প্রিয় আত্মন্,
সৃষ্টির আদি বা মূল হল রস। সেইজন্য বাউলগণ আদিরসকে কাম বলে থাকেন। আদিরস বা কামতত্ত্বই হল সৃষ্টির মূল রূপ । তাপ্রশ্ন – আপনি আদিরস বা কামতত্ত্ব বিষয়টি যদি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন তাহলে ঐ সম্পর্কে আমার ধারণা পরিষ্কার হয় । উত্তর- প্রিয় আত্মন,
আমি ঐ আদিরস বা কামতত্ত্ব বিষয় সম্পর্কেই বিস্তারিত বর্ণনা করছি। আর তোমার নিশ্চয় মনে আছে—আমি ইতিপূর্বেও কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব এবং মদনতত্ত্ব বা রতিরহস্য সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে- ছিলাম এবং এই সম্পর্কে পরে তোমায় বিস্তারিত বলব বলেছিলাম ।
প্রিয় আত্মন,এই কাম হল ত্রিগুণাতীত – মায়াতীত – দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত শুদ্ধ-দিব্য-প্রেমস্বরূপ। আর এই কাম বা রসই হল পরমরসিক শেখর রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ। সেইজন্য বাউলগণ বলেন – শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বটি হল অপ্রাকৃত কামতত্ত্ব –কামবীজ ও কামগায়ত্রী যার স্বরূপ এবং তা সহজ- সাধক ভিন্ন অন্য কেহ বুঝতে পারে না ৷
আর ঐ কামের শক্তি হল রতি। শক্তি ও শক্তিমান অভেদ। সুতরাং রস ও রতি হল অভেদ।
শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব যেমন কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব ; তেমন শ্রীরাধাতত্ত্ব হল মদনতত্ত্ব বা রতিতত্ত্ব । একটি রসরাজ রসিকশেখর আর অন্যটি রতি বাহলাদিনীস্বরূপিণী মহাভাব। রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ এবং মহাভাব স্বরূপিণী শ্রীরাধা অর্থাৎ রস ও রতি – এটাই হল কামবীজ—কামগায়ত্রী রহস্য। আর ঐ রস ও রতির একীভূত অবস্থায় বাউলমতে মহা উল্লাসময় লা মাধুর্যরস আস্বাদন হয়ে থাকে।
বাউলগণ বলে থাকেন :— প্রাকৃত কাম বর্জন করতে না পারলে
অপ্রাকৃত কামের কোন সন্ধানই পাওয়া যাবে না। শ্রীকৃষ্ণই অপ্রাকৃত কাম এবং শ্রীরাধাই অপ্রাকৃত রতি এবং রতির খেলাই হল নিতারকারনে নিত্যরাসলীলা, যেখানে রস রতিকে আশ্রয় করে আপনি আপনার রসমাধুর্য আস্বাদন করছেন ৷
পূর্বেই বলেছি রাধা এবং কৃষ্ণ একই তত্ত্বের দুটি দিক–এতে কোন ভেদ নেই আবার আত্যন্তিক অভেদও নেই। ভেদ এবং অভেদ যুগপৎ বিদ্যমান। তাই একে ‘যুগলতত্ত্ব’ বলা হয়।
‘এক’ এবং ‘বড়’র মধ্যবর্তী অবস্থা হল “দুই” — আর এই ‘দুই’কেআশ্রয় না করলে ‘এক’ কখনও বহুরূপে প্রকাশিত হতে পারে না।
এইজন্য বছর অবস্থাতেই ভেদ পরিদৃশ্যমান হয় কিন্তু যখন ভেদ অপসারিত হয়, তখন যাবতীয় ভেদ অভেদের মধ্যেই একাত্ম হয়ে থাকে।
সুতরাং যেখানে কেবল একই সত্তা এবং যেখানে একের মধ্যে দ্বিতীয়ের আভাস বিদ্যমান থাকে না, সেখানে এক নিজেকে অপরোক্ষ অনুভব করতে পারে না। আর তা চিৎ-স্বরূপ হলেও চেতন নয়। কারণ আপন স্বরূপ সে আপনি বোধেবোধ করতে পারে না ঐ অবস্থাতে। আর বোধেবোধ বা আত্ম সাক্ষাৎকার ব্যতীত আনন্দের আস্বাদনও নেই ।
তাই এক অবিভক্ত সত্তার মধ্যেই দ্বিতীয় সত্তার স্ফুরণ হয়ে ঐঅবস্থায় আনন্দের আস্বাদন হয়ে থাকে। এইজন্যই বাউলগণ বলেন- নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যলীলাবিলাস অনন্তভাবে অনন্তরূপে নিত্য-নূতনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আর পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ আপন স্বরূপশক্তি হহ্লাদিনী স্বরূপিণী মহাভাবরূপা শ্রীরাধাকে দিয়ে নব নব লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করছেন। সহজিয়া বাউলগণ বলেন – এটাই নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যরাস ।
