প্রশ্ন— আপনার নিকট হতে আমার বাউলতত্ত্বের রহস্য সম্পর্কে কিছু শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে কৃপাপূর্বক সেই সম্পর্কে আলোচনা করবেন কি ?
উত্তর— প্রিয় আত্মন !এখন তোমাকে ঐ বাউলতত্ত্বের রহস্য বিশদভাবে ব্যক্ত করছি, তুমি স্থির চিত্তে শ্রদ্ধাপূর্বক তা শ্রবণ কর।
বাউলগণ বলেন—যদি আত্মস্বরূপের বোধেরোধ করতে হয়, তাহলে মনের মানুষকে ধরতে হবে। আল্লা বা ভগবান বলে চিৎকার করলে তাঁকে জানা যাবে না। ভগবান বা আল্লা তোমার মধ্যেই বিরাজমান আছেন। যদি তাঁকে বোধেবোধ করতে, চাও, তাহলে কর্মময় যোগ- সাধনার প্রয়োজন। নিজের স্বরূপকে জানতে পারলেই তাঁকে জানা যাবে।
বাউলমতে পরমার্থ তত্ত্বের নাম ‘সহজ’। একে ‘সহজ মানুষ’ বা ‘নিত্যের মানুষ’ বলেও অভিহিত করা হয় এবং তিনি হলেন – অপ্রাকৃত নরাকার।
বাউলমতে এক অদ্বৈত পরমতত্ত্বই নিত্যযুগলরূপে স্ব-স্বরূপে স্বধাম নিত্য-বৃন্দাবনে বিরাজমান । ঐ একই তত্ত্ব নিত্যকৃষ্ণ এবং নিত্যরাধাযা নিত্যবৃন্দাবনে যুগলভাব ধারণ করে বিরাজিত আছেন। এই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চিরকিশোর এবং পরমাপ্রকৃতি শ্রীরাধা চিরকিশোরী। বাহ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং শ্রীরাধা প্রকৃতি, কিন্তু এরঅন্তর্নিহিত । ভাবটি অন্যরূপ । সেখানে একই অদ্বৈত মহাচৈতন্য লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করবার নিমিত্তে লীলাবশে বাহ্যতঃ দুটি রূপ ধারণ করেছেন মাত্র। অর্থাৎ একই আত্মায় দুটি দেহ নিত্য মিলিত— যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে। নিত্যস্বরূপে অভেদ এবং লীলারূপে ভেদ। আর এই লীলা অনাদি অনন্ত । সুতরাং লীলাও সত্য, নিত্যও সত্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ :—
“ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ॥”
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ৷৷ *
বৃহদারণ্যকোপনিষৎ (৫/১/১)
[* “ওঁ উহা ( অর্থাৎ পরব্রহ্ম ) পূর্ণ, ইহাও (অর্থাৎ নামরূপস্থ ব্রহ্ম ) পূর্ণ, পূর্ণ হইতে পূর্ণ উদ্গগত হন, পূর্ণের ( কার্য ব্রহ্মের ) পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলে পূর্ণ ( পরব্রহ্মই ) অবশিষ্ট থাকেন।”]
বাউলগণ বলেন–ব্রহ্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব যদিও দুর্গম তথাপি তা ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু মানুষতত্ত্ব অতি অদ্ভুত এবং ইহা বোধ করাও অতি দুরূহ । অধিকারী ভিন্ন অন্য কেহ এই তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম হয় না।
নিত্যধাম বা সহজপুরে চিরকিশোর-কিশোরী শ্রীরাধাকৃষ্ণ রত্ন সিংহাসনে বিরাজমান । অবস্থিত। আর ঐ নিত্যধাম হল নিত্যবৃন্দাবন, যা বিরজার পরপারে
বাউলমতে মানুষ তত্ত্বের তিনপ্রকার ভেদ, যথা— (১) সহজ মানুষ, (২) অযোনিজ মানুষ এবং (৩) সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ ।
