প্রশ্ন – আচ্ছা—আপনি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছিলেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে সহজিয়া মতবাদের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়েছিল, তাহলে কি চৈতন্যভক্তগণ তথা বৈষ্ণবগণ সকলেই সহজিয়া সাধন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, না তাঁদের মধ্যে ও তাঁদের সাধন পদ্ধতির অন্য কোন বিভাগ ছিল ? -এই সম্পর্কে যদি আলোচনা করেন তো কৃতার্থ হই ।

উত্তর – প্রিয় আত্মন,

ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যমহাপ্রভুর কাল হতেই বৈষ্ণবজগতে দুইটি ধারার প্রচলন হয়ে আসছে এবং উভয় সম্প্রদায়ের ইষ্টদেরও হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব । উভয়ের আশ্রয়স্থলও হল শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ কিন্তু সাধনার পদ্ধতিতে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় হতে সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধনার পদ্ধতি ভিন্ন হলেও এঁদের উৎপত্তিস্থল এবং গন্তব্যস্থল একই। তথাপি এঁদের বিরোধের একমাত্র কারণ হল -একপক্ষ অনুমান ভজনে আস্থাশীল এবং অপর পক্ষ বর্তমান ভজনে আস্থা রাখেন। অনুমান ভজনের তাৎপর্য হল যে এরা নারী বা প্রকৃতি বর্জিত হয়ে মানসভাবে প্রকৃতিভাব নিয়ে অষ্টপ্রহর চিন্তা দ্বারা শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটিয়ে যুগল মিলনাত্মকী শৃঙ্গার রসাস্বাদন করে থাকেন। আর বর্তমান ভজনের তাৎপর্য হল যে, এরা নারী বা প্রকৃতি গ্রহণ করে যোগের দ্বারা ঊর্ধ্ব রেতা হয়ে স্বীয় দেহের অভ্যন্তরে স্বরূপতত্ত্বে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমিলনাত্মক শৃঙ্গাররস অনুভব করে থাকেন এবং স্বরূপতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।

এই অনুমান ভজন যাঁরা করেন, তাঁরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব নামে পরিচিত এবং যাঁরা বর্তমান ভজন করেন, তাঁরা সহজিয়া বৈষ্ণব নামে পরিচিত। প্রিয় আত্মন, বাংলাদেশে এঁরা আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই এবং সহজ নামে পরিচিত। এঁরাই নারী প্রকৃতি নিয়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল সাধন- ভজন করেন। অর্থাৎ নরনারী উভয়ে সাধন প্রক্রিয়া দ্বারা ঊর্ধ্বরেতা হয়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিথুন ভারগত লীলারস বা শৃঙ্গার রসাত্মক চরম মাধুর্য আস্বাদন করে থাকেন।

প্রিয় আত্মন্‌, এখন নিশ্চয় বুঝলে অনুমান ভজনে নারীর সাহচর্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বর্তমান ভজনে সাধকগণের কেবলমাত্র নারীর সাহচর্যের প্রয়োজন হয় ।

এই বর্তমান মতের বাউলদের ভিতর আবার দুইটি ধারা আছে।

প্রশ্ন—আপনি কৃপাপূর্বক বর্তমান বাউলদের ধারাদ্বয় সম্পর্কে কিছু আলোচনা করুন।

উত্তর– প্রিয় আত্মন্‌, বর্তমান বাউলদের দুই ধারার প্রথম ধারায় রামানন্দ, জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতি জ্যোতিষ্কগণ পড়েন। আর দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত শ্রীরূপ-সনাতন, শ্রীজীব, রঘুনাথ দাস ; শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি প্রভুপাদগণ ।

প্রথম ধারাটির সকলে গৃহস্থ ছিলেন আর দ্বিতীয় ধারাটির সকলেই সন্ন্যাসী ছিলেন। অর্থাৎ প্রথম ধারাটি প্রকৃতি গ্রহণ করেছিলেন আর দ্বিতীয় ধারাটি এককভাবেই বর্তমান সাধনা করেছিলেন।

প্রিয় আত্মন্‌, আজও অসংখ্য সাধু, মহাজন এককভাবে বর্তমান ধারাতে সাধনা করে চলেছেন ।

বর্তমান সাধনার উদ্দেশ্য বা মূল কথাটি হল ঊর্ধ্ব রেতা হওয়া এবং চিন্ময়স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপ্রাকৃত আনন্দরস আস্বাদন করা।

এই একক বর্তমান ভাবের সাধকগণ মধুরভাব আশ্রয় করে ঐ চরম অবস্থায় উপনীত হন । সমস্ত ভাবের পূর্ণতা মধুর ভাবের মধ্যে আর মধুর ভাবের চরম পরিণতি মহাভাব, যার মধ্যে রয়েছে প্রেম-মিলনের চরম শৃঙ্গারাত্মক্ রসোল্লাস ৷

প্রশ্ন –আপনি যে মধুর ভাবের কথাটি উল্লেখ করলেন সেই মধুর ভাব প্রসঙ্গে যদি কিছু বলেন তো ধন্য হই !

