প্রিয় আত্মন্—সমাজ সুস্হ হবে এবং সমাজে শান্তি আসবে ও কল্যাণ সাধিত হবে তখনই, যখন প্রেমকে আশ্রয় করে সমাজ বা মানবজাতি অগ্রসর হবে। প্রেমকে কেন্দ্র করে মানবসভ্যতা না গড়ে উঠলে মানবসমাজের মঙ্গল বা কল্যাণ হওয়া খুবই দুরূহ । সমাজের সমস্ত অশান্তির মূলে হল প্রেমহীনতা। প্রেমের উপর ভিত্তি করে মানবসমাজকে গড়তে হবে। যদি মানবজাতি ও সমাজকে উন্নত করতে চাও, তাহলে প্রেমের শিক্ষা দাও। মানুষের প্রথম শিক্ষা হল মানুষকে ভালবাসা। প্রেমহীন মানব জগতের সর্বাপেক্ষা বড় দুর্ঘটনা। প্রেমের মধ্যে দিয়ে আসে দেবতা, মহামানব আর কামের মধ্যে দিয়ে আসে দানব, অসহজ পশুমানব। প্রেমবোধ যার হল না,পরমাত্মার বোধ তার কেমন করে হবে !
প্রিয় আত্মন্, চোখবুজে করজোড়ে কি চাইছ ? ভগবান ? ভালবাসতে থাক—তোমার অন্তরে প্রেমের স্রোত বইবে আর ঐ প্রেমের প্রবাহ তোমায় পরমাত্মা-সাগরে পৌঁছে দেবে। সেইজন্য পথ ভালবাসা, সাধনা প্রেম এবং লক্ষ্য—পরমাত্মা। তোমার দৃষ্টিপথে যে পড়ে—তাকে ভালবাস।
প্রেম—প্রেম—প্রেম। একমাত্র প্রেম। এই প্রেমের দ্বারা সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে। প্রেমরূপ গঙ্গা, পরমাত্মারূপ সাগর। প্রেমে আরম্ভ-পরমাত্মায় অন্ত।
যারা একটি মানুষকে ভালবাসতে পারল না, তারা কেমন করে পরমাত্মাকে ভালবাসবে ? মানবপ্রেম যাদের জাগল না, তারা কি ভগবৎ প্রেমের যোগ্য ? মানবের স্বাস্থ্যই প্রেম আর প্রেমহীনতাই অস্বাস্থ্য বা রোগ।
প্রেম অকারণ, অর্থাৎ প্রেমের কোন কারণ নেই। তাই প্রেম স্বভাবজ।
যখন মানবহৃদয়ে প্রেমের বর্ষা হয়, তখনই মানব ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় এবং মানবের সম্পূর্ণতা আসে। প্রেমহীন মানব মৃতসম। এতে জীবনের লক্ষণ নেই। সেহেতু তারা অসহজ ।
প্রিয় আত্মন্, জীবনে প্রেমের বর্ষা নামলে ধ্যানের কিরণছটায় জ্ঞানের প্রকাশ হয়। প্রেম বা ধ্যান জীবনসাধনার পথে, আত্ম-সাক্ষাৎকারের জন্য একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং ভালবাসতে থাক। ভালবাসাই পথ, প্রেম-সাধনা এবং পরমেশ্বর—লক্ষ্য।
ভালবাসতে ভালবাসতে তোমার অন্তরে প্রেমের বর্ষা নেমে আসবে আর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটবে। যারা অসহজ, তারা প্রেমিককে বলে উন্মাদ। কিন্তু প্রেম—সম্রাট। ত্যাগের মহিমায় প্রেম উজ্জ্বল। নিঃস্বার্থ প্রেমই সহজধর্ম। প্রেমিকের মতো মহান সম্রাট আর কে আছে !
