প্রথম পরিচ্ছেদ
পরমেশ্বরের মহিমা কে নির্ণয় করতে পারে। আর পারে না বলেই তাঁকে জ্ঞানাতীত, যোগাতীত, বেদাতীত, ত্রিগুণাতীত ও শাস্ত্রাতীত বলা হয়। উপনিষদে তাঁকে বলা হয়েছে—‘অবাত্মনসগোচর’, অর্থাৎ তিনি মন, বুদ্ধি ও বাক্যের অতীত, সুতরাং পরতত্ত্ব বা পরমতত্ত্ব অপ্রাকৃত ও পরম উপলব্ধ সত্য । পরমতত্ত্বকে নিয়ে মতবাদ বা বাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করা—অসহজ ও প্রগল্ভতা ছাড়া আর কি ?
প্রিয় আত্মন্—এই বিশ্বচরাচর জগৎসংসার কোন এক অজানা মহাশক্তির দ্বারা পরিচালিত। গ্রহ, নক্ষত্রাদি ও জড়জগৎ আবর্তিত হচ্ছে ঐ মহাশক্তির প্রভাবে । অণু পরমাণু হতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত ঐ অপরিমেয় শক্তির দ্বারা ধৃত ও পরিচালিত হচ্ছে । প্রতিটি বস্তু জগতের প্রাক্-উৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয়রূপ বিবর্তন সম্ভাবিত হচ্ছে ঐ মহাশক্তির দ্বারা। ঐ একই নিয়মে প্রাণী জগতেরও সৃষ্টি, পালন এবং সংহাররূপে নিয়ন্ত্রণ সংঘটিত হচ্ছে। এই প্রাণী জগতের মধ্যে আবার মানব উন্নত স্তরের প্রাণী। সেই কারণে মানব প্রাণস্তরের শ্রেষ্ঠতম অভিব্যক্তি এবং মানবের মধ্যে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান — যা অপর প্রাণিগণের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। আর ঐ বৈশিষ্ট্য হল মানবের কাণ্ডজ্ঞান বা বিবেক ।
প্রাণীর ধর্ম বাঁচার তাগিদ, বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তারের প্রবণতা। প্রাণিকুলের জীবন ধারণের কারণে আহারের প্রয়োজন। এই জন্য তাকে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য আহার সংগ্রহ করতে হয় এবং তার ক্লান্তি নিবারণের জন্য বিশ্রাম বা নিদ্রার প্রয়োজন হয়। আর বৃদ্ধি বা বংশ বিস্তারের তাড়নায় সে মিলিত হয় জৈবিক মিলনে।
আর এই বৃত্তিগুলি চরিতার্থের নিমিত্তে অনুকূল ও প্রতিকূল মিশ্রিত পরিস্হিতির কথা ভেবে ভয় নামক সংস্কার জাগ্রত হয়। সেইহেতু আহার, নিদ্রা ও মৈথুনরূপ বৃত্তিগুলির চরিতার্থের লালসা এবং এইগুলি চরিতার্থতার পথে প্রতিকূলতা হেতু ভয় প্রবল হয়ে ওঠে। সাধারণত লালসা ও ভয়—এই দুটি সংস্কার জীবের ভিতর প্রবলভাবে দেখা যায়। এইজন্য বাসনামুখী জীবনে আপন অস্তিত্ব বিপন্নতা বা বিলোপের কথা ভেবে প্রচণ্ড ভয়রূপ সংস্কার তাকে অভিভূত করে রাখে। এটার কারণ আপন অস্তিত্ব বোধের অভাব। সে নিজেকে খোঁজে লালসা চরিতার্থের ভিতর, এর অভাবেই অস্তিত্ব বিপন্নতার কথা চিন্তা ..করে ভয় পায় ।
