প্রিয় আত্মন্‌—

প্রত্যেকটা মানবের মধ্যে সহজাতক্রমে একটা প্রেরণা বা ভালবাসা বিদ্যমান। এইজন্য মানব ভাবপ্রবণ বা স্নেহপ্রবণ। এটাই হল মানবজীবনের বৈশিষ্ট্য । ঐ প্রেরণা বা ভালবাসা যখন কোন প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র হতে তীব্রতর হতে থাকে, তখন মানবের অন্তর্জগতে এক স্নিগ্ধ মাধুর্যময় নৈসর্গিক অবস্হার উন্মেষ হয়। ঐ অবস্হাকে ভাব বলা হয়। তারপর ঐ ভাব যখন ক্রমশ গভীর হতে গভীরতর অবস্হার ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ গাঢ় অবস্হা প্রাপ্ত হয়, তখন সেই অবস্হাকে বলা হয় প্রেম। সেই প্রেমাবিষ্ট মানব তখন আস্বাদন করে থাকে এক অনাবিল উল্লাস ; তা-ই মানবের চির আকাঙ্ক্ষিত ভূমানন্দ বা পরম আনন্দতত্ত্ব। সেই তত্ত্ব সমস্ত কালের সীমাকে অতিক্রম করে ব্যাপ্ত রয়েছে—সেইজন্য তা অনন্ত। সমস্ত দেশ, কাল ও পাত্র তাতে আবিষ্ট এবং তা দেশ, কাল ও পাত্রের ঊর্ধ্বে, তাই তা অসীম ও অপরিমেয়। যাকে পেলে সবই পাওয়া হয় অর্থাৎ সর্বস্ব প্রাপ্তির বোধ হয়, সেই বোধের নিকট সমস্ত চলমান বিষয়বোধ ম্লান। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের নিবিড় জমাট যে অপার্থিব সম্পর্ক—কোন কথা তাকে ব্যক্ত করতে পারে না। কারণ তত্ত্বকথা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই অবস্হা শাস্ত্রকথা বা তর্ক প্রতিপাদ্য বিষয় নয় এবং তর্ক বা শাস্ত্রবচন দ্বারা এর অনুভব হয় না। জীবনের মধ্য দিয়ে ও সহজ বাস্তব বোধের মাধ্যমেই এর যথার্থ অনুভব সম্ভব। সহজ ও সাবলীলভাবে আপনার মধ্যে আপনার দ্বারাই এর বোধ হয়, অপরের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। গ্রহই যাদের নিকট একমাত্র অবলম্বন এবং যারা ইন্দ্রিয়ের ক্রীতদাস—তাদের পক্ষে এই তত্ত্ব অনুভব বড়ই দুরূহ। শাস্ত্র কিংবা তর্কজালের দ্বারা নয়, শুধু আপনার অন্তঃকরণের মধ্যেই এর পরম অনুভব হয়ে থাকে। প্রকৃত সহজ সাধকের ভিতরে রয়েছে জীবন্ত ধর্মীয় বোধের বেদনা—সীমার মধ্যে এক অকল্পনীয় উদ্ভব। পণ্ডিতরা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভাণ্ডারী, সহজ বোধের সম্পর্কশূন্য ও ছন্দবিহীন—অসহজ। সুতরাং তার অস্তিত্ব একমাত্র প্রেমিকসাধকই বোধ করতে পারেন।

প্রিয় আত্মন্‌, সীমা অসীমের বাইরে নয় এবং অসীমও সীমাকে ছেড়ে নয়। সীমা ও অসীম একাধারে ওতপ্রোত—অসীমের সীমাধারণ ও সীমার অভিব্যক্তি অসীমের নিমিত্ত। সীমার ভিতর সেই অসীমের প্রকাশ আবার সীমার মধ্য দিয়ে ঐ অসীমের বোধই হল পরমবোধ। ঐ অসীমকে যে কোনরূপে আহ্বান করতে পারা যায় । করণ তার বিশেষ কোন নামরূপ নেই। মানব সহজ প্রেমাবস্হা লাভ করলে ভগবদ মাধুর্যরস বা ভূমার বোধ হয়, ভাষা তাকে ব্যক্ত করতে পারে না এবং অবকাশও থাকে না, তা কেবলমাত্র পরম বোধেই থাকে। সচ্চিদানন্দ পরমেশ্বর পূর্ণ প্রেমস্বরূপ । সমগ্র বিশ্বপ্রপঞ্চ ভগবৎ প্রেমের ঘনীভূত লীলামূর্তি—গুণাতীতের গুণময় লীলা। অসীমের মধ্যে সীমার উল্লাস আর সীমার মধ্যে অসীমের আবির্ভাব—এই হল পরমেশ্বরের চিদ্-বিলাস । অনাদিকাল হতে অসীম আপনাকে সীমার মধ্যে সীমায়িত করেছে শুধুমাত্র আনন্দের কারণে। সেই তত্ত্বেইআপনি আপনাকে আলিঙ্গন করে আপন মাধুর্যরস আস্বাদন করছে—এটাই পরমেশ্বরের লীলাবিলাস। সংসারের প্রতিটি বিষয় ঐ প্রেমস্বরূপ চৈতন্যকে আলিঙ্গন করে আছে আর ঐ প্রেমই হল সকলের হৃদ-বিহারী সচ্চিদানন্দ। এই সকল ঐ বিশ্ব-আত্মারই প্রকাশ।