প্রেমের প্রকাশ তখনই ঘটে, যখন আমির পাহাড়টা আর থাকে না। একমাত্র তখনই মানবের বাণী বদলে যায়। তখন আর ‘আমি”আমি’ নয়, শুধু ‘তুমি” ‘তুমি’- ‘সব তোমাতে, তুমি সবেতে। এই বিশ্বে একমাত্র তুমিই আছ। একমাত্র প্রেমেতেই মানবের অবিদ্যারূপ আমির পাহাড়টা সরে যায়। প্রেমের প্রবাহ বইতে থাকে অন্তরে, প্রেমের সিড়ি বেয়ে পরমেশ্বরের বোধ হয় । মানব উন্নীত হয় অভাব হতে স্বভাবে এবং স্বভাব হতে মহাভাবে, মৃত্যু হতে জীবনে এবং জীবন হতে মহাজীবনে, খাল হতে নদীতে এবং নদী হতে সাগরে। মানব উপনীত হয় অসহজ মানব হতে সহজ মানবে, ব্যষ্টি চেতনা হতে সমষ্টি চেতনায়, জীবত্ব হতে শিবত্বে, ভক্ত হতে ভগবানে এবং বাসনা হতে প্রেমে।
পরমজ্ঞানে ও পরম প্রেমে স্বরূপত কোন ভেদ নেই। যতক্ষণ অপূর্ণতা, ততক্ষণই দ্বন্দ্ব। জীবন স্বরূপত আত্মা বা ব্রহ্ম। মায়া বা অজ্ঞান সামান্য বুদ্ধির কারণ—এটাই অসহজতা। মূলত কোন কিছুতেই ভেদ নেই, ভেদ শব্দটা মিথ্যা যার প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, ভ্রান্তি ও অসহজ অবস্হায় এর অস্তিত্ব অনুভব হয়, নতুবা কিছুই নয় ।
যা দুই বা ভেদ—তাই ভ্রান্তি । মানবের অনুভূতিতে এই ভেদ কিসের জন্য ? –‘আমি’–‘আমি ভাব’–এই জন্য এত ভেদ। যতক্ষণ ঐ ‘আমি- আমি ভাব’ থাকবে, ততক্ষণ ঐ ভ্রান্তি বা ভেদও থাকবে—এটাই অহংকার বা অসহজতা। এই অহংকার যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ ভগবৎ প্রেমের অনুভব নেই । প্রকৃত প্রেম হল একাত্ম বোধ। সহজ প্রেমের অনুভূতি হল—‘আমি রূপ’ অহংকারের প্রাচীরটা লুপ্ত হয়ে যাওয়া অর্থাৎ যতক্ষণ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যেকার অহংকাররূপ প্রাচীরটা (যা স্বার্থরূপ কংক্রীটের প্লাষ্টার করা) ভেঙে না পড়ে, ততক্ষণ প্রেমের বোধ নেই । প্রেম অদ্বৈত ভূমির পূর্ণ অনুভব—তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ভালবাসা মানে শুধু হা-হুতাশ নয়, কিংবা কেবলমাত্র সুখের কথা বা চোখের জল ফেলা নয় অথবা কেবল মনের বৃত্তি বা মানসিক উত্তেজনাও নয়। ভালবাসার তাড়নায় মানব অপরের কষ্ট মোচনের জন্য নিজেকে ভুলে যায়। ভালবাসার তাড়না আচরণে প্রকটিত হয়। ভালবাসার তাড়নাতেই ঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন মহামানবগণ। আদর্শ প্রেমিক চরিত্রের উৎকর্ষ মানবকে যেরূপ মহিমান্বিত করে থাকে, দেবতারাও তার কাছে নত হন। সমগ্র প্রাণী-জগতের প্রতি অতলান্ত ভালবাসাই হল মহাপ্রেমিকের লক্ষণ। প্রেম হল অন্ধকার হতে জ্যোতিতে উত্তরণের আকৃতি। প্রেমের প্রভাব সুদূর প্রসারী। বস্তুত মানব একটি ভাবসত্তা আর এই জড় দেহকে আশ্রয় করে বা প্রকাশ । ঐ ভাবসত্তারই অভিবিকাশ বা প্রকাশ ৷
প্রিয় আত্মন্, অখণ্ড প্রেমই হল ধর্ম। প্রেম ছাড়া মানবের আর কি ধর্ম হতে পারে ! প্রেমিক ভেদবুদ্ধিরহিত। তিনি কারও প্রতি ভেদবুদ্ধি পোষণ করতে পারেন না। কারণ এই বিশ্ব অখণ্ড প্রেমের প্রকাশ । খণ্ড খণ্ড মহাবিশ্বকে অখণ্ড প্রেমই ধরে রাখছে বা ধারণ করে আছে।
