলেন “তিন ডাক”। মানেটা হচ্ছে_ওনার সান্নিধ্য লাভের পর পূর্ণতা প্রাপ্ত হোতে ‘তিন জন্ম’_লাগতে পারে!
আর একবার বলেছিলেন গুরুর কৃপা, ঈষ্টের কৃপা হলেও’ আত্মকৃপা’ না থাকায় মানুষের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। কিন্তু ভগবানের সন্তানদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটবে না। কারণ উনি আর একটা কথা একবার নয়__বারবার বলেছিলেন, “তোরা রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠে পড়েছিস_আর ছোটাছুটি করেই বা কি হবে? যে যাই করুক সবাইকে সেই একসাথেই পৌঁছাতে হবে। তবে হ্যাঁ, যাত্রাপথে কেউ হয়তো ঘুমোতে ঘুমোতে যাচ্ছে, আবার কেউ যাচ্ছে enjoy করতে করতে!!”