প্রশ্ন –এখন আপনি অনুগ্রহ করে ‘দেহতত্ত্ব’ বিষয়ে আমাকে কিছু বলুন ?

উত্তর –প্রিয় আত্মন ! তোমাকে ‘দেহতত্ত্ব’ সম্পর্কেই বলছি, তুমি অতি মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ কর।

বাউল মতে মানব দেহের মধ্যে চারিটি সরোবর আছে। এইগুলি যথাক্রমে কাম সরোবর, মানস সরোবর, প্রেম সরোবর এবং অক্ষয় সরোবর। উক্ত সরোবরগুলির মধ্যে ‘কাম সরোবর’ ও ‘মানস সরোবর মানব দেহের বামার্ধে অবস্থিত, যা প্রকৃতি অঙ্গ নামে পরিচিত এবং ‘প্রেম সরোবর’ ও ‘অক্ষয় সরোবর’ মানব দেহের দক্ষিণার্ধে অবস্থিত যা পুরুষ অঙ্গ নামে পরিচিত। বাউল মতে ‘অক্ষয় সরোবর’টি সহস্রদল কমলেরই নামান্তর। ঐ সহস্রারেই ‘অক্ষয় সরোবর টি অবস্থিত, যেখানে নিত্যের মানুষ বা সহজ মানুষ বাস করেন। যেখানে জরা, মৃত্যু ও কালের কোন প্রকার বিক্রম নেই। ঐ স্থান জন্ম-মৃত্যু রূপ আবর্তনের ঊর্ধ্বে এবং চতুর্দশ ভুবনের পরপারে ।

‘প্রেম সরোবর’- যার অবস্থান দ্বিদল পদ্মে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে। অনাহত চক্রের দ্বাদশদল কমলের মধ্যে ‘মানস সরোবরের অবস্থিতি এবং স্বাধিষ্ঠান চক্রের ষড়দল কমলের মধ্যে ‘কাম সরোবর’ বিরাজমান।

সুতরাং মানবদেহের সহস্রার চক্র হতে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত পুরুষ অঙ্গ এবং আজ্ঞাচক্রের নিম্ন প্রদেশ হতে মূলাধার চক্র পর্যন্ত প্রকৃতি অঙ্গ ।নরনারী নির্বিশেষে প্রতিটি শরীরে প্রকৃতি ও পুরুষের অবস্থানের ও পরিচিতির একই রূপ ।

বাউলগণ বলেন- অক্ষয় সরোবর হতে প্লাবন এসে বিরজাতে* [* বিরজা সূর্যের মানসী কন্যা, নামান্তরে যমুনা । (১)―কেহ কেহ বলেন শতদল (২)—কেহ কেহ বলেন অষ্টদল৷] পতিত হয়। বিরজার প্রবাহ ‘প্রেম সরোবর’ পর্যন্ত। পুনরায় ঐ প্রবাহ প্রেম সরোবর হতে উল্লসিত হয়ে রেবাতে পতিত হয়। রেবার প্রবাহ ‘মানস সরোবর পর্যন্ত। মানস সরোবর হতে ঐ প্রবাহ উচ্ছ্বলিত হয়ে নর্মদায় পতিত হয়। নর্মদার প্রবাহ ‘কাম সরোবর’ পর্যন্ত। এইভাবে ক্রমানুসারে বিরজা হতে রেবাতে এবং রেবা হতে নর্মদায় বন্যা এসে ‘কাম সরোবরে পতিত হয় ।

বাউলগণ বলেন যদি ঐ ধারাকে বাঁধ দিয়ে অর্থাৎ যোগসাধন ক্রিয়া দ্বারা ঊর্ধ্ব মুখী করা যায় তাহলে মনের মানুষ বা সহজ মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।

সহস্রার চক্রে ‘অক্ষয় সরোবরে’ সহস্রদল কমল শোভিত আছে। আজ্ঞাচক্রে ‘প্রেম সরোবরে দ্বিদল কমল বা পারিজাত শোভিত আছে ৷ অনাহত চক্রে ‘মানস সরোবরে’ দ্বাদশ দল কমল শোভা পাচ্ছে এবং স্বাধিষ্ঠান চক্রে ‘কাম সরোবরে যড় দল কমল শোভিত আছে। সহজিয়া বাউলগণ বা রসিকগণই কেবলমাত্র এইসব বোধ করে থাকেন। প্রিয় আত্মন, সহজিয়া বাউলগণ এইভাবে মানব শরীরের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে থাকেন।

তোমাকে পূর্বেই বলেছি যে, সহজিয়া বাউলগণ বলেন যে সহজ সাধনা বা রসতত্ত্বের বেদে কোন স্পষ্টতর উল্লেখ নেই। কিন্তু তন্ত্র আদি কিছু আগম শাস্ত্রে এর বিশেষ উল্লেখ আছে। সুতরাং এটা অতি গুহ্য বিষয়, রসিক ভিন্ন রসতত্ত্বের মহত্ত্ব বুঝা অতি দুরূহ !