বিশ্বজুড়ে ঐ অখণ্ড প্রেম বিরাজিত আর সসীম ও সীমিত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে তার ভিতর দিয়ে সীমাহীন, অপার, অখণ্ড প্রেমের স্ফুরণ ও প্রকাশই হল তার ভগবত্ব। এইজন্য এই বিশ্ব সংসারে অসংখ্য ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ হচ্ছে। এই বিশাল বিশ্বব্যাপী সেই প্রেমস্বরূপ পরমেশ্বরই নাচছেন। বিভিন্ন নাম-রূপ নিয়ে ঐ প্রেমরূপ নটবর বা মহান অভিনেতা নাটকীয় ভঙ্গিতেনেচে চলেছেন অনাদিকাল ধরে। তাই কে কাকে হিংসা করবে ? কে কাকে ঘৃণা করবে, কিংবা বাহবা দেবে ? প্রকারান্তরে এ তো নিজেকেই বা ঈশ্বরকেই হিংসা, ঘৃণা কিংবা বাহবা দেওয়া।
প্রিয় আত্মন্—সংসারে দেখা যায়—কেউ কেউ কেবল নিজের মধ্যে এবং তার আপন সম্প্রদায়েরই ভগবত্বা স্বীকার করে থাকেন, অন্যত্র বা অন্য কারও ভিতর ভগবত্বা স্বীকার করেন না। নিজেরাই একমাত্র পরমেশ্বরের আপনজন আর অন্য সকলে ভগবান হতে বিচ্যুত— এরূপ ভেবেই হিংসা, ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে অন্য সকলের হৃদয়ে ব্যথা প্রদান করে থাকেন। এমনকি পাশবিক ইতর আচরণ করতেও কুণ্ঠিত হন না।
কিন্তু পরমেশ্বর তো সমস্ত কিছুর মধ্যেই রয়েছেন, কাউকে ছেড়ে অথবা বাদ দিয়ে তো তিনি নন । কারণ তাঁর সৃষ্টির বাইরে তো কিছুই নেই, তাহলে তিনি সৃষ্টিছাড়া করবেন কেমন করে আর রাখবেনই বা কোথায় ! এই মহাবিশ্ব তাঁর মধ্যেই আশ্রিত। পরমেশ্বরের মধ্যেই তো আমরা রয়েছি, তাঁর বাইরে তো কিছুই নেই । সমস্ত কিছুই প্রতিভাসিত বা প্রকাশিত হচ্ছে তাঁরই মধ্যে । অতএব ভিতরই বা কি আর বাহিরই বা কি ? অঙ্গাঙ্গি বা ওতপ্রোতভাবে তিনি সমস্ত কিছু করেন বা করতে পারেন। একটিই মাত্র তিনি পারেন না এবং তিনি করেন না-তা হল কাউকে ত্যাগ করা । আর ত্যাগ করে তাকে রাখবেনই বা কোথায় ! এইখানেই তাঁর মহিমা বা মাধুর্য। গত
ভেদজ্ঞান বর্জিত বিশুদ্ধ প্রেমের মহিমা অপার। জীবনের চির- আকাঙ্ক্ষিত আনন্দ ও শান্তি—এই বিশুদ্ধ প্রেমের মিলনেই লাভ হয় । প্রেম দ্বারা জীবের চিরকল্যাণ সাধিত হয় । ভালবাসার অপার শক্তিতে রিপুভয় দূরীভূত হয়ে যায়। ঐগুলি আর প্রেমিককে বিরক্ত করে না। তাই আনন্দে বাঁচতে হবে, আনন্দেই মরতে হবে আর এই আনন্দের মূল ভালবাসা- স্বার্থ- গন্ধরহিত তীব্র ভালবাসা। ভালবাসার অপরিমেয় শক্তিতে সমস্ত কিছুই পরম সুখময় বা আনন্দময় হয়ে ওঠে।
প্রিয় আত্মন্ – ভালবাসা মানবের এক মধুর বৃত্তি। ভালবাসা ছাড়া মানব বাঁচতে পারে না। একমাত্র ভালবাসাতেই মানব মানবকে আপনজন বলে বোধ করে, তখন কেউ আর পর থাকে না। ভালবাসার দ্বারাই ভেদজ্ঞানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে সবকিছুই আনন্দময় হয়ে ওঠে।