প্রিয় আত্মন্‌—মানব সচরাচর যা কামনা করে থাকে, তা সিদ্ধ না হলে কামনা ক্রোধে পরিণত হয়। ক্রমান্বয়ে তা হতে লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য আপনা হতে এসে পড়ে এবং মানব পরিণত হয় মতিভ্রমগ্রস্ত অসহজ অবস্হায়। সাধারণত মানবের মূল লক্ষ্যই হল সুখলাভ। কিন্তু কামনার ভোগে সুখলাভ হয় কি ? সুখের পরিবর্তে তখন দেখা যায় ভোগান্তি আর দুর্ভোগ। মানবকে পরম প্রেমের স্হিতিতে উপনীত হতে হবে, তাহলেই তার পূর্ণতা নতুবা মানব পূর্ণতাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। মানব নিজের সামর্থ্যে সেই স্হিতিতে পৌঁছাতে সক্ষম না হলে প্রয়োজন হয় পরমেশরের করুণা আর তখনই আসবে জীবনের পূর্ণতা। কামবিকার—মানবজীবনে প্রাণক্রিয়ার নিম্ন লক্ষণ। প্রেমই উৎকৃষ্ট এবং পূর্ণ। যাদের মধ্যে এই কামবিকার পরিলক্ষিত হয়, তারা এখনও আদিমতাকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিশ্চিত তারা প্রাণীকুলের সর্বনিম্নে রয়েছে। প্রেম মানবজীবনকে রূপান্তর করে দেয়—মানবজীবন ও মানব সমাজের মহত্ত্ব সূচনা করে। প্রেম মানবকে পাশবিক প্রবৃত্তির নিম্নস্তর হতে পরমেশরের দিকে অগ্রসর করে। আত্ম-বিস্মৃত, স্বার্থপর নরপিশাচ হয়ে ওঠে চৈতন্যময় দিব্যমানব। প্রেম সব অভাবকে দূরীভূত করে। যেখানে ভাবের ঘরে চুরি সেখানে প্রেম থাকতে পারে না। বাহ্যাচার ও কুসংস্কার দ্বারা মানব আচ্ছন্ন। শাস্ত্র এবং পরম্পরার জালে মানব এমনভাবে আটকে গেছে যে,তার ভিতর হতে বের হয়ে আসা খুবই মুশকিল।

সাধারণত মানব সঙ্কল্পময়। নিকৃষ্ট সংকল্পের অপকর্য ফলপ্রাপ্তি হয় এবং উৎকৃষ্ট সংকল্পের দ্বারা মানব উৎকর্ষ ফল লাভ করে থাকে। সুতরাং ভাবটাই আসল। প্রকৃত ভাবই অনুষ্ঠানকে জাগ্রত ও জীবন্ত করে তোলে। শুদ্ধ ভাবাবেগ ও ঈশ্বর অনুরাগে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে আকুল প্রাণের বেদনা এবং বিগলিত মুখর হয় ভক্তের আবেগময় প্রার্থনা। ভাবহীন অনুষ্ঠান নিষ্ফল। সংসারে মানব যখন ঘৃণা, মান, অপমান—এইগুলির প্রতি উদাসীন হয় তখন তার মধ্যে সহজাতক্রমে সহজ ভক্তির আবির্ভাব হয়। আর বিনম্রতা ভগবৎ প্রেমিকের লক্ষণ।

প্রিয় আত্মন্‌, সংসার যশের পূজা করে। ক্ষমতা পিপাসুরা অধিকার ও কীর্তির পিছনে দৌড়ায় এবং মানবের দুর্বলতার সুযোগ খোঁজে। অপরের উপর আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার নিমিত্ত তারা অলস-প্রকৃতি ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভক্তির নামে মন-বিকৃতি বা ভাব-বিকৃতি শিক্ষা দেয়। কিন্তু চিন্তা-বিমুখতা, আলস্য-বুদ্ধি, ভাব-বিক্ষেপ—এগুলি ভগবদ ভক্তি নয়। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন নির্বোধের জীবনে ভক্তি ও প্রেম প্রকট হয় না। তা অবদমিত কামনারই বিভিন্ন মন সংবেদন বা মন বিক্ষোভ, যা ভয় এবং জাগতিক অভাবকে প্রকট করে।

প্রিয় আত্মন্–বুদ্ধি, হৃদয় ও শরীরের আলস্যকে কাটিয়ে উঠতে হবে। মানব বিচারকে বন্ধ বা ত্যাগ করতে পারে না। সুতরাং চিন্তাজগতে তীব্র আন্দোলন শুরু কর, বিবেক দ্বারা বিশ্লেষণমুখী হও। তাহলেই দেখবে—বুদ্ধির জড়ত্ব ও হৃদয়ের সংকীর্ণতা বিদূরিত হয়েছে। ক্রমশ অন্তঃকরণ শান্ত ও গভীর প্রশান্ত ভাব ধারণ করবে। সুতরাং ভগবৎমুখীহও—সমস্ত রকমের প্রতিকূলতা কেটে যাবে।

অন্তর্মুখী হবার পর প্রচণ্ড আগ্রহ প্রকাশ করতে থাক। অসহ্য ব্যাকুলতা প্রকট কর, তাহলেই চরম ও পরম বস্তুতে তুমি শীঘ্রই উপনীত হবে। তখন দেখবে বিচার আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। চিত্ত নিস্তরঙ্গ হলে আত্ম-সমাহিত-অবস্হা লাভ হয় আর ঐ নির্মল অন্তঃকরণে তখন ভগবৎ প্রেমের আবির্ভাব হয়।

প্রিয় আত্মন্‌, তখন আর শ্রেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, মান-অপমান, পুরস্কার-তিরস্কার, স্তুতি-নিন্দা, ঈর্ষা, অধিকার, ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি অভিমানিক মনের সংবেদন বা বৃত্তির ক্রিয়া থাকে না। যতক্ষণ অভিমানী মন থাকে, ততক্ষণ খণ্ডিত বা ভেদভাব বিদ্যমান। যখন অভিমানী মন বিলুপ্ত হয়, তখনই প্রকৃত প্রেমের আবির্ভাব হয়—তা সহজ ভক্তের পরম কাম্য। সাধারণত জীব-জগৎ অভিমানী মনের স্তরে অবস্হান করছে—এই অবস্হা মানবের সহজ অবস্হা নয়। মানবকে এই অসহজ অবস্হা কাটিয়ে উঠতে হবে। অভিমানী মন বিলুপ্ত হলেই প্রকৃত সত্যের বোধ ও অখণ্ড প্রেমের আবির্ভাব হয়। অভিমানী মনের স্তরে মানব যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ কামনারই নানারকম বিকার পরিলক্ষিত হয়। এটা চিত্তবিক্ষোভ-ভগবৎ প্রেম নয়। স্বার্থবুদ্ধি, শ্রেণীবুদ্ধি, সম্প্রদায়বুদ্ধি—এইগুলিই নিম্ন-অভিমানী মনের প্রতিক্রিয়া বা সংবেদন। অখণ্ড বোধে নিম্নমনের প্রতিক্রিয়াগুলি মানবস্বভাব হতে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর উক্ত চারিত্রিক দুর্বলতাগুলি আধ্যাত্মিক মানবের কখনই লক্ষণ হতে পারে না। এগুলি আধ্যাত্মিক অপূর্ণতার লক্ষণ। আধ্যাত্মিক পূর্ণতালাভ হলে সমস্ত রকমের স্বার্থজড়িত দুর্বলতাগুলির অবসান হয়। এক কথায় স্বার্থের মৃত্যু হয় আর প্রেমের আবির্ভাব হয়।

