প্রশ্ন –’বাউল’ সম্পর্কে আপনি যে মনোজ্ঞ আলোচনাটি করলেন। তাতে আমি বিশেষভাবে অভিভূত হয়েছি। তথাপি আলোচনার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় বিশদভাবে জানবার আমার অত্যন্ত কৌতূহল হচ্ছে। ঐ বিষয়গুলি সম্পর্কে আপনি যদি অনুগ্রহ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন, তাহলে কৃতার্থ হই ।

উত্তর–প্রিয় আত্মন্ ! তুমি যে বিষয়গুলি সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, তা নিঃশঙ্কচিত্তে আমাকে জিজ্ঞাসা কর

প্রশ্ন –তাহলে আপনি অনুগ্রহ করে ‘বাউল’ শব্দের তাৎপর্য এবং এর প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন ।

উত্তর–প্রিয় আত্মন্ ! ‘বাউল’ শব্দটি ‘বাতুল’ শব্দের অপভ্রংশ ৷ ‘বাতুল’ শব্দ ক্রমশঃ রূপান্তরিত হয়ে ‘বাউল’ শব্দে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে। ‘বাউল’ শব্দের প্রকৃত মর্মার্থ হল – বাহ্যজ্ঞান রহিত উন্মাদ। অর্থাৎ যিনি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের চেতনাশূন্য, বিষয়বুদ্ধি রহিত ভগবৎ প্রেমে পাগল । আর এই ভাবমুখী প্রেমোন্মাদ মানুষকেই ‘বাউল’ বলা হয় ৷

প্রশ্ন–আপনি পূর্বে আলোচনা করলেন বাউল কোন সম্প্রদায় নয়, তাহলে বাউলগণ কিভাবে নিজেদের পরিচয় প্রদান করে থাকেন? এ সম্পর্কে আপনি কিছু আলোকপাত করুন

উত্তর–প্রিয় আত্মন্! বাউলগণ নিজেদের ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বাউলগণ কোন সাম্প্রদায়িক মতবাদ স্বীকারকরেন না। সহজিয়া বাউলগণ নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক সহজ পথের পথিক নামে আখ্যাত করেন এবং তাদের সাধনাকে রসসাধনা ও নিজেদেরকে রসিক নামেও পরিচয় প্রদান করে থাকেন।

বৈদিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যে সমস্ত বৈষ্ণব মতবাদগুলি প্রচলিত আছে—যথাক্রমে গৌড়ীয়, বল্লভ, নিম্বার্ক, শ্রী এবং সম্ব— এই মতবাদ গুলির সঙ্গে সহজিয়া বাউলদের মতের পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

সহজিয়া বাউলগণ বলে থাকেন—যা বৈদিক সম্প্রদায়ের অনুগত সাধনা তা হল সাম্প্রদায়িক সাধনা রসিকগণ বলেন বেদাদি শাস্ত্রে কেবল রসতত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

যথা :—  ‘রসো বৈ সঃ ।

রসং হ্যেবায়ং লব্-ধ্বানন্দী ভবতি ।

কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ

               যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ

               এষ হ্যেবানন্দয়াতি।’ *

[* তিনিই (ব্রহ্মই) রসস্বরূপ। জীব সেই রসকে লাভ করেই আনন্দিত হয়। হৃদয়গুহাতে যদি অপরোক্ষ আনন্দ না থাকত তবে কেই বা অপানক্রিয়া করত, কেই বা প্রাণক্রিয়া করত ? — তৈত্তিরীয়োপনিষৎ (২/৭) ]

কিন্তু রসতত্ত্বের সাধনা বেদে স্পষ্টতঃ উল্লিখিত বা নির্দিষ্ট নেই। এই রসতত্ত্ব হল অতি গুহ্য বিষয় । কেবলমাত্র ভগবৎ কৃপা এবং গুরুকৃপাবলে এটা অবগত হওয়া যায়। এই রস-সাধনারই নামান্তর বাউলদের সহজ সাধনা।

সহজিয়া বাউলগণ বলেন— এই সাধনা সাধারণ মানবের পক্ষে উপযোগী নয়। সদগুরুর পরামর্শে এবং তাঁর নির্দেশিত পথে যোগের অভ্যাস দ্বারা পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয় সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রস-সাধনায় অধিকার লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়বিজয়ী রসিকগণেরই কেবলমাত্র রস-সাধনায় অধিকার জন্মে।

বৈদিক শাস্ত্রাদিতে রসতত্ত্বের বা সহজিয়া তত্ত্বের সাধনার কোন স্পষ্টতঃ উল্লেখ না থাকায় সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবমতগুলিতে এই রসতত্ত্ব বা সহজ সাধনা প্রচলিত নেই। আর যদিও থাকে, তাহলে তা প্রকাশ্যভাবে নেই গুপ্তভাবে থাকলেও থাকতে পারে। সেই হেতু সহজিয়া বাউলগণ নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেন।