প্রিয় আত্মন্—সাধারণত মনুষ্যেতর প্রাণিকুলের মধ্যে আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও ভয়—এই চার প্রবৃত্তিই প্রধান । আর এইগুলিকে অবলম্বন করেই তারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করে থাকে। তাদের জীবনসংগ্রামও ঐ চার প্রবৃত্তিকে মাধ্যম করে। আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও ভয় ছাড়া এদের জীবনে আর বিশেষ বা জরুরী কোন প্রকারের উন্নত তাগিদ নেই এবং থাকলেও তা নিয়ে তাদের কোনপ্রকার মাথা-ব্যথাও নেই। তারা জীবনযাত্রা অতিবাহিত করতে সমস্ত প্রকার প্রাকৃতিক বাধা বা প্রতিবন্ধকতা বাধ্যতামূলকভাবে বিনা বিচারেই মেনে নেয়। কিন্তু মানবের ক্ষেত্রে এটা অন্য প্রকারের। মানব প্রতিকূল অবস্হায় থেকেও প্রতিবন্ধকতাগুলিকে নির্বিচারে মেনে নিতে পারে না। আর এই কারণের জন্যই তারা সংগ্রামে লিপ্ত হয়। জীবনযাত্রার বাধাসমূহকে মেনে না নিয়ে বাঁচার তাগিদে আমরণ সংগ্রাম করতে থাকে এবং উপায় ও কৌশলের সাহায্যে বাধাগুলিকে অতিক্রম করে প্রতিকূলতাকে অপসারণ করে।
এই বাঁচার তাগিদ ও বৃদ্ধির প্রবণতা ছাড়াও মানবের মধ্যে আরো একটি প্রেরণা আছে—যেটা হল সম্পূর্ণতা লাভের তাগিদ। সংসারের বিভিন্ন পরিস্হিতির মধ্যে দিয়ে মানব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। পশুদের ভিতর বিশ্ব সংসারের এই রহস্যকে জানার জন্য কোনরূপ মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু মানবের ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত নিয়েই যত মাথা ব্যথা- অজানাকে জানার জন্য এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা—‘ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ পাথর’।
আহার, নিদ্রা ও মৈথুনেই মনুষ্যেতর প্রাণীরা সন্তুষ্ট । কিন্তু মানব ঐ ‘তিন’-এ অর্থাৎ আহার, নিদ্রা ও মৈথুনে সন্তুষ্ট বা নিশ্চিন্ত না থেকে বিশ্বের প্রতিটি রহস্যকে জানার জন্য হয় আকুল । তারা বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। যুগ যুগ ধরে সংসারের বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে—বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানব জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করছে, ফলে তাদের নিকট অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
অন্যান্য সমস্ত প্রাণী সংসারে অবস্থান করলেও একমাত্র মানবই সংসাররহস্য নিয়ে মাথা ঘামায়—কেবলমাত্র মানবই চায় জীবন-রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে।
মানব চায় আত্মিক সমাধান। সংসারের সারভূত সত্যকে জানতে চায়— জীবনের রহস্যকে তারা অনুভব করতে চায়। কাকে পেলে সব চাওয়া-পাওয়ার হবে সমাপ্তি, কাকে জানলে আর জানার কিছু থাকবে না এবং কি প্রাপ্তিতে আসবে জীবনের পূর্ণতা—মানব চায় এই আত্মিক সমস্যার সমাধান। এই অদম্য আকুতিই অন্য সব প্রাণী হতে মানুষকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই প্রাণিকুলের ভিতর মানব শ্রেষ্ঠ ও মহান।
মানব অমৃতের পুত্র আর এই জন্য অমৃতের সন্ধানই তার সাধনা। তাকে ঐ অমৃত বা শাশ্বত সত্যস্বরূপ আত্মাকে বোধ করতেই হবে, তবেই হবে তার পূর্ণতা। পরম আনন্দঘন, সনাতন আত্মতত্ত্বে যতদিন না মানব উপনীত হচ্ছে, ততদিন সে চলতেই থাকবে। আর এগিয়ে চলাই মানবের ধর্ম—চরৈবেতি—চরৈবেতি—চরৈবেতি।