প্রিয় আত্মন্‌—স্বার্থজড়িত অভিমানী মনের স্তর হতে চরম ও পরম স্হিতির দিকে অগ্রসর হও। আকুল হয়ে বল :— “অসতো মা সদ্‌গময়

তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যোর্মামৃতং গময় ॥”*

[* ‘অসৎ হতে আমাকে সতে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও।’]

প্রিয় আত্মন্‌—স্মরণ রেখো, প্রেমের ছোঁওয়ায় প্রেমের আবির্ভাব আর হিংসা হতে হিংসার আবির্ভাব। স্বার্থ হতে দ্বেষ ও সমস্ত রকমের অশান্তির উৎপত্তি। প্রেমে ক্রুরতা—করুণাভাব ধারণ করে, ভয়-ভীতি মৈত্রী-ভাব ধারণ করে, অস্হিরতা বা চপলতা—শান্ত-স্নিগ্ধভাব ধারণ করে। স্বার্থান্ধ পশুমানবকে স্বার্থমুক্ত সহজ অবস্হায় নিয়ে যেতে হলে প্রেমের দ্বারাই একমাত্র তা সম্ভব। তীর ভালবাসা সমস্ত কিছুকে রূপান্তর করতে সক্ষম । কয়লা তার কালিমার রূপান্তর ঘটিয়ে যখন আলোকোজ্জ্বল হীরকে পরিণত হয়, তখন আর তাতে যেমন কালিমার লেশমাত্র থাকে না— সমস্ত কালিমা অদৃশ্য হয়ে যায়, ঐরূপ কামনা-বাসনা-স্বার্থবিজড়িত পশু মানবের মধ্যেও ভগবৎ প্রেমের আবির্ভাবের সাথে সাথে সমস্ত রকম স্বার্থের মলিনতা অদৃশ্য বা দূরীভূত হয় আর তখনই সে মহাপ্রেমিকে বা সহজমানবে পরিণত হয়।

প্রিয় আত্মন্‌, হৃদয়ে কণামাত্র স্বার্থবুদ্ধি থাকলে ভগবৎ প্রেমরূপ অমৃতলাভ হয়না। তোমার সাথে পরমেশ্বরের সম্পর্ক হল সহজ ভালবাসার। তিনি প্রাণের প্রাণ, হৃদয়ের হৃদয়, আত্মার আত্মা। একমাত্র তিনিই আপনজন। দণ্ডের ভয়ে বিহ্বল হয়ে তাঁকে ভালবাসা নয়, কিংবা কাল্পনিক স্বর্গসুখভোগের লালসায় তাঁকে ভালবাসা নয়, আকুল প্রেমের মদিরা পান কর, সমস্ত রকম ভীতি ও ইন্দিয়জ লালসা অদৃশ্য হবে।

প্রেমের মত্ততা উপস্হিত হলে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ এবং ভক্ত ও ভগবান একীভূত হয়ে যায়।

প্রিয় আত্মন্‌, যা তোমায় খর্ব করে না—তা-ই ভালবাসা। ভালবাসা অপর কাউকেই খর্ব করে না; তা তোমাকে মহান করে এবং অপরকে মহিমান্বিত করে। হামবড়া দাম্ভিক ব্যক্তিদের মধ্যে নিজের অসার অহংকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রবণতা দেখা যায়। এইজন্য তারা অসহিষ্ণু এবং ক্রূর হয়ে পড়ে। নিজেকে বিকৃত স্বভাববিশিষ্ট উন্মাদে পরিণত করে তোলে।

তোমাদের দোষকে নির্দোষ কর, অন্তরকে পবিত্র ও নির্মল কর, ভালবাসার মদিরা পান কর এবং তীব্র আবেগে সবাইকে ভালবাসতে থাক। তাহলেই অন্তরের গভীরে প্রেমের দরজা খুলে যাবে। শুধু স্বার্থের বন্ধনে ঐ দরজার কপাট বন্ধ হয়েছে। ভালবাসার তীব্র আঘাতে ঐ স্বার্থ-বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। প্রেমের দুয়ার খুলে যাবে, বোধ করবে আনন্দ, পরমেশ্বরের অপার করুণা।

প্রিয় আত্মন্‌, স্মরণ রেখো—টাকা দিয়ে ভালবাসা বিক্রি হয় না, তা মুদিখানার দোকানের কোন বস্তু নয় যে, কেনা-বেচা হবে। এই বিশ্বটা একটা মুদিখানার দোকান—এরূপ কখনই ভেবো না। ভালবাসা কোন পুরস্কারের আশা পোষণ করে না—শুধু আপনাকে নিবেদন করে, কিছু প্রত্যাশা করে না। ভালবাসা স্বার্থবুদ্ধি নামক বৃক্ষটির মূলে তীব্র আঘাত হানে। ঐ আঘাত সংকীর্ণ কামনা-বাসনা জড়িত স্বার্থের অবলুপ্তি ঘটায়। এইজন্য আত্মনিবেদনের সুর বাজতে থাকে। প্রেম অন্তর্জগতের অনুভবলব্ধ এবং অকারণ, কথা তাকে ব্যক্ত করতে পারে না। কারণ ভাব ও ভাবালুতা দুটি ভিন্ন অবস্হা। ভাব অনুভবগম্য বা উপলব্ধি সঞ্জাত, ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও অপ্রাকৃত মাধুর্য। কিন্তু ভাবালুতা দর-দামের হিসাব- নিকাশ বা লাভ-লোকসানের জট পাকায় কল্পনাময় বহুকথার জাল রচনা করে আর চাওয়া-পাওয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আশা-নৈরাশ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে।

