প্রশ্ন—আপনি ইতিপূর্বে বাউল মতের সাধনাপথে তিনটি অবস্থাভেদের বর্ণনা প্রসঙ্গে যে বহিরঙ্গা মায়াশক্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন। —তা আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি আপনি ঐ সম্পর্কে যদি বিস্তৃত আলোচনা করেন, আমার ধারণা পরিষ্কার হয়।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ !আমি আলোচনা করছি, তুমি শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রবণ কর।
তোমার নিশ্চয় মনে আছে শক্তি ও শক্তিমানের পার্থক্য বর্ণনার সময় বলেছিলাম—শক্তিমান হল নিস্তরঙ্গ (static) আর শক্তি হল তরঙ্গায়িত (Dynamic) এই শক্তির ক্রমসংকোচ এবং ক্রমবিকাশ রূপ দুটি অবস্থা আছে । কিন্তু শক্তিমানের স্থিতির কদাচ কোন পরিবর্তন হয় না। শক্তিমান নিতাই সাক্ষীরূপে আপন শক্তির এই সংকোচ ও বিকাশরূপ খেলা দেখতে থাকেন
স্বরূপ শক্তির সংকোচ অবস্থায় শক্তি স্বরূপে লীন হয়ে যায় এবং প্রসারণ অবস্থায় তা পুনরায় স্বরূপ শক্তি হতে প্রসারিত হতে থাকে। অর্থাৎ ক্রমবিস্তার হল অবরোহ এবং ক্রমসংকোচ হল আরোহ । এইভাবে স্বরূপ শক্তির অবরোহ ও আরোহ ক্ৰমে একটি বিবর্তন সম্পূর্ণ হয় । এটাই হল পরমেশ্বরের বিবর্তন বিলাস বা লীলাবিলাস ।
যিনি আপন স্বরূপ শক্তি সহায়ে আপনি আপনাকে বোধে-বোধ করেন বা আপনি আপনার রসমাধুর্য আস্বাদন করেন, তিনিরসরাজ—পরম রসিক। তিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ, সং—সন্ধিনী, চিৎ —সম্বিং এবং আনন্দ——হলাদিনী।
তাঁর অনন্ত শক্তির মধ্যে স্বরূপ শক্তি হল প্রধান। এই স্বরূপ শক্তি যথাক্রমে অন্তরঙ্গা, বহিরঙ্গা এবং তটস্থা নামে পরিচিত । এইগুলি যথাক্রমে চিৎশক্তি, মায়াশক্তি এবং জীবশক্তি নামে অভিহিত ।
অব্যাকৃত আকাশের ভিতর ঐ মায়াশক্তির বিস্তার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাও প্রকাশিত হয়। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যে মহাশূন্যে প্রকাশ পায়, তাই অচিদাকাশ —অব্যাকৃত আকাশ ।
এটাই পরমেশ্বরের বহিরঙ্গা মায়াশক্তি, যার বিস্তার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা প্রাকৃত জগৎ প্রকাশিত ও প্রতিভাত হচ্ছে।
পরমেশ্বরের অন্তরঙ্গা শক্তি অর্থাৎ চিৎশক্তি চিদাকাশের ভিতর। ঐ চিৎ-শক্তির বিস্তার দ্বারা অনন্ত বৈকুণ্ঠ প্রকাশিত হয় অনন্ত বৈকুণ্ঠের সমষ্টি যা তাই মহাবৈকুণ্ঠ, যা অপ্রাকৃত ভগবৎলীলাধাম। এই ভগবৎলীলাধাম যে আকাশে বিদ্যমান তাই চিদাকাশ।
সুতরাং পরমেশ্বরের অন্তরঙ্গা শক্তি বা চিৎশক্তির বিস্তারে ভগবৎ লীলাধাম সকল প্রকাশিত বা প্রতিভাত হচ্ছে।