সহজ মানুষ বিরাজ করেন নিত্যবৃন্দাবনে যা অপ্রাকৃত চিন্ময় এবং বাউলমতে সহজপুর । এখানে তিনি আপন স্বরূপশক্তি লাদিনী অর্থাৎ শ্রীরাধা সহকারে অবস্থান করেন এবং নিত্য নব নব লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করেন।
অযোনিজ মানুষ বিরাজ করেন বৈকুণ্ঠেতে। এটা ভাব জগৎ বা অধ্যাত্মজগৎ । এখানে তিনি লীলাময় নারায়ণ ও শ্রীলক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে বিরাজ করছেন। চতুভুজ নারায়ণ এবং শ্রীলক্ষ্মীদেবী বৈকুণ্ঠে অনন্তশয্যায় শায়িত রয়েছেন। তাঁরা নারদাদি ভক্তগণ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।
আর সামান্য মানুষ অর্থাৎ যোনিজ মানুষ বিরাজ করেন ক্ষীরোদ সাগরে এটা হল জন্ম-মৃত্যুর অধীন স্থল জড়জগৎ । ইনি জীবন ও মৃত্যুতে গমনাগমন করেন অর্থাৎ স্থল বিশ্বে যাতায়াত করেন। এই সামান্য মানুষই স্থল বিশ্বে সর্বত্র বর্তমান
বাউলগণ বলেন এই বর্তমান মানুষের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’ আছেন ৷ অর্থাৎ বর্তমান রূপের মধ্যে অবর্তমান বা নিত্য বর্তমান স্বরূপের স্থিতি আছে। এটা অতি গূঢ় এবং সহজে অনুধাবনযোগ্য নহে । এ সহজ মানুষ অযোনিজ মানুষ ও নন এবং সামান্য মানুষও নন। তিনি কেবল নিত্যবৃন্দাবন সহজপুরেই বিরাজিত।
এই সহজপুর বা নিত্যবৃন্দাবন সৃষ্টির অন্তর্গত নয়। তার উন্মেষ হয় রাগে অর্থাৎ রাগানুগা ভজনে ৷
বাউলমতে শব বা মৃততনু হতে না পারলে প্রেমের বাতাস লাগে না আর প্রেমের বাতাস না লাগলে সহজ মানুষ আবির্ভূত হন না। সেইজন্য এই সহজ মানুষকে বিধাতার সৃষ্টিতে পাওয়া যাবে না। সহজ ভজনেই কেবলমাত্র এটা বোধেবোধ হয় ।
ঐ সহজপুরে অর্থাৎ অপ্রাকৃত বৃন্দাবনে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের সহজ প্রেম- লীলার যে ধারা নিত্য প্রবাহিত হচ্ছে, প্রাকৃত জগতের নরনারীর ভিতরও সেই ধারা আংশিকরূপে নিরন্তর সঞ্চারিত হচ্ছে। সেহেতু প্রাকৃতিকনর-নারী অপ্রাকৃত শ্রীকৃষ্ণ-রাধার প্রতীক ।
বাউলগণ বলেন – প্রাকৃত নর শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক এবং প্রাকৃত নারী শ্রীরাধার প্রতীক । তাঁদের মতে শ্রীরাধা-কৃষ্ণই প্রাকৃত নর-নারীরূপে বিহার করছেন—কোথাও আংশিকভাবে আবার কোথাও পূর্ণভাবে । অতএব প্রাকৃত নর-নারীর প্রেম অপ্রাকৃত শ্রীরাধা-কৃষ্ণের সহজ প্রেমেরই প্রতিচ্ছবি।
অপ্রাকৃত শ্রীরাধাকৃষ্ণের সহজলীলা অনাবিলভাবে নিরন্তর চলেছে— এটাই সৃষ্টির মূলতত্ত্ব। আর ঐ রাধাকৃষ্ণের যুগল স্বরূপই হল বাউলদের চরম ও পরম তত্ত্ব এবং এর বোধো বাধের পথ হল একান্ত ঘনীভূত প্রেম।