প্রিয় আত্মন্‌—তোমার ভালবাসার বাগিচায় জীবনরূপ-বৃক্ষে প্রেমের ফুল ফোটাও। এতে আত্ম-অনুভব-রূপ ফল অবধারিত—এই সম্পর্কে তুমি নিঃসংশয় হতে পার। কিন্তু সাবধান! বাগিচার মধ্যে স্বার্থবুদ্ধি-রূপ কাঁটাগাছ যেন না থাকে। থাকলে ঐগুলিকে সমূলে উৎপাটন কর, কিঞ্চিৎ মূলও যেন অবশিষ্ট না থাকে। তা না হলে সমস্ত ব্যাপারটাই ব্যর্থতায় পরিণত হবে। প্রেম সপক্ষ সমর্থন করে না, যেখানে আত্মরক্ষার তাগিদ,সেখানে প্রেম প্রস্ফুটিত হয় না। প্রেম সংঘাত ও আঘাতবিমুখ। প্রেম গ্রহণবিমুখ, তাই প্রেমে চাওয়া-পাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। প্রেমে মানবমনের চাওয়া-পাওয়ার সংস্কার বিলীন হয়ে যায়। ক্ষুদ্র আর বৃহতে স্বতন্ত্রতা থাকেনা—একীভূত ‘ওঁ’ অবস্হার উন্মেষ হয়। এইজন্য মানব মনের স্বতন্ত্রতা অদৃশ্য হয়ে যায়, কোন বৃত্তির তরঙ্গ উদয় হয়না—অন্তর নিস্তরঙ্গ ভাব ধারণ করে। প্রেম সম্পূর্ণ স্বাধীন, সহজ আনন্দ-বিগলিত তরল উল্লাস। ভাষা তাকে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে—তা জড়ত্ব নয়— পরমানন্দঘন সহজ স্হিতি। সুতরাং প্রেম অব্যক্ত অর্থাৎ কোনকিছু তাকে প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু সব কিছু তারই প্রকাশ।

প্রিয় আত্মন্ ! প্ৰেম অব্যক্ত বেদনা। ঐ অব্যক্ত বা অমূর্ত বেদনারই ব্যক্ত হবার প্রয়াস হতেই সমস্ত বিশ্বসংসারের উৎপত্তি।

সুতরাং বেদনার ভিতরই রয়েছে সৃষ্টির প্রয়াস। অমূর্ত বা অব্যক্তের মূর্তবা ব্যক্ত হবার প্রয়াসেই এই আনন্দময় বিশ্বসংসার. প্রতিভাসিত হচ্ছে।

সুতরাং এই বিশ্বসংসার পরমানন্দময় পরমাত্মার প্রকাশ। ঐ জমাট বেদনাই নব সৃষ্টির প্রেরণা, ঐ প্রেরণা হতেই জগৎ-সংসারের প্রকাশ হচ্ছে আর প্রকাশেই আনন্দ। ঐ অব্যক্ত বেদনার ব্যক্ত হবার আনন্দতেই সৃষ্টি, স্হিতি ও প্রলয়রূপ জগৎ-সংসার আবর্তিত হচ্ছে।

প্রিয় আত্মন্—শুধুমাত্র স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তিরাই অপরের ব্যথা-বেদনা অনুভব করে না এবং ব্যথিতদের বেদনার প্রতি সহানুভূতি হারায়। তারা সীমিত সুযোগ- সুবিধা ও সংকীর্ণ সুখ-দুঃখের গণ্ডীতে নিজেদের মনকে আচ্ছন্ন রাখে । এরা ভীমরতি দশাগ্রস্ত, আত্মবিস্মৃত, অসহজ মানব ।

প্রিয় আত্মন্, তুমি যদি আমায় জিজ্ঞাসা কর—পরমেশ্বর কি ? তাহলে আমি এককথায় বলব—তিনি মূর্তিমান অখণ্ড প্রেম। আমি বলব—তাঁর ঐ অসহ্য প্রেমে যে একবার পাগল হয়েছে—যার ঐ উন্মত্ত প্রেমের আঘাতে সমস্ত স্বার্থাভিমান চুরমার হয়ে গেছে—যার কামনা-বাসনা ঐ প্রেম-সমুদ্রের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে—সে আর কি বলতে পারে ? পরমেশ্বর মূর্তিমান অখণ্ড প্রেমস্বরূপ—অব্যক্ত বেদনাসঞ্জাত অপ্রাকৃত আনন্দ—এর বেশী বলতে যাওয়া ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।

প্রিয় আত্মন্—

সৎ হও—সুন্দর হও–প্রেমিক হও, দেখবে আনন্দ প্রতিষ্ঠিত—পরমেশ্বরের করুণা অপার। ওঁ শান্তি—ওঁ শান্তি—ওঁ শান্তি ॥

-পরিশিষ্ট-

চরৈবেতি

প্রিয় আত্মন্—

তুমি চল্‌ছ—তাই জীবিত, তাই তুমি জীবন ।

জড়েরা মৃত—আত্মবিস্মৃত, জড়েরা মৃতের সমতুল্য ।

এই বিশ্ব-সংসার স্রোতের মতো প্রবহমান,

একই উৎস হতে সুর, ছন্দ ও তালে প্রবাহিত হয়ে

ঐ মহসঙ্গীতের সুরে বিলীন হচ্ছে

আর ঐ মহাসঙ্গীত বেজে চলেছে অনাদি অনন্তকাল ধরে ।

সময় তার নিকটে তুচ্ছ, ক্ষণিক—স্বপ্নমাত্র ।

তুমি সেই অবিনাশী সত্তার প্রকাশ আর এই মহাবিশ্বের

প্রতিটি কণায় কণায় ঐ মহাসঙ্গীতের সুর বেজে চলেছে ।

প্রিয় আত্মন্‌—তোমার হৃদয়ের নিভৃত কুঞ্জে

ঐ সঙ্গীতের সুর বাজছে ।

তুমি উদ্দীপ্ত কর জীবনের প্রতি সুতীব্র ভালবাসা ॥

তুমি জেগে ওঠ জীবনের বোধে ।

তোমার জীবনসঙ্গীত তরঙ্গে তরঙ্গে—মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠুক ।

হে সাক্ষাৎ জীবনদেবতা, আলিপ্সার আবিলতামুক্ত তুমিই সেইপ্রথম প্রেম।

অন্ধ, জড় সুষুপ্তি হতে উঠে আসা তুমিই সেই প্রথম প্রজ্ঞা বা জ্ঞান ।

বিস্মৃতির অতল হতে উঠে আসা তুমিই সেই আনন্দস্বরূপ পরম প্রকাশ ।

তুমিই সেই অমৃত, পরম আনন্দময় জীবন।

তুমি সেই মহাপ্রেমানন্দস্বরূপ—সার্বজনীন ও সাম্যের

সঙ্গীত দুই হস্ত তুলে গেয়ে চল।

তুমিই মহাকালের চেতনা ।

প্রিয় জীবন, তুমি পরমেশ্বরের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ।

তুমিই সেই মহাজ্যোতি, পরমেশ্বরের প্রথম পরম প্রকাশ ।

এই অন্ধকার সুপ্তির ভিতর তুমিই একমাত্র জীবিত।

জড়ের আবিলতা হতে তুমি জেগে ওঠো।

হে চৈতন্যময়—তুমি জেগে ওঠো।

নাটক

ছুটন্ত ঘোড়া

এই রুদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কবে শেষ হবে ?