পরমেশ্বরের স্বরূপ শক্তির আর একটি হল তটস্থা শক্তি বা জীবশক্তি। যা জীবাণু বা অণুচৈতন্য—যাকে জীবাত্মা বলা হয় ৷
এই জীবাত্মা বা অণুচৈতন্য, অন্তরঙ্গা ও বহিরঙ্গার মধ্যবর্তিনী— সেই জন্যই একে তটস্থা অবস্থা বলে।
এই জীবাত্মা যখন মায়াশক্তির রাজ্যে অবস্থান করে তখন সে মায়ার প্রভাবে জীবত্বের অভিমান দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে প্রাকৃত সংসারের সুখ-দুঃখ-রূপ ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করে থাকে ।
বহিরঙ্গা জীব বহিরঙ্গা মায়া শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে থাকে এটা অভাব স্থিতি, অর্থাৎ আনন্দস্বরূপ হয়ে বহিরঙ্গা মায়াপ্রভাবে ভ্রান্তিবশতঃ আনন্দের অভাব অনুভব করে এবং অভাবে চঞ্চল হয়ে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করে অর্থাৎ সংসার-চক্রে যাতায়াত করে। এইজন্য এই স্থিতিকে অভাব স্থিতি বলা হয়।
ঐ ভগবৎ-বিমুখ জীবাত্মা আবার যখন গুরুকৃপায় বা ভগবং কৃপায় ঈশ্বরাভিমুখী হয়, তখন বহিরঙ্গা মায়ার ছায়া তার স্বরূপ হতে অপসারিত হয়, তখন সে আবার সমস্ত আনন্দ ফিরে পায়। অর্থাৎ নিজের স্বরূপভূত আনন্দ ফিরে পায়। এটা স্বভাব অবস্থা তখন বহিরঙ্গা মায়ার রাজ্য হতে জীবাত্মা অন্তরঙ্গা চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ করে অর্থাৎ অভাবের স্থিতি হতে স্বভাবের স্থিতিতে প্রবেশ করে । এই রাজ্যে প্রবেশ করলে জীবাত্মা স্বরূপ শক্তির অনন্ত বিলাসের বোধেবোধ করে থাকে। বস্তুতঃ চিৎশক্তির বিলাস জীবাত্মার আনন্দবর্ধনে নিযুক্ত থাকে।
প্রিয় আত্মন্ ! ঐ অণুরূপ জীবাত্মা বিভুচৈতন্য পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত না হলে, নিত্যলীলার আস্বাদন লাভ করতে পারে না। অর্থাৎ অণুচৈতন্য বিভূচৈতন্যের সঙ্গে যোগাবস্থাতেই ঐ পূর্ণানন্দ অনুভব করে। এটাই প্রকৃত স্বভাব অবস্থা ৷
সুতরাং অণুরূপী অংশ বিভুরূপী অংশীর সঙ্গে মিলিত না হলে নিত্য-লীলার আস্বাদন কে গ্রহণ করবে ? এই লীলা-বিলাস নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে তারই জন্য
অথচ জীব, জীব থেকে অর্থাৎ জীবত্ব অবস্থায় এই লীলাভোগেরঅধিকারী নয় । প্রয়োজন জীবত্ব বলি অর্থাৎ জীবের আত্মবলি পূর্ণ না হলে আত্মপ্রতিষ্ঠা হয় না। আর যতক্ষণ জীবত্ব ততক্ষণ এই লীলায় প্রবেশাধিকার হয় না। তার
প্রিয় আত্মন্ ! স্বভাবের চরম পরিণতি মহাভাবে। যে অবস্থায় অনাবিল, উল্লাসময় লীলারস মাধুর্যের আবির্ভাব হয় । যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না—তা কেবল অপরোক্ষ অনুভূতিসাপেক্ষ ।