ভালবাসা মানবের স্বভাবজ ধর্ম, তা ক্রমবর্ধমান। ভালবাসার অনুশীলনে মানব বিশুদ্ধ প্রেমিকে রূপান্তরিত হয়। আবার এর অভাবে মানব পশু অপেক্ষাও হীন হয়ে পড়ে। ভালবাসা ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্র স্বার্থ-বেষ্টনী অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সংসারের যাবতীয় প্রতিকূলতা একমাত্র ভালবাসার কাছেই পরাজিত। ভালবাসায় কোন আড়ম্বর নেই । এতেই জগৎসংসার আনন্দনিকেতন বোধ হতে থাকে। ভালবাসা সমস্ত অভাবকে দূরীভূত করে থাকে। ভালবাসা স্বাধীন। যেখানে শুদ্ধ ভালবাসা, সেখানে কিছুর অভাব বোধ নেই। ভালবাসা স্বভাব হলে মানব নিজ হতে সকলকেই ভালবাসবে। মানব মানবকেই ভালবাসবে-এ তো স্বাভাবিক । ভালবাসায় মানব সুন্দর হয়, কেবলমাত্র মানবে কেন, তখন সর্বজীবেই ভালবাসার আবির্ভাব হয় । অকৃত্রিম ভালবাসায় সবই সম্ভব। ভালবাসার মাধুর্যে প্রাণ শীতল হয় ।
তোমরা সৎ হও-সুন্দর হও–প্রেমিক হও ।
প্রিয় আত্মন্, সংসারে আমরা দেখতে পাই—ধর্মের নানা ধরনের ক্রিয়াকলাপ। যেমন—হিন্দুগণ ঈশ্বরকে তাদের প্রতিনিধি করে গ্লোছ নিধনের জন্য কল্কি অবতারকে আহ্বান করছে। কোন কোন হিন্দু আবার শ্রীকৃষ্ণ যেরূপ কুরুকুলকে ও শ্রীরামচন্দ্র যেরূপ রক্ষকুলকে ধ্বংস করেছিলেন, নারী অপহরণকারী রাবণ এবং পরদ্রব্য আত্মসাৎকারী দুর্যোধন ইত্যাদিকে যেমন নিধন করেছিলেন, সেরূপ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব কামনা করে থাকে । অপরদিকে মুসলমানেরা আল্লা, মহম্মদ ও কোরানকে অবলম্বন করে অমুসলমান বা কাফেরদের হত্যা করতে অগ্রসর হয় । আবার খৃষ্টানরা যীশুখৃষ্ট ও বাইবেলকে অবলম্বন করে ভাবছে অ-খৃষ্টানগণ(অর্থাৎ পাপীরা) জগৎ হতে বিলুপ্ত হোক—যে কোন উপায়ে— ছলে, বলে ও কৌশলে অ-খৃষ্টানদের খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করাতে হবে, নতুবা তাদের মুক্তি নেই । এরূপ এক সম্প্রদায় অপর এক সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি বা বিনাশ চাইছে অহরহ। প্রত্যেকে আপন আপন সাম্প্রদায়িক ঈশ্বরকে নেতা করে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এইভাবে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, শ্রেণীতে- শ্রেণীতে—এমন কি ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বিবাদ ও সংঘর্ষ বাধিয়ে তুলছে। আর প্রত্যেকে আপনার প্রতিনিধি বা নেতারূপে ঈশ্বরের দোহাই দিচ্ছে। প্রতিনিয়তই একে অন্যের ধ্বংসকামনা করছে— ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছে অপরের বিনাশ । এইভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায় আপন সাম্প্রদায়িক ঈশ্বরের নাম নিয়ে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণকে বিনাশ করতে চাইছে । কিন্তু বড়ই আশ্চর্য ! সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবশত ভুলেও তারা কখন প্রার্থনা করে না যে—সকলের সুমতি হোক, সত্য— ত্যাগ—প্রেম ও শান্তির পথে সকলে চলুক এবং সকলেই পারস্পরিক সম্প্রীতি নিয়ে শান্তিতে থাকুক।
আপন সম্প্রদায়কে বাড়াতে গিয়ে অপর সম্প্রদায়কে আঘাত করছে এবং এর ফলেই জগতে মারামারি, হানাহানি ও সংঘর্ষ বাধছে । তারা যদি মানবের কল্যাণই চায়, তাহলে এরূপ সংঘর্ষ করে কেন !