জীবনটা জুয়াখেলা নয়,

স্বাস্হ্য—শক্তি—সৌন্দর্যের

লুকোচুরি খেলা ।

মৃত্যু আত্মগোপন করে আছে

জন্মগ্রহণ পর্ব থেকে।

কলুষকালো লুকিয়ে আছে

ঝলকিত আলোর ভিতর।

পাপের ইশারা দেখছি

পুণ্যার্থীর পুণ্য অর্জনে।

ক্ষণিক চোখবুজে বিচ্ছেদ-বিরাগ

ভালবাসার মোহবন্ধনে।

স্বচ্ছন্দে বিষাদের সুর বাজে

এটা বোধ হয় জীবন সংগীত ।

সমাধানের ভিতর রয়েছে সমস্যা

এটাই আসল কথা ।

অসহজ জীবনে অভ্যস্ত আমরা

সহজকে স্বীকার করিনি বলে ৷৷

যন্ত্রণা

( ১ )

নাড়া পড়ে উদাসী মনের বল্লা

দীনমনে ক্ষীণ অভিলাষ জাগে,

চিকুটিঘন ঝিঁঝির কান্নায়

আবেগ-মন্হিত অস্পষ্ট ধ্বনি শুনি,

পতঙ্গের রহস্যময় নৃত্যে—

হীনতার বন্ধন মুক্তির বেদনা,

বঞ্চনা—উদাসীন—অবিন্যস্ত

নিষ্ঠুর উদরের জ্বালা।

হায়, মাতৃজঠরের অব্যক্ত যাতনা

শিশুর চপল-চাঞ্চল্যে মাতৃ উদ্বেগ

জননী-জাতকে করুণ যাতনা

অজন্তার গুহাচিত্রে জীবনযন্ত্রণা।

এই দুরন্ত নদী, সর্বস্পৃহা সর্বগ্রাসী

বৈরাগ্যে বিমুখ, বৈচিত্র্যে তার মাধুর্য

সহজ ধারায় প্রবহমান জীবন

আবেগ-আচ্ছন্নতায় ঝরে রহস্যের বাণী ।

ঈর্ষা বেজে ওঠে ব্যথার সুরে

বিতৃষ্ণা বিরাগে পায় হাসি

ব্যথায় ব্যথা বাজে বন্ধু

সহজ আবেগ হাসি-কান্নায় ।

( ২ )

জীবন মানে না কেন ?

হতচ্ছাড়া ক্ষীণ দুরাশায় ধোঁয়াশা

শুধুমাত্র বাঁচার তাগিদ

কেবল বৃদ্ধির প্রবণতা ।

এই বিদগ্ধ জীবনের কাতর মুহূর্তে

নিদারুণ ক্ষুধা যেন তপ্ত অনল

চোখে ভাসে মরীচিকা তরঙ্গ

শুষ্ক ভদ্রতায়, মর্মে জাগে ভীরু উদ্বেগ।

দিয়েছিলে আশ্বাসের হাতছানি

বার্তায় বেজেছিল শেষ

হায় ! বুভুক্ষু লেলিহান সারমেয়

অপমানে শুধু পুচ্ছ নৰ্তন ।

অসহায় জনতা জনার্দন

ভঙ্গুর নিরাপত্তা দুরাশাময় জীবনে

রক্তচক্ষু আর তীক্ষ্ণ হুঁশিয়ারী

উদ্ধত তর্জনী পাশবিক গর্জনে ।

( ৩ )

অতীতের স্মৃতি সে আজ ক্ষীণ স্বপ্ন

বঞ্চনাপূর্ণ বিমর্ষ এই বর্তমান

কুহেলিকাঘন অদূর ভবিষ্যৎ।

হায় ! বালকদের প্রতিবিম্ব আলিঙ্গন।

কুব্জের চিৎশয্যা সে এক যন্ত্ৰণা,

তবু কেন শয়নাভিলাস ?

কুহকিনী বঞ্চকের ছদ্মবেশ নিয়ে

স্বাচ্ছন্দ্য প্রার্থনা— সেটা বিড়ম্বনা।

সভ্যতা ছলনা আর কান্না

ফাঁকিবাজির কালো দলিল

মেদমৈনাক স্হবির বিচরণ

তবু আকাঙ্ক্ষা, জীবনযন্ত্রণা।

(৪)

জমাট নিস্তব্ধ দাবানল জ্বলে

বিষাদের ঘন কালোছায়া নেমেছে

অনির্বচনীয় তীব্র দংশনে

অবসন্ন-নিমজ্জিত দেহ-মন।

অগ্নিশিখা জ্বলন্ত কামনা

ঈপ্সিত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা

অলাভে মানসিক উদ্বেগ

নিষ্করুণ যন্ত্রণা আর হতাশা।

বিরাগে দগ্ধ আধার

অসংযত রিপুর হুংকার

উষ্ণ বীর্যের উগ্র বিস্বাদে

ক্ষুব্ধ অশরীরী গর্জন ।

অভিভূত অসহায়

তমসায় তেজবিহীন সত্তা

অবিন্যস্ত চিত্তবিক্ষেপ

নির্বোধ কান্না প্রার্থনায়

হে জীবনদেবতা—

কাট কাপুরুষতার দীর্ঘ শৃঙ্খল,

ভাঙ সংশয়—উদ্বেগ—ভীতি,

যথেচ্ছ প্রমাদ আর সন্দেহ ।

ফিরে দাও সমৃদ্ধ বর্তমান

শান্তির অঙ্গনে আনন্দজীবন ৷৷

মেয়ে

মধ্যরাত্রির মেয়েরা এখনো

প্রভাতের মেয়ে হতে পারেনি,

বড় বিভূষিত তোমার উন্মুক্ত দৃষ্টি

কি করুণ তোমার উদার বেদনা !