প্রিয় আত্মন্ ! যে বিষয়কে ধারণ করে সমষ্টিগতভাবে বাঁচা যায় এবং যে ভাব আশ্রয় করলে মানবজাতি সম্পূর্ণতা বা পূর্ণতায় উপনীত হবে—সেটাই মানবের ধর্ম। মানবজাতি যখন এই সহজ জীবনধর্ম হতে বিচ্যুত হয় এবং অসহজ হয়ে পড়ে, তখন—একমাত্র তখনই আবির্ভূত হন মহামানব। তাঁরাই মানবজাতির পথিকৃৎ এবং মানবজাতির সম্মুখে ধর্মের আদর্শ তাঁরাই তুলে ধরেন। মহাপুরুষগণ নিজেদের জীবন দ্বারা মানবজাতির হিতে সুমহান আত্মত্যাগের আদর্শ তুলে ধরেন আর সেই মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানবজাতি। কিন্তু কালে ঐ আদর্শের অনুগামী হওয়া বা অনুসরণ করা তো দূরের কথা—মহামানবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সম্প্রদায়, শ্রেণী ও গোষ্ঠী।
সংসারে দেখা যায়—কোন একজন মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রথম কিছু অনুরাগী একনিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে। ক্রমান্বয়ে তার ক্রমবিকাশ ও বিস্তার ঘটে এবং পরে নিজেরাই একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবশত সংকীর্ণতা এসে পড়ে এবং এই সংকীর্ণতার বৃদ্ধিতে ক্রমে হীন বৃদ্ধির কারণে উক্ত আদর্শের প্রতি তাদের অনুরাগ কমে যায়। আর অবিবেকবশত আদর্শ হতে সরে যাওয়ার অর্থই কক্ষচ্যুতি।
চিন্তাশক্তির হ্রাসহেতু ও সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির কারণে নানা বিধি- নিষেধের উদ্ভব হয় এবং কুসংস্কারবশত মানৰ অসহজ চিন্তা ভাবনায়লিপ্ত হয়ে ভাবে যে তারাই বুঝি ধর্মের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এইরূপে অহরহ এক সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায়ের দোষ-ত্রুটি খোঁজে ও তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এইরূপ স্বার্থপর, দূরভিসন্ধিযুক্ত মানবের দ্বারা মহাপুরুষদের আদর্শ বিকৃত হয়ে সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। এর ফলে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর, এমন কি শ্রেণীতে শ্রেণীতে এবং সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। এইরূপ সাম্প্রদায়িক বৃদ্ধিবশত সম্প্রদায়ভুক্ত অবিবেকী মানবরা মানবজাতির কল্যাণ করা তো দূরের কথা বরং তার পরিবর্তে তারা মানব সমাজে অধিক ক্লেশ উৎপন্ন করে। আর এর পরিণামস্বরূপ পৃথিবী বার বার রক্তস্নান করছে। এভাবে মানুষের রক্তে পৃথিবী বহুবার সিক্ত হয়েছে । তথাপি স্বার্থপর অবিবেকী মানবগণ সম্প্রদায় গঠন করা থেকে বিরত হয়নি । যতদিন না মানবজাতি অসহজ অবস্হা হতে সহজ হচ্ছে, ততদিন এই পৃথিবী রক্তস্নাত হবে। প্রিয় আত্মন্—স্বার্থপর পাশবিক মানবই অসহজ আর স্বার্থমুক্ত প্রেমিক মানবই সহজ।