এই সহজিয়া বাউলগণ ভক্তি ও প্রেমতত্ত্বকে যতটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, অন্যত্র প্রেমভক্তির ঠিক ততটা বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া- যায় না। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।

প্রশ্ন—আপনি এখন যদি সহজিয়া বাউলদের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু বলেন তো ধন্য হই ।

উত্তর— প্রিয় আত্মন !সহজিয়া বাউলদের উৎপত্তি বিষয়ে নানাজনের নানারকম মতবাদ প্রচলিত আছে। কেহ কেহ বলেন বৌদ্ধ বজ্রযান, সহজযান এবং হিন্দুতন্ত্রের সংমিশ্রণ-ধারা হতে এঁদের উৎপত্তি। কিন্তু বৌদ্ধ বজ্রযান, সহজযান এবং তন্ত্রের ধারা সংমিশ্রিত হয়ে কিভাবে তা সহজ সিদ্ধান্তরূপে আবির্ভূত হল—তা ঐতিহাসিক আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষবিষয়। সুতরাং এখানে সেই বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন বা নিরর্থক। তবুও এটা নিশ্চিত যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবকালের পূর্বেও সহজিয়া সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল এবং তা যথেষ্ট প্রমাণসিদ্ধ। যেমন— উল্লেখযোগ্যরূপে জয়দেব, বিল্বমঙ্গল, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতি সহজিয়া বৈষ্ণবগণ বিদ্যমান ছিলেন। তাহলেও একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়—শ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরবর্তী কাল হতে এই মতবাদের যথেষ্ট পুষ্টি তথা বিকাশ সম্ভব হয়েছিল, এমনকি এই মতবাদের পূর্ণ বিকাশও সম্ভব হয়েছিল।

সহজিয়া বাউলদের ভিতর এইরূপ ধারণা প্রচলিত আছে যে—শ্রীমন্মহাপ্রভু গুরু । -পার্ষদ স্বরূপ দামোদর গোস্বামী হলেন এই মতের আদি তাঁর নিকট হতে শ্রীরূপ গোস্বামী রসতত্ত্ব এবং সহজ সাধনার রহস্য অবগত হয়েছিলেন তাঁর পর যথাক্রমে শ্রীরঘুনাথ গোস্বামী, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং “সিদ্ধ মুকুন্দদেব গোস্বামী – এই রসতত্ত্ব ও সহজ সাধনার রহস্য জ্ঞাত হয়েছিলেন। এই মুকুন্দদেব গোস্বামী রাজপুত্র ছিলেন। গোস্বামীর তিনি বৈরাগ্য অবলম্বন করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ আশ্রয় পেয়েছিলেন। এইরূপ কথা বাউলদের ভিতর প্রচলিত আছে যে- শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী তাঁকে দিয়েই শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ লিখিয়েছিলেন। আবার এইরূপ কিংবদন্তী ও আছে যে, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলে যেতেন আর শ্রীমুকুন্দদের গোস্বামী তা লিখতেন।

শ্রীমুকুন্দদেব গোস্বামীর শিষ্য হলেন শ্রীমুকুন্দরামদাস গোস্বামী। ইনি বেশ – কিছু সহজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রায় সমস্তইলুপ্ত হয়ে গেছে, মাত্র কিছু কিছু সহজ গ্রন্থ অতি গোপনভাবে সহজিয়া বাউলদের ভিতর রক্ষিত আছে।

এছাড়া আরও অনেক সহজ সিদ্ধান্তের পুথি এবং সাহিত্য আছে — যা কেবল এই সহজিয়া বাউলদের মধ্যেই সংরক্ষিত, সাধারণ শিক্ষিত মানব সমাজ এখনও যেগুলির সন্ধান পায়নি। সহজিয়া বাউলগণ আপনাদের এইরূপ পরম্পরা মেনে থাকেন। তাঁরা তাঁদের সাধন রহস্থা এবং সহজ সিদ্ধান্তমূলক তত্ত্বগুলি সাধারণতঃ লোক-সমাজে প্রকাশ না করে অতি গোপনে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় নিজেদের মধ্যে বহন করে চলেন। কখনও কখনও বিভিন্ন বাউল সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে সাংকেতিক শব্দের দ্বারা সাধ্য ও সাধনতত্ত্বের রহস্যগুলি প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু এই সাংকেতিক শব্দগুলি এতই জটিল এবং দুর্বোধ্য যে, যতক্ষণ না বাউলদের সঙ্গ করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ ধারণা করা বা বুঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে মোটেই সম্ভবপর নয়।

সুতরাং বাউল সঙ্গীতের ভিতর যে সাংকেতিক শব্দগুলি বাউলগণ ব্যবহার করে থাকেন, তার তাত্ত্বিক রহস্য বুঝতে হলে তাঁদের সঙ্গ করা আবশ্যক, তা না হলে শব্দভেদ বা তত্ত্ব উদ্ঘাটন করা অতি কঠিন ব্যাপার।