উদাসভাবে চেয়ে থেকো না

আর ঐ আকাশের প্রতি।

মনের অবগুণ্ঠন খুলে ফেলো,

ঐ অলৌকিক অভিজ্ঞতা থেকে

সরে এসো তুমি।

অদৃশ্যলোক থেকে প্রেরণা এনে

প্রেরণার বন্যা বইয়ে দাও তুমি,

ছড়িয়ে পড়ুক মস্তিষ্কের কোষে কোষে ।

সমস্ত রহস্যময়তার অবসান করে

চূর্ণ করে দাও তুমি শতাব্দীর অভিমান

শ্রমক্লান্ত সৌন্দর্য ফুটে উঠুক—

তোমার দেহে—চোখে-মুখে ॥

হিমবান

পূর্ব-পুরুষদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি

কিন্তু নিয়মের অনুশাসনে বাঁধা আমি,

ঐ দেখ সংঘবদ্ধ হাতছানি

ইশারা করে ডাকছে আমাকে ।

সারি সারি শ্বেত-শুভ্র গর্বিত চূড়া

ঐ শীর্ষদেশে কেউ কি কখনো ওঠেনি ?

হয়তো উঠেছিল—

সংবাদ দেয়নি তারা নেমে এসে,

এখন আমি যাবো শীর্ষদেশে ।

উঃ ! আবার ডাকে—

ঐ পৃথিবী আমায় ডাকছে —

ফিরে আয়—যাস্না তুই,

ও ছলনাময়,

ওর ইশারায় ভুলিস্না ।

গড়িয়ে যাবে কত সহস্ৰ যুগ,

ঠাণ্ডায় হিম হয়ে জমে যাবি—

মুক্তি পাবি না কোনদিন।

প্রিয় আত্মন্—

পাথরের বুকে শুনতে পাচ্ছি দীর্ঘশ্বাস,

ইতিহাস কথা বলছে

আদিমতার মুখোমুখি হয়ে

মনের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি।

জীবন বড় জটিল, বড় গোলমেলে

একটা সর্পিল পাথুরে পাকদণ্ডি ।

মনে হয় মাঝে মাঝে

ভুলে থাকাই ভালো,

তবু জীবন উঁকি মারে বারে বারে

শুধু একটা নয়—অসংখ্য ।

লক্ষ লক্ষ বছর পিছনে

আলো-আঁধারির আদিমানব

পশু মেরে খেতো তারা,

নিজেও ছিল সে

আর একটা পশু ।

এটা কত দূর—

শেষ করা যাবে না,

আত্মবিস্মৃতির জমাট মেঘে

চুরি গেছে মানবের ইতিহাস

প্রিয় আত্মন্—

প্রাগৈতিহাসিকতা ছেড়ে এবার

যথার্থ ইতিহাসে পদার্পণ,

শুধু সংস্কারের স্মৃতিচিহ্ন ধরে এগুনো

চরৈবেতি—চরৈবেতি—চরৈবেতি।

আর নয়, ইতিহাস হতে

এবার এসো জীবনে।

আত্মিক স্তরে যোগসাজস

ঠিক যোগীদের ধ্যানের মতো ॥

ভরসা

মানুষের স্মৃতি বড় ক্ষণস্হায়ী

কখনও তা হয়ে ওঠে দীর্ঘস্হায়ী,

প্রতিহিংসা ঘৃণা আর সন্দেহেভরা সমাজ

এই প্রেমহীন রুক্ষ বিবর্ণ জীবনের ভিতর

তুমিই একমাত্র সুপ্ত কোমলতম বোধ ।

ক্ষমতা লোভ নিয়মানুবর্তিতায় আচ্ছন্ন

দৈনন্দিন জীবনে গোলকধাঁধার আবর্তে

তুমিই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় ।

চতুর্দিকে শুধু হাহাকার এই ধূধূ মরুভূমিতে

মরু-নির্ঝর গুল্মলতা হয়ে ফুটে আছ তুমি ।

যা আঁকড়ে ধরে একজন মানব

অনেক অনেক ক্ষুদ্রতা নীচতা—

স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে

গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে ॥

যোগ

ইতিহাসের আয়নায় ভাসে

কিংবদন্তির নায়করা

বাসনার চিরন্তন সহজাত ধারায় ।

তপ্ত দুধের ফেনার মত জড়িয়ে থাকে

মানুষের অনাদি উদগ্র কামনা,

রক্তাভ তপ্ত ফেনিল উদ্বেলতা নিয়ে

রুদ্ধ আবেগ গগন করে ওঠে।

ঐ অন্তঃস্হিত উচ্ছাস খরস্রোতা,

ঐ উদ্বেলিত বিরুদ্ধ আবেগ

অসহিষ্ণু তাপ বৃদ্ধি করে জীবনে ।

আত্মগত একাগ্র ভরাট চুম্বন

দিশেহারা করে অভাবী জীবনে ।

মানুষ সোহাগে অবসন্ন হয় ।

অনড় সংগোপনে বিশ্বাস বাঁধে

যা কেবল কুসংস্কার আর অভিমান,

ছিন্ন-ভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত জীবন

যন্ত্রণার মধ্যেও আছে

আনন্দাচ্ছন্ন অনুভূতি।

ইন্দ্রিয়রা এখন শ্লথ

প্রচ্ছন্ন বিরাগে ক্লিষ্ট,

নৈশব্দের মাঝে ক্রমে

স্হিত হয় বোধাবোধের অনুভূতি।

জীবনের গভীরে অধরাবোধ

সত্তার গভীরে এখন

বোধে বোধ ॥

ক্রন্দসী

স্মৃতি ও স্বপ্নের দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে

অথৈ জলরাশি—

সভ্যতার আড়ালে ঝরছে অঝোর কান্না ।

নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে

বিপুল বেদনা টন্‌ টন্‌ করে।

এই আমার বেদনাবিদ্ধ সত্তা

মেলে ধরেছি তোমার কাছে,

আড়াল করে কি হবে বলো ?

আর নয়—

এবার যাবো কোন নতুন ঠিকানায়,

একদিন হয়তো পাপড়ি হয়ে ঝরে যাবো—

ফুরিয়ে যাবে সব কিছু

থাকবে শুধু অনুভূতি।

একাকী

পাইনবনে পাতাঝরার মতো

দিনগুলো ঝরে যায়—একাকিত্বে,

গ্লোমা’র বুকে নিঃশব্দে স্রোতের ঢল নামে

ঐ শব্দহীন স্রোত বেয়ে জীবনের অনেকটা পথ

অনায়াসে পাড়ি দেওয়া যায়—

সে স্রোতের টান বড় বেশী।

শব্দহীন স্রোত হৈচৈ ফেলে না জীবনে,

শব্দহীনতারও একটা শব্দ আছে

একাকিত্ব জীবনকে সমৃদ্ধ করে ।

একাকিত্বের পথ বেয়ে একা একা চলো

মনের অনেক কাছাকাছি ।

হায় মানুষের ভিড় !