প্রিয় আত্মন্ ! অচিদাকাশ এবং চিদাকাশ অর্থাৎ বহিরঙ্গা মায়াশক্তি এবং অন্তরঙ্গা চিৎশক্তির বিস্তার বা বিলাস আকাশদ্বয়ের মধ্যে হয় । এই উভয় আকাশের মধ্যবর্তী সাম্যরূপ এক শুদ্ধশক্তি বিরাজ করছে তার নাম ‘বিরজা নদী’। জীবকে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করতে হলে অণ্ড, পিণ্ড এবং ব্রহ্মাণ্ড হতে উত্তীর্ণ হয়ে বিরজাতে স্নান করতে হবে আর সেখানে স্কুল, সূক্ষ্ম এবং কারণ-রূপ তিনটি শরীরকে বিসর্জন দিয়ে বিরজা হতে উত্থিত হতে হবে।
এখন বুঝলে ত্রিশরীর চিরতরে বিসর্জন দিয়ে সেখান হতে বিশুদ্ধ সত্ত্বময় অপ্রাকৃত ভাগবতী তনু বা শরীর নিয়ে পুনরুত্থান এবং নিত্যলীলায় বা রসলীলায় প্রবেশ। এই হল মহাভাব ।
প্রাকৃত শরীর এবং ইন্দ্রিয় নিয়ে রাসলীলায় প্রবেশ করা যায় না। একমাত্র অপ্রাকৃত ভাগবতী শরীর নিয়েই রাসে প্রবেশ করতে পারা যায়। এটাই মহাভাব বা রাধাভাব ।
প্রাকৃত বুদ্ধি বিশিষ্ট মানব এইসব ধারণা করতে পারে না কারণ এটা অপ্রাকৃত।
এখন বুঝলে তটস্থ জীব যখন মায়ার রাজ্যে অবস্থান করে— তখন সেই মায়ার প্রভাবহেতু সে নিজে আনন্দস্বরূপ হয়েও ভ্রান্তিবশতঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে আনন্দের অনুসন্ধান করতে থাকে এবং ইতস্ততঃ ভ্রমণ করতে থাকে জন্ম-মৃত্যুর ভিতর দিয়ে দেহ হতে দেহান্তরে। । ঐ জীবের যখন গুরুকৃপায় বিবেক জাগ্রত হয়, তখন বহিরঙ্গা মায়ার রাজ্য হতে অর্থাৎ বহিমু খীভাব হতে অন্তর্মুখী হয় অর্থাৎ অন্তরঙ্গা চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ করে। এটাই হল জীবের আত্যন্তিক দুঃখ-মুক্তি বা মোক্ষ ৷
বহিরঙ্গা মায়ার ছায়া যখন তার স্বরূপ হতে অপসৃত হয় তখন সে আবার স্বরূপানন্দ ফিরে পায়। আত্যন্তিক দুঃখ চিরতরে দূরীভূত হয়। এবং তখন সে আপন স্বরূপানন্দে মগ্ন থাকে । এই অবস্থাই মুক্তি বা মোক ।
প্রিয় আত্মন্ ! এখন নিশ্চয় বুঝলে, বহিরঙ্গা মায়ার রাজ্যে যতক্ষণ, ততক্ষণ অভাবস্থিতি বা বদ্ধতা। অন্তরঙ্গা চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ হলে স্বভাবস্থিতি—এটা মুক্তস্থিতি বা মোক্ষ ৷
এরপর অপ্রাকৃত ভাগবতী শরীর নিয়ে বিরজা হতে পুনরুত্থানহলেই মহাভাবে প্রবেশ লাভ হয় ।
প্রশ্ন— মানব তথা জীব আনন্দস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও ঐ আনন্দ হতে বঞ্চিত হয়ে অভাব স্থিতিতে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে, কিভাবে সে ঐ অভাব স্থিতি হতে স্বভাবে স্থিত হয়ে পরিশেষে মহাভাবে উত্তরণ করে আপন মাধুর্যরস আস্বাদন করতে সক্ষম হবে ?—এই সম্পর্কে আরও কিছু শুনবার প্রবল আগ্রহ হচ্ছে যদি তা বলেন তো নিজেকে ধন্য মনে করি!