উত্তর – প্রিয় আত্মন্‌, সর্বভাবের পরিসমাপ্তি মধুরভাবে আর এই মধুরভাবের লীলাই হল ব্রজলীলা । এই মধুর ভাবটিকে কেন্দ্রে রেখে অন্যান্য যাবতীয় ভাবসকল তার চারদিকে স্থিতিলাভ করে। যে কোন ভাবেই সাধক অবস্থান করুন না কেন, চরম অবস্থায় তাঁকে মধুরভাব আশ্রয় করতেই হবে। সেইজন্যই মধুরভাবকে চরমভার বলে। বাউলগণ আরও বলেন – মধুরভাব আশ্রয় না করলে শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলারস মাধুর্য বা যুগলতত্ত্ব জানা যাবে না। কারণ প্রকৃতি না হয়ে প্রকৃতির লীলা আস্বাদন করা অসম্ভব। যদিও সমস্ত ভারই মহাভাবের অন্তর্গত তবুও অন্যান্যভাবে পুরুষকারের আভাস রয়েছে অর্থাৎ কিঞ্চিৎ পরিমাণও পুরুষভাব বিদ্যমান থাকে । একমাত্র মধুর ভাবেতেই এই পুরুষভাব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সেইজন্য মধুরভাবেই কেবল শৃঙ্গারাত্মক্ রসের স্ফুরণ হয় আর এই উল্লাস ‘উজ্জ্বল রস’ নামে খ্যাত। এ

মধুরভাব আশ্রয় বা অবলম্বন করলে সাধকের প্রকৃতিতে বা অন্তর্জগতে ক্রমান্বয়ে অভাব হতে স্বভাব এবং স্বভাব হতে মহাভাবঅবস্থার উন্মেষ হয়। আর মহাভাব অবস্থার ভিতরই চিৎকলার সম্পূর্ণ বিকাশ হয়। আর চিৎকলার বিকাশ হলেই অমৃতময়ী ষোড়শী কলার অভিব্যক্তি হয়। তাই হল হলাদিনীস্বরূপিণী শ্রীরাধা । আর এটাই হল মধুর ভাবের গূঢ়তম রহস্য ।

প্রশ্ন – আপনি পুনরায় যদি অভাব হতে স্বভাব এবং স্বভাব হতে মহাভাব—এই ব্যাপারটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন তা হলে আমার পক্ষে বুঝবার খুবই সুবিধা হয়।

উত্তর – প্রিয় আত্মন্‌, সেইভাবেই বিশ্লেষণ করছি তুমি শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ কর।

প্রতিটি মানবচিত্ত ত্রিগুণ দ্বারা আচ্ছন্ন। সেইহেতু ত্রিগুণের বিকার দ্বারা মানবচিত্ত প্রতিনিয়তই বিকারপ্রাপ্ত হচ্ছে। আর ঐ চিত্ত-বিকৃতি হতেই মানব সুখ এবং দুঃখ অনুভব করছে। সে সাক্ষাৎ সচ্চিদানন্দ বা আত্মতত্ত্ব হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞানবশতঃ আনন্দ ও শান্তির জন্য সংসারচক্রে ভ্রমণ করে হাহাকার করছে। এই অবস্থাই হল অভাব অবস্থা ।

এই অভাব অবস্থায় তমঃ ও রজঃ গুণের প্রভাবে চিত্ত সর্বদা অস্থির ও চঞ্চল হয়ে পড়ে এবং অসহিষ্ণুতাহেতু মনের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলতে থাকে। কোন বিষয়ে কিছুক্ষণের জন্যও মন একাগ্র হয় না । এই অবস্থায় সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গের একান্ত প্রয়োজন । ক্রমশঃ সাধনার দ্বারা তমঃ ও রজঃ গুণের প্রভাব দূর হলে মানব সত্ত্ব প্রধান হয়। যথাক্রমে অনুবৃত্তি উপবৃত্তি— বৃত্তি এবং বৃত্তি হতে ভাব অবস্থার উদয় হয় । আর এই ভাব অবস্থাই হল সত্ত্ব প্রধান মানবের লক্ষণ। ক্রমশঃ সত্ত্বগুণ প্রধান ব্যক্তির মধ্যে বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের উন্মেষ হয়। তখন ভাব ক্রমান্বয়ে গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়ে এক প্রগাঢ় ঘনীভূত অবস্থার অভিব্যক্তি হয়। আর ভাবের ঐ ঘনীভূত অবস্থাই হল প্রেম। এটাই হল অভাব হতে স্বভাব অবস্থায় উপনীত হওয়া।

আবার ঐ প্রেম ক্রমান্বয়ে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাব হয়ে মহাভাবে পরিণতি লাভ করে। মহাভার অবস্থা হল ত্রিগুণের পরে ; তাই অপ্রাকৃত। ইনিই হলাদিনীস্বরূপিণী শ্রীরাধা।

সুতরাং এখন নিশ্চয় বুঝলে সাধকের চিত্ত যখন ত্রিগুণ বিকার দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, তখন অভাব অবস্থা । ক্রমান্বয়ে অনুবৃত্তি, উপবৃত্তি, বৃত্তি হয়ে হয় ভাব। এই ভাব ক্রমশঃ গভীর হয়ে হয় স্বভাব (প্রেম) এবং স্বভাবের চরম ও পরম অভিব্যক্তি হল মহাভাব অর্থাৎ শ্রীরাধা । –এই বিষয় সম্পর্কে আরও বিস্তৃতভাবে পরে তোমায় বলব ।