সেই স্রোতেও ভেসে পড়া যায়,

কিন্তু অন্তর-স্রোতের হদিস মেলে না ।

অন্তরে নিভৃত-কোণে গোপনে বইছে

সৌন্দর্যের চোরা স্রোত,

শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বইছে চোরা স্রোত ।

এসো সংগোপনে—একান্তে অবগাহন করি,

সুন্দর হয়ে উঠুক জীবন—

সুন্দর হয়ে উঠুক পৃথিবী ।

শৃণ্বন্তু বিশ্বে

প্রিয় আত্মন্‌—

পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছি

মৃতদের নিমিত্ত।

জীবিতরা পূর্ব হতে অনুগৃহীত।

আত্মবিস্মৃত মৃতেরা পুনরুজ্‌জীবন

লাভ করুক।

অমৃতস্য পুত্রাঃ —

হে অমৃতময় দিব্যজীবন ;

তুমি অমৃতের মূর্ত প্রকাশ ।

তোমাতে এত বিষাদ কেন ?

তুমি অমৃতের অধিকারী,

তবু কেন হাহাকার ?

কিসের অভাব তোমার ?

কি হারিয়েছ তুমি ?

সহজতা হারিয়েছ—

অসহজতা তোমায় করেছে গ্রাস—

পড়েছ আত্মবিস্মৃতির কবলে।

ভ্রমাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবন

আত্মবিস্মৃতি মহামৃত্যু

তোমাকে করেছে গ্রাস।

ওঠো—জাগো—

পুনরুজ্জীবন লাভ কর।

আমি অনন্ত জীবনের অধিকারী,

তোমায় জীবন প্রদান করব,

যে জীবন তোমার চির আকাঙ্ক্ষিত

পরমের সঙ্গে করাবে মিলন ।

সিদ্ধান্তের কথা বলব না,

সিদ্ধান্ত অনেক শুনেছ ।

উপদেশ দেব না,

উপদেশ অনেক পেয়েছ ।

না-কোন বাদ নয়—

বাদগ্রস্ত জীবনে

বিবাদ উপস্হিত হয়,

বাদের কথা বলব না।

জীবনের কথা বলব—

যা তুমি হারিয়েছ,

তা আমি খুঁজে পেয়েছি

তোমায় প্রদান করব পুনরুজ্জীবন ।

জীবনের কথা বলব—

সত্যই জীবন, ত্যাগই জীবন

সত্য—ত্যাগ—প্রেম—শান্তিই জীবন

মৃত কে ?

যে জীবনে সত্য নেই ।

যে জীবনে ত্যাগ নেই ।

যে জীবনে প্রেম নেই ।

যে জীবনে শান্তি নেই ।

সত্য—ত্যাগ—প্রেম—শান্তি

যেখানে প্রকটিত নয়,

সেখানে ধর্ম নেই—

সেখানে জীবন নেই।

জীবনের কথা বলব—

সদাচারে সত্য মূর্ত,

মিথ্যাচারে নয়।

সদাচারই জীবন।

জীবনের কথা বলব—

পরোপকারে ত্যাগ মূর্ত,

স্বার্থপরতায় নয়।

পরোপকারই জীবন ।

জীবনের কথা বলব—

ভালবাসায় প্রেম মূর্ত

পাশবিকতায় নয়।

ভালবাসাই জীবন।

জীবনের কথা বলব—

সংযমে শান্তি মূর্ত,

অসংযমে নয়।

সংযমই জীবন।

প্রিয় আত্মন্—

যা হারিয়েছ তা প্রাপ্ত হও ।

পুনরুজ্জীবিত হও।

আনন্দ প্রতিষ্ঠিত— পরমেশ্বরের মহিমা অপার ৷৷

ভুল

আজও ঠিক তাই

ভুল করে ভুল বুঝলে ।

ভুল করে ভুলে থাকবে

আর তুমি কতোদিন ?

হয়তো তুমি

সেদিন বুঝবে আমাকে

যেদিন আমার অশ্রু

তোমার আঁখিতে ঝরবে ॥

মার্জিত

গাম্ভীর্যপূর্ণ সুসংহত

আবেগজড়িত অস্পষ্ট

নিছক অঙ্গ সঞ্চালন ছাড়া

এটা আর কিছু নয়।

ঈষৎ—দীর্ঘ—অনেক—লঘু

এত বিস্তার না করলেই হতো।

নাটকীয়তা স্হান পাবে না

আকর্ষণ কিছুমাত্র কমবে না ।

দুঃখের দহনে অগ্নিশুদ্ধি

আত্মশুদ্ধির মহান ব্ৰত,

মহাসোপান বেয়ে উত্তরণ

সম্পূর্ণতার দিকে—

সাধনমন্ত্র প্রাপ্তি মন্ত্রের নাম–“ভা—ল–বা—সা ” ৷

গঙ্গাস্নান

দুর্গন্ধে-ভরা অশ্লীল

ঘৃণিত এই সমাজ

মানুষের শরীর পচে পচে

গলে গলে পড়ছে।

উদারতার ঢোলক বাজিয়ে

আর চাপা দিয়ো না তুমি,

অন্যায় আর অপরাধ।

প্রিয় আত্মন—

যদি পারো—

তবে গঙ্গার মুখ

ঐদিকে ঘুরিয়ে দাও,

ওর পবিত্র ধারায়

ধুয়ে যাক্—মুছে যাক্‌

যতোসব জীবনবিরোধী

অন্যায় অপবিত্র আবর্জনা ৷৷

অনুরোধ

সত্যের মুখোমুখি হও ।

মানবতার প্রতি পিছন ফিরে

কতদিন থাকবে ?

রক্তগঙ্গা অনেক বয়েছে,

নির্দোষের রক্ত

আর কত ঝরাবে ?

অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে

আর তুমি হেসো না,

মানুষকে কত কাঁদাবে ?