সুতরাং মূলতঃ ঐ একই তত্ত্ব দুইরূপ ধারণ করে পুরুষ ও প্রকৃতিভাবে,প্রাকৃত ও অপ্রাকৃতরূপে বিহার করছেন। আর এই দৃশ্যমান স্থূলপ্রাকৃত নর-নারীর রূপের অন্তরালে রয়েছে অপ্রাকৃত স্বরূপতত্ত্ব। এইজন্যবাউলমতে প্রত্যেক নারী প্রাকৃতরূপে নারী কিন্তু স্বরূপে শ্রীরাধা ।আবার প্রত্যেক নর প্রাকৃতরূপে নর কিন্তু স্বরূপে শ্রীকৃষ্ণ। এই নর-নারীযখন প্রাকৃতরূপকে আশ্রয় করে বা অবলম্বন করে, অপ্রাকৃত স্বরূপবোধেবোধ করবে, তখন সেই স্বরূপতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত নর-নারীর মিলনপরিণতি হবে শ্রীরাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সহজ প্রেমলীলায়। অর্থাৎ মর্তের প্রাকৃত প্রেমমিলন হয়ে উঠবে নিত্যবৃন্দাবনের শ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। আর এটাই হল অপ্রাকৃত সহজলীলা ।
এই সহজলীলার অপরোক্ষ অনুভব সিদ্ধদেহ বিনা সম্ভব নয়। বাউলগণ বলেন—এই স্থল প্রাকৃত দেহকে সহজসাধনা দ্বারা অপ্রাকৃত স্বরূপে উন্নীত করে নিতে হবে। যোগের সাধনার দ্বারা প্রাকৃত সত্তা বিলীন হয়ে অপ্রাকৃত সত্তার উদয় হবে। রূপ তখনই স্বরূপে রূপান্তরিত হবে। আর ঐ অবস্থাই হল সিদ্ধ অবস্থা ।
বাউলমতে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব হল কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব এবং শ্রীরাধাতত্ত্ব হল মদনতত্ত্ব বা রতিরহস্য। ঐ রস ও রতির একীভূত অবস্থায় মহা উল্লাস বা লীলামাধুর্য। এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিতভাবে তোমায় বলব । বাউলগণ বলেন- মহাভাব অবস্থায় ঐ রস-রতি বিলাসরূপ অনাবিল উজ্জ্বল রসের বোধেবোধ হয়। আর এটাই হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের মহা উল্লাসময় শৃঙ্গারলীলা । তাঁরা আরও বলেন—যেভাবে শ্রীকৃষ্ণের শৃঙ্গার লীলামাধুর্যের পূর্ণ অনুভূতি হয়, তাই মধুরভাব আর মধুরভাবের চরম পরিণতি হল মহাভাব ।
বাউলমতে—প্রাকৃত প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পর পরস্পরে শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার ভাব আরোপ করে থাকেন, কারণ স্বরূপে তাঁরা শ্রীরাধা-কৃষ্ণ সাধনায় সিদ্ধ হলে বোধের পূর্ণতায় তাঁরা উভয়ে কৃষ্ণত্ব এবং রাধাত্ব প্রাপ্ত হবেন –অর্থাৎ রূপের ভিতর দিয়ে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হবেন—আপন স্বরূপেই তাঁরা পরম আনন্দ আস্বাদন করবেন। আর এটাই হল সহজপুরে স্থিতি। এই অবস্থায় রূপ এবং স্বরূপ এক হয়ে যায়। প্রাকৃত নায়ক-নায়িকা অপ্রাকৃত নায়ক-নায়িকা শ্রীরাধা-কৃষ্ণ স্বরূপে তাদাত্ম্য অর্থাৎ একীভূত লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করেন। প্রিয় আত্মন,
স্বরূপের মধ্যেই সহজ-মানুষের অবস্থান, রসিকজনই কেবলমাত্র তাঁকে বোধে-বোধ করতে পারেন। আর বাউলের সাধনাও হল রূপের মাধ্যমে স্বরূপে উন্নীত হওয়া।
বাউলরা বলেন কন্দর্প শ্রীকৃষ্ণ এবং মদন স্বরূপিণী শ্রীরাধার মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান—একের অবর্তমানে অন্যে থাকতে পারেন না। অর্থাৎ একে অপর হতে অভিন্ন । এই যুগলরূপ নিত্যবৃন্দাবনে বিরাজমান । আর ঐ নিত্যবৃন্দাবন গোলোকেরও ঊর্ধ্ব দেশে অবস্থিত। —এই রহস্যগুলি ধারণা করতে হলে দেহতত্ত্বের জ্ঞান একান্তভাবে প্রয়োজন । দেহতত্ত্ব না জানলে কিছুই বুঝা যায় না, কারণ দেহকে ঘিরেই দেহাতীতের লীলা ।