জীবনটা বহমান—একে হিসাবের সূত্র দ্বারা অথবা শাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা বাঁধা যায় না। পরম সত্যকে যিনি বোধে বোধ করেন বা পরম আত্মবোধে যিনি উপনীত হন, তার কোন প্রকার মত থাকে না। তিনি কোন প্রকার মতবাদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধও করেন না। তিনি তখন মানা বা না মানার ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। অতএব মানা বা না মানা—এই দুইটিই বন্ধন আর এই দুইয়ের ঊর্ধ্বে সহজস্হিতি। সত্যের বোধ হলে মানবের সমস্ত মতবাদ ভেঙে যায়।
মানবের মধ্যে বিবেক থাকা সত্ত্বেও কোন না কোন বন্ধনে তা অবশ হয়ে আছে। সমস্ত রকমের বন্ধনমুক্ত অবস্হাই মুক্ত-বিবেক বা সহজ অবস্হা ।শাস্ত্র জাতি, শ্রেণী, গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা অভিমানী মনস্তরের বন্ধনে মানবের বিবেক আচ্ছন্ন হয় । যিনি মুক্ত বিবেক এবং যাঁর বিবেক বন্ধনের কোনরূপ বিষয় নেই, তিনি সদা বিবেকানন্দে মগ্ন। আর প্রকৃতই যিনি মুক্ত বিবেক, তিনিই তো যথার্থ বিবেকানন্দ। সুতরাং বিবেকী হও, প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করো।
প্রিয় আত্মন-তোমাদের কোন সিদ্ধান্ত দিতে চাই না অথবা তোমাদের কোন সিদ্ধান্তে রাখতেও চাই না। তোমরা সিদ্ধান্তের উপরে ওঠো এবং মানা না মানার ঊর্ধ্বে চলো- কোনরূপ সিদ্ধান্তের বন্ধনে থেকো না। সিদ্ধান্ত ও শব্দের বন্ধন হতে মুক্ত হও।
সমস্ত প্রকারের নির্ভরতা কাটলে যা থাকে, তাই আত্মনির্ভরতা বা ঈশ্বরনির্ভরতা।
যদি প্রকৃত সত্যকে জীবনে বোধ করতে চাও, তাহলে সমস্ত মতবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। মতবাদ হতে মুক্ত হও। বাদগ্রস্ততা পরিত্যাগ কর, কারণ জীবনের সত্যকে বোধ করতে হলে উক্ত বাদগুলিই একমাত্র ও ভীষণ বাধাস্বরূপ।
প্রিয় আত্মন্—মতবাদ তোমায় ধরে রাখেনি, বরং তুমিই মতবাদকে ধরে রেখেছ। অতএব তুমি মতবাদ ছাড়লেই তো মুক্ত! সুতরাং বাদমুক্ত হও— সহজ হও-মুক্তবিবেক হও।
অপরের দৃষ্টিতে নিজেকে না দেখে আপন দৃষ্টিতে আপনাকে দেখ। আপন দৃষ্টির উন্মেষ ঘটাও। স্মরণ রাখতে হবে যে—জীবনের বিস্তার বাইরে, কিন্তু জীবনের কেন্দ্র ভিতরে। যদি জীবনের কেন্দ্রমুখী হতে চাও, তাহলে কে কি বললকে কি ভাবল ইত্যাদি বাইরের অকারণ চিন্তার জটগুলিকে ছাড়তে হবে। ‘আমি’ কি—এটাই জানতে হবে এবং ঐ ‘আমি’র কেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে। তোমার ‘আমি’কে অনুসন্ধান করতে হবে।
বিবেক বন্ধনযুক্ত হলে মানবের নৈতিক চেতনা বিলুপ্ত হয়, তখন মিথ্যাই একমাত্র স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। মানব বিকৃত বা অসহজ হয়ে পড়লে মিথ্যা প্রবঞ্চনাতেই এক ধরনের সুখ অনুভব করে থাকে এবং পরিশেষে অনুশোচনা করে ও অনুতপ্ত হয়।
প্রিয় আত্মন্ ! সাধনা হচ্ছে সত্যের অনুসন্ধান এবং সিদ্ধি হল জীবনের গভীরে পরম সত্যকে বোধে বোধ করা। এটাই জীবন বোধ ।
জীবন যেন এক যাত্রা,
এই অভিসার পূর্ণতার পথে—
চরৈবেতি—চরৈবেতি—চরৈবেতি।