গুরু মহারাজ আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর যখন প্রথম বনগ্রামে এসেছিলেন এবং নতুন তৈরী , কাদামাটির সোঁদা গন্ধমাখা ভিজে ঘরেই উনি একটা খাটিয়া পেতে থাকতে শুরু করেছিলেন – তখন থেকেই উনি ওনার চারপাশের ছোট-বড় সকলেরই লেখাপড়া শেখার বা তার বিস্তারের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন ৷ সেই সময় মুখার্জ্জী বাড়ীর বা গাঙ্গুলী বাড়ীর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উনি নিজে নিয়মিত পড়াতে বসাতেন ৷ এমনকি গ্রামের ছোট ছোট বালক বালিকারাও ওনার কাছে পড়তে আসত ৷ আবার যারা একটু বড় তাদেরকেও উনি আরও পড়াশুনা করার জন্য উৎসাহিত করতেন ৷ মুরারী মহারাজ , রেবামা , স্বরূপানন্দ , গাঙ্গুলী বাড়ীর কৃষ্ণা ইত্যাদিদেরকে উনি উন্নততর শিক্ষাগ্রহণে শুধু উৎসাহিতই করেন নি , বই যোগাড় করে দেওয়া , টিচার যোগাড় করে দেওয়া , নোট পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করা — ইত্যাদি সব উনি-ই করে দিতেন ৷ আমি প্রথম প্রথম যখন আশ্রমে যেতাম তখন অনেক ব্রহ্মচারী বা ব্রহ্মচারিণীদের বলতে শুনেছিলাম, “গুরু মহারাজের কাছে আবার নতুন করে পড়াশুনাও শুরু করতে হয়েছিল – জানো !!”
বিদেশীরা যখন থেকে নিয়মিত আশ্রমে আসা শুরু করল , তখন উনি আশ্রমিকদের এমনকি অনেক গৃহী ভক্তদেরকেও উৎসাহিত করতেন – ইউরোপীয়দের সাথে কথা বলা বা ইংরেজিতে Communication করার জন্য !

বিশেষত রান্নাঘরের ছেলেদের যাতে এদেরকে খেতে দেবার সময় কোন অসুবিধা না হয় তারজন্য গোটা কয়েক ইংরাজী শিখে নিতে বলেছিলেন ৷ তবে আমরা সেইসময় আশ্চর্য্য হয়ে দেখতাম আমাদের আশ্রমের ছোট ছোট আশ্রম বালকদের সাথে ইউরোপীয় ছেলে বা মেয়েদের খুব সহজেই দারুণ ভাব জমে যেতো ৷ কিভাবে এবং কোন ভাষাতে যে আশ্রম বালকেরা ইউরোপীয়দের সাথে Communication কোরতো, তা আমরা আজও বুঝে উঠতে পারিনি ।

আর একটা জিনিস দেখেও আমরা তখন খুবই অবাক হতাম, যখন দেখতাম প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ইউরোপীয় ভক্তদের অনেকেই গুরু মহারাজের সিটিং-এ এসে বসে পড়তেন ৷ গুরু মহারাজ হয়তো বাংলাতেই উপস্থিত ভক্তদের জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন , তবু ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু মুড়ে আমাদের মত বসে গুরুজীর কথা শুনত ৷ ওরা কি কিছু বুঝতো বা বুঝতে পারতো না – তা জানতে পারিনি ৷ তবে দেখতাম , ওদের দেশে (ইতালী , জার্মানী , নরওয়ে , ইংল্যান্ড) যেহেতু নীচে হাঁটুমুড়ে (সুখাসনে) বসার একদমই অভ্যেস নাই — তাই ওদেরকে বার বার পা পাল্টে পাল্টে বসতে হোত , অনেকে সুখাসন ছেড়ে বজ্রাসন করে বসত — তবু মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসে থাকার চেষ্টা করতো ! তখন প্রায়ই দেখতাম গুরু মহারাজ যখনই কোন অবাংলাভাষী মানুষ সিটিং-এ এসে বসত — উনি সেই ব্যক্তিটির মাতৃভাষায় দুটো-একটা কথা বলে তার সাথে প্রাথমিক একটা Communication করে নিতেন ৷ যেমন ইতালীয়ানরা যখন-ই সকালে সিটিং-এ এসে বসত উনি তাকে বলতেন -“buon jiorno! Hi dormito bene ” বা ” Hi dormito bene a notte !” [বুন্ জর্নো, আই(হাই নয়)দরমিতো বেনে / আ নত্তে !) যার বাংলা করলে হবে – “সুপ্রভাত! তোমার রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছে তো !”

অন্ধ্রপ্রদেশের ভক্তরা সিটিং-এ থাকলে উনি স্বচ্ছন্দে ওদের সাথে তেলেগু বলতেন ৷ একটা কথা প্রায়ই তপিমাকে বলতেন “তপিতাল্পি ! তি তিস্কুরা !” বাংলায় মানেটা হতে পারে “তপিমা ! একটু চা করে নিয়ে আয় !”
তখন আশ্রমে ইতালিয়ানরাই বেশি আসত বলে উনি ইতালিয়ান ভাষাটা সিটিং-এ বসে সবাইকে শেখাতেন। বিশেষতঃ ঐ ভাষার, আমি_আমরা, তুমি_তোমরা, সে_তারা, আর গোটাকয়েক verb এবং তাদের conjugation শিখিয়ে দিয়ে উনি বলতেন_”এই কটা কাজে লাগিয়ে ইতালিয়ানদের সাথে কথা বলা শুরু করে দে! দেখবি কিছুদিনের মধ্যেই ভাষাটা সড়গড় হয়ে যাবে”। ইতালিয়ান গ্রামার ও সংস্কৃত গ্রামারের অনেকটাই মিল রয়েছে। প্রাচীন ল্যাটিন আর সংস্কৃত শব্দের ও বহু মিল। এমনও হতে পারে যে বহু হাজার বছর আগে এসব ভাষার উৎস একই ছিল।