বাউলমতে প্রকৃতির এই যে বিশ্বসৃষ্টি তা একমাত্র রমণের জন্য । উপনিষদের মধ্যেও আমরা দেখেছি—সমগ্র সৃষ্টির মূল হল ব্রহ্ম’র রমণ। সমস্ত রসের মধ্যে শৃঙ্গার রসই শ্রেষ্ঠ এবং প্রকৃতি হল শৃঙ্গার রসের আধার । শৃঙ্গার রসমাধুর্যের মধ্যে প্রকৃতির মূল সত্তাটি নিহিত রয়েছে। এটাই একাধারে আনন্দবিলাস বা রসরতিবিলাস । তাই প্রকৃতি একাধারে জননী এবং রমণী।
ঐ একই লীলাকারী পরমসত্তা দুই দেহে প্রচ্ছন্ন থেকে লীলারস আস্বাদন করেন । এই বিষয়ে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করছি, ধৈর্যপূর্বক শ্রবণ কর ।
কামতত্ত্ব’র স্ফুরণ হওয়া মাত্রই এক অদ্বৈত-বিন্দু দুইরূপে প্রকাশিত হল, একের সহিত দুইয়ের সম্বন্ধ স্থাপিত হল । ‘আকৃষ্য ও আকর্ষক সম্পর্ক’ শুরু হল। একই অদ্বৈত বিন্দু হতে বিন্দুদ্বয়ের নির্গমন হতে লাগল। পুনরায় ঐ বিন্দুদ্বয় সংকুচিত হয়ে ‘একে’তে লীন হতে লাগল । এই হল ‘বিন্দু বিসর্গের খেলা’। বিন্দু হল চিৎ এবং বিসর্গ হল আনন্দ —এই তত্ত্ব উপনিষদেও ব্যক্ত হয়েছে।
‘আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাং ।
আনন্দাদ্ধ্যের খম্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
আনন্দেন জাতানি জীবস্তি।
আনন্দং প্রত্যভিসংবিশন্তীতি।’ *
[* ‘আনন্দই ব্রহ্ম ( ভৃগু ) ইহা জানিলেন। কারণ আনন্দ হইতেই এই ভূতবর্গ জাত হয়, জাত হইয়া আনন্দের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে আনন্দাভিমুখে প্রতিগমন করে ও আনন্দে বিলীন হয়।’ — তৈত্তিরীয়োপনিষৎ (৩। ৬) ]
শৈব এবং শাক্তগণ বিন্দুকে শিব এবং বিসর্গকে শক্তি বলে থাকেন।বৈদিকগণ বিন্দুকে জ্ঞান বা প্রকাশ এবং বিসর্গকে কর্ম বা বিমর্শ বলে থাকেন। যোগিগণ বিন্দুকে পরমচৈতন্য এবং বিসর্গকে প্রকৃতি বলে থাকেন। এইরূপ বৌদ্ধগণ বিন্দুকে মহাশূন্য এবং বিসর্গকে মহাসুখ বলে থাকেন। সহজিয়া বাউলগণ এই বিন্দু-বিসর্গের খেলাকে নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যরাসলীলা বা শ্রীরাধাকৃষ্ণের ‘কামকলা বিলাস’ বলে থাকেন। আর এই কামকলা বিলাস হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের ‘শৃঙ্গার-ক্রীড়া’ বা ‘রসরতি তত্ত্ব বলে আলোচিত হল প্রিয় আত্মন,
ঐ ক্রীড়া হতে নিরন্তর ‘বাষ্পোদগমের ন্যায় আনন্দ রসের নির্গমন হচ্ছে এবং তা প্লাবিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে সঞ্চারিত হচ্ছে। ঐ বিন্দু-বিসর্গের ক্রীড়া হতে যে অমৃতস্রাব হচ্ছে তাই শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলনজাত রস প্রবাহের নামান্তর।
বিন্দু-বিসর্গ খেলায় সংঘর্ষজনিত যে আনন্দ রসের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে তা-ই মহা উল্লাসময় রসমাধুর্য । আর তা-ই নিন্দের নন্দন ।
এখন বুঝলে তো শৃঙ্গারাত্মক কামকলা-বিলাস কি। রসিক বৈষ্ণব- গণ একেই ‘উজ্জ্বল রস’ বলে বিশ্লেষণ করে থাকেন।
প্রিয় আত্মন্, সহজিয়া বাউলমতে পরমেশ্বরের অঙ্গকান্তি হল ব্রহ্ম। তাঁরা বলেন ব্রহ্ম জ্যোতিঃস্বরূপ। একেই নিরঞ্জন বলে। যোগী, সিদ্ধ ও মুক্তগণ এই জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মতেই চিত্ত প্রণিধান করেন।
তাঁদের মতে শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণব্রহ্ম। তিনি সনাতন দ্বিভুজ নরাকার। তিনি ব্রজপুরে অর্থাৎ সহজপুরে – নিত্যবৃন্দাবনে নিত্য বিহারশীল । তিনি চিরকিশোর। আর তাঁর অঙ্গছটাই হল জ্যোতিব্রহ্ম। চরাচর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর ঐ অঙ্গছটারূপ জ্যোতিব্রহ্ম হতেই সৃষ্ট হয়ে থাকে।