জীবনে হাসি ফোটাও—

চোখের জল মুছিয়ে দাও,

পৃথিবী অনেক কেঁদেছে

আর তুমি কাঁদিও না ৷৷

সহোদরা

‘মেয়ে মেয়ের শত্রু’

—এটি সুবিধাবাদীর প্রবচন,

ভাঙ্গতে পারো না তুমি—

ভগ্নির মর্যাদা দিয়ে

পরস্পরে ?

ঐ অসার যুক্তির ফাঁদে আর পা দিয়ো না তুমি,

জড়িয়ে যাবে।

অন্তরে সজাগ হও,

অদৃষ্টের দোহাই দিচ্ছ কেন ?

এবার ধুলো ঝেড়ে ফেলো,

কপালে করাঘাত করছ কেন ?

নিজের সাথে শত্রুতা কেন ?

—ওটি তোমার অপমান ।

প্রাচীনদের কাঁদুনি শুনছো,

সাবধান ! ঘুমিয়ে যাবে।

আর কতকাল এভাবে ঘুমাবে ?

—স্থূলতাবৃদ্ধি কেবল !

কলাবউ সাজা, স্তবস্তুতি শোনা

—কান বধির হয়ে যাবে যে !

প্রিয় ভগ্নি আমার !

হয়তো তুমি বলবে—

যুগ যুগ ধরে ওরা

তোমাদের পূজা করছে।

—ওটি হল ধর্ষণ শেষে

কালীমন্দিরে মাথা ঠোকা।

আর আপ্লুত প্রার্থনা—

‘মা জগদম্বে প্রসন্ন হও।’

আত্মরক্ষার অস্ত্র তুলে নাও,

আর অপেক্ষা কেন ?

ভাবছো পুরুষের সমান হবে ?

—কিন্তু ওটা হাস্যকর,

ওটা জৈবিক অসাম্য।

অপরের চোখে নিজেকে

আর দেখো না ।

যেটা হ্যাংলামি–তোমার অপমান।

ভেঙ্গে ফেলে দাও

অবাস্তব মেকী মূল্যবোধ,

ওর ভিতর রয়েছে—

তোমার অপমৃত্যুর ইঙ্গিত ৷

একটি রক্তচোষা বাদুড়—

মানুষ যাকে বলে ভ্যাম্পায়ার ।

অস্তিত্ব সচেতন জীবনের আলো জ্বালো,

স্বমহিমায় মহিমান্বিত হও ।

যখন তুমি আত্মমর্যাদা ফিরে পাবে,

আমি দুচোখ ভরে দেখবো তোমায়।

না, আমার মতো করে নয়—

ঠিক তোমার মতো করে ৷৷

বলিদান

বিবশতার ঘোর কাটছে

নবীন সূর্য উঠছে,

অদৃষ্টের হাতে আত্মসমর্পণ—

কভু আর নয়।

জীবনের পূজা শুরু হোক এবার

সৃজনাত্মক সংগ্রামশীল

সংঘর্ষময়তার পথ ধরে ।

সংকল্পবদ্ধ হয়েছি আমি

এই জীবনের

অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত ॥

পিপাসা

পাহাড়টা মান্ধাতার আমলের

প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখতাম ।

জীবন কেন এত সংক্ষিপ্ত ?

পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারপাশে ।

ঘিনঘিনে বমি-বমি ভাব

সবগুলো সরীসৃপ,

পোকা-মাকড়রা কিলবিল করে

আকাঙ্ক্ষা শিরায়-উপশিরায় ।

আর্তনাদ চাপা অন্ধকার

নিঃশ্বাসের স্পর্শ পাচ্ছি,

ও, পৃথিবী কি কালো !

আমাকে চেপে ধরেছে।

বার্ধক্যের ভীমরতি দশা

অসংখ্য পতনোন্মুখ জীবন,

আমি ফিরে পেতে চাই

পুনর্বার ঐ পুনপ্রাপ্তি।

হে প্রিয়তম—পরমজ্যোতি

মিলন অভিলষিত অভিসার

ক্ষুধিত আকাঙ্ক্ষা অসংখ্য

অখণ্ড নিবিড় বিশ্রাম ৷৷

স্বাধীনতা

ওঠরে বন্ধু ওঠ, উঠে পড় ।

দেখ চেয়ে সূর্য উঠে গেছে।

ও তিক্তশ্রম ক্রীতদাসেরা—

দীপ্ত হও ৷

ও দীপ্ত মানুষেরা—রাত্রির জড়তা কাটাও,

নিশার দুয়ার খুলে বাইরে এসো,

চোখ মেলে দেখ নতুন পৃথিবী ।

ঊষার পাখনায় ভর করে উড়ে চলো,

উড়ে চল উড়াল দিয়ে দিগন্তের পারে—

টান টান্ চেয়ে দেখ আকাশের পানে,

রৌদ্রময় প্রভায় আকাশ কি উদার !

চেয়ে দেখ ঝলমলে সুদীপ্ত আকাশ,

আহা, সোনাঝরা জীবনে মুক্তির স্বাদ ॥

বর্তমান

রসাতলের তলানিতে ঠেকেছে জীবন

স্বপ্নভঙ্গ-জীবনে এমন করুণ দুর্দশা কেন ?

অক্টোপাশের কাঠিন্যে আলিঙ্গনবদ্ধ

বিষক্রিয়া সঞ্চারিত হচ্ছে অণুতে পরমাণুতে ।

অবক্ষয়ের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে

নিরবধি সকরুণ আবেদন ।

ঠিক এর পাশাপাশি বসে

সংকট মুক্তির ভিতর দিয়ে এবার হবে

উত্তরণের সিঁড়িভাঙার পালা।

এখনো অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে

নিঃসঙ্গ নীরবতায় বসে বসে অবসর যাপন ?

—এটা নিছক ভাবালুতা মাত্র ।

জানি—প্রাত্যহিক কর্মমুখর জীবনে

কিছুটা সময় ঘিরে

মানুষ স্বস্তি খুঁজে পেতে চায় ।

অশান্ত স্রোতের শরীরে

শরীর এলিয়ে দেবার মতো

রসাতলের সহজ রাস্তা আর আছে নাকি ?

ভবিষ্যতের ধূসর চিন্তা নিয়ে

এখন মাথা ঘামাবার অবসর কোথা,

আর প্রয়োজনই বা কিসের ?

বর্তমানকে মূলধন করে

এগিয়ে যাই চলো—

চরৈবেতির চিকন রেখাটি ধরে

চলো আমরা এগিয়ে যাই ॥