যে কথা হচ্ছিল-গুরুমহারাজ তার চারিপাশের জনদের শিক্ষার উন্নতি বা প্রসারের ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট থাকতেন । বনগ্রামের অনেক ছেলে যারা বাড়ীতে ঠিক মতো পড়াশোনা করতো না -তাদের অভিভাবকরা গুরুমহারাজ কে অনুরোধ করায়-উনি তাদের অনেককেই আশ্রমে রেখে লেখা পড়া শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । এদের মধ্যে খগেন মণ্ডল(নগেন এর ভাই),নীলু, পীরু, ক্যাবলা(বর্তমানের রণবীর মণ্ডল,ও অবশ্য অনেক পরে এসেছিলো ),ভূমিজ পাড়ার দু -একজন ও ছিল ।তবে সব চাইতে প্রথম দিকে এবং সম্ভবত সর্বপ্রথম যে আদিবাসী ছেলেটি এসেছিলো সেই ছেলেটিও হয় বনগ্রামের বা বনগ্রামে হয়তো ওর মামা বাড়ী ছিল -তার নাম ছিল ‘মনা’ । গুরুমহারাজ একবার বলেছিলেন ছেলেটি পূর্বশরীরে ছিল পেরেন্টাপল্লীর চিন্চি উপজাতির ‘হরি’ নামে একটি বালক ।গুরুমহারাজ যখন পেরেন্টাপল্লীতে ছিলেন সেইসময় ওই ছেলেটির সাথে ওনার যোগাযোগ হয়েছিল ।আগেই বলা হয়েছে, গুরুমহারাজ বনগ্রামের ছোট ছোট বালক -বালিকাদের ও লেখাপড়া শেখাতেন ।

গ্রামের ছোট ছোট মেয়েরা সকালে আসত এবং বিকালে স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতে ছুটতে সকলে গুরুমহারাজের কাছে চলে আসত। সামন্তীর মিনুদি (বর্ধমান সদগুরু আশ্রমের অমৃতপ্রাণা মাতার দিদি ) বা তার বোনেরাও পড়তে আসত । ওদের কে মনে হয় প্রশান্ত দা (ব্রহ্মচারী) বা এই ধরনের কোনো ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসীরা পড়াতো ।মুখার্জী বাড়ী বা গাঙ্গুলি বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরা গুরুমহারাজ কে বাড়ির লোক-ই ভাবতো ।ছোটরা ওনাকে বাবা,দাদু বা গুরুদাদু বলে সম্বোধন করতো ।আর যেহেতু গুরুমহারাজ ওদের বাড়ির লোকের মতোই ছিল তাই ওরা অনায়াসে গুরুমহারাজের কোলে পিঠে চড়ে বসত।গুরুমহারাজের মুখে শুনেছিলাম একবার গুরুমহারাজ মুখার্জী বাড়ীতে একা একাই আসনে বসে আছেন,আর গাঙ্গুলি বাড়ীর একটি ছোট মেয়ে (তখন ছোট এখন হয়তো গৃহিনী) উঠোনে আপন মনে খেলা করছিলো। হঠাৎ সে বলে -“বাবা(অথবা দাদু) আমি কেমন নাচ শিখেছি- দেখবে? “গুরুমহারাজ সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়েছিলেন, কিন্তু উনি আবার একান্তে নিজের জগতে চলে যান। ছোট্ট বাচ্ছা মেয়েটি আপনমনে নাচ দেখাতে দেখাতে খেয়াল করলো যে গুরুমহারাজের দৃষ্টি_ওর নাচের দিকে ঠিক নাই ! তখন মেয়েটি করলো কি -পাশেই একটা সরু কন্চি বা ওই জাতীয় কোনো ছড়ি পড়ে ছিল । সে ঐটা দিয়ে তার ছোট দুর্বল হাতের সাহায্যে গুরুমহারাজের গায়ে আঘাত করে বলেছিলো-” তুমি আমার নাচ দেখছো না !” গুরুমহারাজ চমকে উঠে নিজের জগৎ ছেড়ে তাঁর শরীরে ও পারিপার্শ্বিকতায় ফিরে আসেন এবং বলেন -“হ্যাঁ হ্যাঁ এবার দেখছি !তুমি নাচো!’

এই ঘটনা টা উল্লেখ করে গুরুমহারাজ পরবর্তীতে আমাদের বলেছিলেন -“ঐ বাচ্ছাটি নিজের অজান্তে যে কাজ করলো-এটা কিন্তু পরমানন্দের জীবনে একটা বিরাট অঘটন! এমনটা হবার কোনো কথাই ছিল না -কিন্তু ঘটে গেলো । ফলে হলো কি জানো-এটি আমার চেতনার জগতে একটা বিশেষ ঘটনা হিসাবে থেকে গেলো।ধরো আবার কোনো সময় আমাকে শরীর নিতে হলো -আর কার্যকারণ সূত্রে ঐ মেয়েটিও শরীর নিল আর আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেলো !মেয়েটির তো কোনো কিছুই স্মৃতিতে থাকবে না- কিন্তু আমি যে মুহূর্তে ওকে দেখব সেই মুহূর্তেই আমার মনে হবে ওকে একটা ছড়ির সাহায্যে আঘাত করি ! তার মানে মেয়েটির সঙ্গে আমার ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনাবলীর কোনো ছাপ না থাকলেও ঐ ঘটনাটির ছাপ কিন্তু থেকেই যাবে।