প্রিয় আত্মন্—ভগবান বা পরমেশ্বর প্রেমস্বরূপ—প্রেমময়। মানব, মানব মাত্রকেই ভালবাসুক—এটাই তাঁর অভিপ্রায়। ভালবাসার ধর্ম অপরের দোষ বা কলঙ্ক না দেখা, প্রকারান্তরে অপরের দোষ বা কলঙ্ক মুছিয়ে দেওয়া। পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসলে সংসারে কিছুমাত্র অশান্তি থাকে না। ভালবাসতে না পারাটাই আমাদের দুর্বলতা, অর্থাৎ আমরা স্বার্থপর । আমাদের স্বার্থপরতাই হল ভালবাসার ক্ষেত্রে অন্তরায় বা প্রতিবন্ধক। সর্বসাধারণকে না ভালবাসলে, মানব আপন সংকীর্ণ স্বার্থের গণ্ডীকে অতিক্রম করতে পারে না। অতএব ভালবেসে সকল প্রকার দোষকে আত্মসাৎ কর।
প্রেম ও ভালবাসার ধর্ম কোনরূপ সাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নেই। প্রেম সার্বজনীন—কাউকেও বাদ দিয়ে নয়। প্রেমে ছোট-বড়, ধনী- দরিদ্র ইত্যাদি কোন ভেদ নেই। যারা সাম্প্রদায়িক ভাবনাযুক্ত তারাই অপর সম্প্রদায়কে ছোট বা বিনাশ করে নিজ সম্প্রদায়কে বড় করতে চায়। মানবের স্বভাব যখন সুন্দর হবে, তখনই তার ত্রিতাপ দুঃখ বা যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্ৰণা দূরীভূত হবে।
মানবজীবন যেন একটি কেন্দ্র। কেন্দ্র স্হির হলে যত বড় খুশী বৃত্ত আঁকা যায়, কিন্তু কেন্দ্র ছাড়া বৃত্ত রচনা যেমন অসম্ভব, সেরূপ মানব জীবনেও কেন্দ্র স্হির হলে জগৎজুড়ে বিশাল প্রেমের রাজ্য রচনা করা যাবে, নতুবা বক্তৃতা, সভাসমিতি, হিতোপদেশ অথবা নীতিকথার দ্বারা তা কখনই সম্ভব নয়।
প্রিয় আত্মন্—প্রেমের আনন্দে নাচতে থাক। আনন্দে উৎপত্তি, আনন্দে অবস্হিতি এবং আনন্দেই পরিণতি। এই আনন্দময় পরমেশ্বরকে ভুলেই মানবের যত প্রকার দুর্গতি। প্রেমস্বরূপ পরমেশ্বর আনন্দময়।
সংসারে কেউ কেউ বলে থাকেন—“সবই যদি তাঁর ইচ্ছায় হয়, তাহলে আমার এই দোষ-ত্রুটিগুলি তিনি ঠিক করে দেন না কেন ? যা কিছু সবই তো তিনি করেন, তাহলে এটা করেন না কেন ?”–এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, কর্তৃত্ববোধ যার আছে, আত্মবোধের চেষ্টার প্রয়োজনও কিন্তু তার আছে। আপন কর্তৃত্বের অভিমান নিয়ে মানব বলছে— ‘তিনি তো সবই করেন, তাঁর ইচ্ছায় যদি সবই হয়, তাহলে আমারটা কেন করছেন না ? – এই কতৃত্ববোধের অভিমান যতক্ষণ না তার যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে আত্মপ্রয়াস বা প্রচেষ্টাও করে যেতে হবে। আত্মাভিমান বিদূরিত হলে সম্পূর্ণ নির্ভরতা আসে আর তখনই মানবের সম্পূর্ণরূপে নির্বাক ও নিশ্চেষ্টভাবে থাকা সম্ভব। সুতরাং মানবের আত্মাভিমান বা কর্তৃত্ববোধ থাকতে তাকে তার দোষ-ত্রুটি এবং প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে।
অভিমানশূন্য মানবই একমাত্র সম্পূর্ণ ঈশ্বরে নির্ভরতা রাখেন এবং নিশ্চেষ্টভাবে থাকতে পারেন। তাই মানবের ক্ষুদ্র আমিত্বকে বা অহংকারকে দূর করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে সংগ্রাম করতে হবে। সচেষ্ট সংগ্রামের দ্বারা কর্তৃত্বের অভিমান বিলুপ্ত হলে মানব আপনা-আপনিই নিশ্চেষ্ট হবে, তার ঈশ্বরে নির্ভরতা আসবে ও সে পরম প্রেমিকে পরিণত হবে।
প্রিয় আত্মন্—পরমেশ্বর সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড পূর্ণ করে আছেন এবং তাঁর বাইরে আর কোন স্হান নেই। সমস্ত স্হানই তার ভিতরে। সব রূপ তাঁর মধ্যেই অবস্হিত। আর সমস্ত নাম তাঁরই, কোন নাম তাঁর নিকট অপরিচিত নয়। প্রিয় আত্মন্—অভিমানশূন্য হও। রাগ-দ্বেষ বর্জিত হও। কারণ অভিমান, রাগ দ্বেষ—এগুলি মিথ্যাজ্ঞানের খেলা। এগুলি থাকলে প্রেমের উন্মেষ হয় না। কৃত্রিমতা পরিহারপূর্বক অকৃত্রিমতার দিকে অগ্রসর হও। অকৃত্রিম প্রেমিকই একমাত্র পরমেশ্বরকে বোধ করেন । প্রেম—সাধনা, ভালবাসা—পথ, পরমেশ্বর—লক্ষ্য। আনন্দ প্রতিষ্ঠিত—পরমেশ্বর মহিমা অপার।