মানবদেহকে ঘিরেই সহজিয়া বাউলদের সাধনা। দেহের বাইরে তাঁদের কোনরূপ সাধনা নেই এবং শাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী ক্রিয়াকাণ্ড- সমন্বিত কোন আনুষ্ঠানিক ভজনাও তাঁদের নয়। বাউলদের সাধনা বাউলদেরই একান্ত নিজস্ব ৷

বাউলগণ বলে থাকেন – যা নেই ভাণ্ডে, তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে, যা আছেভাণ্ডেতে তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে। দেহের বাইরে বৈকুণ্ঠাদি কল্পনাকেবাউলগণ ‘অনুমান’ বলেন এবং নিজ নিজ দেহভাওকে তাঁরা ‘বর্তমান’বলেন । সুতরাং বর্তমান দেহ নিয়েই তাঁদের সাধনা, তাঁরা অনুমানসাধনা মানেন না।

প্রিয় আত্মন্ !

পরমেশ্বর প্রথমে একা ছিলেন –অখণ্ড—অদ্বৈত—পরম মহাচৈতন্যরূপে । কিন্তু তখন তিনি আপন মাধুর্যরস আস্বাদন করতে পারেন নি। সেইজন্য তিনি প্রকৃতিরূপে নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন এবং তা হতেই বিশ্বপ্রকৃতির উদ্ভব হল এবং তা থেকেই সমগ্র সৃষ্টি। ঐ পরম এক আনন্দরস আস্বাদনের জন্য নিজেকে দ্বিধাকরণ করে যে দুই সত্তায় পরিণত হলেন—তার একটি পুরুষ ( পরম পুরুষ ) আর অন্যটি প্রকৃতি (পরমা- প্রকৃতি )। উপনিষদেও এই তত্ত্ব উল্লিখিত হয়েছে—

“আত্মৈবেদমগ্র আসীৎ পুরুষবিধঃ …………

স বৈ নৈব রেমে তস্মাদেকাকী ন রমতে সদ্বিতীয়মৈচ্ছৎ ।

স হৈতাবানাস যথা স্ত্রী পুমাংসৌ সম্পরিষ্বক্তৌ

স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাহপাতয় ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাং ॥” *

[*“প্রথমতঃ এই জগৎ পুরুষাকার আত্মা ( বা বিরাট ) রূপেই ছিল ।— তিনি মোটেই আনন্দিত হইলেন না । এইজন্য কেহ একাকী থাকিলে সুখী হয় না। তিনি সঙ্গীর অভিলাষ করিলেন। স্বামী ও স্ত্রী আলিঙ্গিত হইয়া যে পরিমাণ হয়, তিনি সেই পরিমাণ হইলেন । তিনি সেই দেহকেই দুই ভাগে ভাগ করিলেন তাহা হইতে পতি ও পত্নী জাত হইলেন ।”   –বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ১/৪/৩ ]

প্রিয় আত্মন্ !এই পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে কখনই আত্যন্তিক ভেদ নেই। এঁরা একই স্বরূপের দুই অঙ্গ । তথাপি এরা পরস্পর বিরুদ্ধ কেবলমাত্র লীলানিমিত্ত ৷ পরস্পর বিরুদ্ধ সত্ত্বেও একে অপরের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন স্বীয় পূর্ণতার জন্য। কারণ একে অপর ভিন্ন অপূর্ণ। এইজন্য পুরুষ তাঁর পরিপূর্ণতার জন্য প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতি তাঁর পরিপূর্ণতার জন্য পুরুষকে কামনা করে থাকেন ৷

অতএব দুই নহে—দুই-এ মিলে এক। দুইটিই অর্ধাঙ্গ প্রকৃতি-পুরুষ রূপ দুইটি অর্ধাঙ্গের সমবায়েই একটি পূর্ণাঙ্গ। এই যে পুরুষ ও প্রকৃতির স্ব স্ব পূর্ণতার জন্য পরস্পরের দিকে ‘ঈক্ষণ” – এটাই হল সৃষ্টির মূল বা আদিরহস্য ৷