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! আমি ঐ বিষয় সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনা করছি, তুমি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়ে তা শ্রবণ কর।
মাধুর্যরস আস্বাদন করবার আকাঙ্ক্ষ। সংসারের প্রতিটি জীবের।সেই জীবগণের ভিতর আবার অতি শ্রেষ্ঠ জীব মানব কারণ ভগব তত্ত্ব বোধেবোধের জন্য একমাত্র তারাই উপযুক্ত। কারণ তারা উত্তম অঙ্গ প্রাপ্ত হয়েছে। সেইহেতু সংসারে প্রতিটি মানব জ্ঞাতসারে কিংবা ত অজ্ঞাতসারে চাচ্ছে ঐ রসের আস্বাদন কিন্তু আস্বাদন করবার সামর্থ্য জীবের নেই। সেইহেতু আস্বাদন করতে গিয়ে জীবের যৌবন পুড়ে যায়। জীবন খসে পড়ে ৷ তবুও রসাস্বাদন হয় না ৷ তার কারণ জীব সচল বিন্দুকে অটল করে প্রকৃতি-সঙ্গে সেই অটলতা রক্ষা করতে পারে না। সেই কারণেই তার রসাস্বাদনের পূর্ণতা নেই। পূর্ণতার অভাবে তৃপ্তি-অতৃপ্তির বেগ নিয়ে অপূর্ণতাবশতঃ হাহাকার করে—কষ্ট পায়। এটাই অসহজতা, স্বভাব বিকৃতির কারণও এটা । সংসারে যাবতীয় দুর্ঘটনার মূলে এই বিকৃতি।
আর এই স্বভাব-বিকৃতি হেতু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দ্বন্দ্ব, পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়। মানব জীবনের বিপর্যয়ের মূলেও এই স্বভাব-বিকৃতি। স্বভাব বিকৃতিই মানবকে করে দানব, সে পরিবারের অন্য সকলের অশান্তির কারণ হয়ে পড়ে, সামাজিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় আর পৃথিবীতে অধিক অশান্তি উৎপন্ন হয় ।
অসহজতা হতে সহজতায় উত্তরণই হল জীবনের কলা ৷ মানৰ যখন সহজতাকে আশ্রয় করে, তখন সমস্ত বিকৃতির সূচনা বা সূত্রপাতের অভাবহেতু সে সহজ সাবলীল ধারাতে—স্বতঃস্ফূর্ত জীবনে উপস্থিত হয়—এক অপূর্ব রূপান্তর ঘটে থাকে—এই হল স্বভাবের জাগরণ । তার পর নিদ্রিত সুপ্ত মহাভাৰ ঐ স্বভাব হতেই জাগ্রত হয়ে উঠে আর এই রূপান্তর নিয়ে আসে জীবনে অদ্ভুত পরিবর্তন ।মানব হয়ে উঠেন মহামানব। যেমন কয়লা রূপান্তরিত হয়ে হীরাতে পরিণত হয় সেইরূপ অসহজ বিকৃত স্বভাববিশিষ্ট পশুমানব রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হন মহাভাবময় দিবা প্রেমাপ্লুত মহামানবে। ঐ মহামানবগণই পৃথিবীর জীবনস্বরূপ । এঁরাই সর্বজীবের আদর্শ এবং এ দের স্থিতিলাভই উদ্দেশ্য । এদের আবির্ভাবে পৃথিবীর জীবনীশক্তি বর্ধিত হয়—মানুষ প্রকৃত জীবনের তাৎপর্য এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পায় । এখন বুঝলে তো যে, বিকৃত বিফল স্বভাবকে সহজতা অবলম্বন করে বিকৃতিহীন সহজ স্বভাবে পরিণত করতে হবে । আর ঐ স্বভাবেই জাগ্রত হবে মহাভাব যা আনয়ন করবে মানবে রূপান্তর সমাজে রূপান্তর ও জগতে রূপান্তর।