প্রশ্ন—আপনি অনুগ্রহ পূর্বক বাউলদের সহজিয়া রাগমার্গের বর্তমান ভজন সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে বলুন ৷
উত্তর— প্রিয় আত্মন্ !সহজিয়া বর্তমান সাধকগণ বলেন – রতিরূপ না হতে পারলে রসকে আস্বাদন করা যায় না। রস রতিকে আশ্রয় করে নিজেই নিজেকে আস্বাদন করে। এটাই ভগবৎ লীলার রহস্য এই রস এবং রতি শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা বা পুরুষ ও প্রকৃতি পূর্বেই তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এই তত্ত্ব ইন্দ্রিয়গ্রামের চেতনা দ্বারা কখনই অধিগম্য নয়। এই তত্ত্ব অপ্রাকৃত যা বোধে বোধের বিষয়। যেমন, কালার সহিত বোবার কথা বলার মত অপরোক্ষ অনুভূতিসাপেক্ষ।
প্রাকৃত কামচেতনাকে পরিহার করে মৃতবৎ আচরণ করলেই অপ্রাকৃত প্রেমের বাতাস লাগে। বাউলরা একেই জ্যান্তে মরা’ বলে। অর্থাৎ প্রাকৃত দেহ ভোগাকাঙ্ক্ষা বর্জিত যে মিলন – তাই প্রেমস্বরূপ সহজ মিলন ।
রূপের অভ্যন্তরে স্বরূপ রয়েছে এবং স্বরূপের প্রকাশ রূপের ভিতর দিয়ে ৷ সেইহেতু রূপ ও স্বরূপ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই বহিরূপেতেই স্বরূপ বিরাজমান । আর স্বরূপের ভিতরই রসের মানুষ বা সহজ মানুষের অবস্থিতি। রাগের পথে – প্রেমের পথে তাঁর অনুসন্ধানেযেতে হবে। অর্থাৎ উজান বাইতে হবে।
রূপের সাধনা ব্যতীত স্বরূপে স্থিতি হবে না এবং স্বরূপে স্থিতিলাভ না হলে রাগের মানুষ রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভ হবে না।
সুতরাং রূপকে অর্থাৎ প্রাকৃত দেহকে প্রথমে আশ্রয় করে অপ্রাকৃত স্বরূপে পৌঁছতে হবে এবং সেখানেই শৃঙ্গারঘন রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারলে যে, মানবদেহরূপ ভাণ্ডে স্বরূপ আছে আর সেই স্বরূপতত্ত্বের ভিতর পরমতত্ত্ব –রসের মানুষ সহজ মানুষ—শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান রয়েছেন—এই হল বাউলদের ‘ভাণ্ডেতে ব্ৰহ্মাণ্ড’
প্রাকৃত দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীত পরমতত্ত্ব তথা আত্মতত্ত্বের বোধেবোধই বাউলদের সাধনা। অর্থাৎ স্থুল হাতে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে অবশেষে স্বরূপেই পরমতত্ত্বের সাক্ষাৎ লাভ হবে । তন্ত্রের ভাষায় এটাই ষট্চক্র ভেদ, যোগমতে— যোগাভ্যাস, বেদান্তের মতে পঞ্চকোষ বিবেক আর বাউলদের উজান বাওয়া। মূলতঃ একই পথের প্রকার ভেদ।
এই বাউলরা সংসার সাগরে দেহভাণ্ডে মন পবনের উজান বাইছে—রূপ ধরে অরূপে পৌঁছে অপরূপের বোধে-বোধের জন্য।
বাউলগণ দেহাতীত আত্মাকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করে থাকেন, যথা— মানুষ, মনের মানুষ, অধর মানুষ, সহজ মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, ভাবের মানুষ, অচিন মানুষ, আলেখ নিরঞ্জন, সাঁই প্রভৃতি। আর বাউল সাধনাও ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লিখিত হয়ে থাকে, যেমন – সহজ ভজন, রসিক ভজন, মানুষ ভজন, রাগের ভজন, যুগল ভজন, ভাবের ভজন—ইত্যাদি ইত্যাদি ৷
প্রকৃতি হয়ে অর্থাৎ প্রকৃতিভাব আশ্রয় করে। পরমতত্ত্ব বোধ করতে হবে। আর মধুরভাবের মধ্যেই প্রকৃতির পরমসত্তা নিহিত থাকায় সহজ সাধককে মধুরভাব অবলম্বন করতে হবে।
এই মধুরভাব শ্রেণীভেদে তথা রতিভেদে তিন প্রকার, যথা সমর্থা, সমঞ্জসা এবং সাধারণী। সাধারণী রতিতে দেহমিলনাকাঙ্ক্ষাই প্রবল থাকে এবং ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’ প্রবল, তাই একে সহজ-প্রীতিও বলা হয়। এটা নিছক কাম প্রচেষ্টা মাত্র বলা যেতে পারে দেহ- সম্ভোগ-ইচ্ছা হতে উদ্ভব হয় এই সাধারণী রতির । কুব্জার প্রেম সাধারণী রতির দৃষ্টান্ত। সমঞ্জসা রতিতে অধিক পরিমাণে ভগবৎ প্রীতি বিদ্যমান, কিন্তু স্বাভিমানযুক্ত পুরুষকার বিদ্যমান থাকে । আর স্বাভিমান বশতঃ কিঞ্চিৎ সম্ভোগ-ইচ্ছা বর্তমান থাকে। সেইজন্য এটা গুণজ প্রীতি। এখানেও সম্পূর্ণরূপে পুরুষভাব বর্জিত হয় নি অর্থাৎ প্রকৃতিভাবে পূর্ণতা আসে নি। রুক্মিণী, সত্যভামাদি শ্রীকৃষ্ণ-মহিষীগণ এই সমঞ্জসা রতির দৃষ্টান্ত ৷ সমর্থা রতিতে কিঞ্চিৎ মাত্রও নিজ সম্ভোগ-ইচ্ছা থাকে না এবং এটা ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’, সেইজন্য এটা নৈসর্গিক প্রীতি। এখানে কিঞ্চিৎ মাত্রও স্বাভিমান নেই—সম্পূর্ণ প্রকৃতি স্বরূপ, অভিমান শূন্য । আত্মসুখ-সম্ভোগ-ইচ্ছা এইখানে বিলীন। কৃষ্ণ সুখার্থ হতে সমর্থা রতির উদ্ভব। নিজ মুখেচ্ছাশূন্য এই রতির দ্বারা সাধক তাদাত্ম্যপ্রাপ্ত হন। সেইজন্য এটা সমর্থা রতি। ব্রজগোপীগণই সমর্থা রতির দৃষ্টান্ত । প্রিয় আত্মন !
এই নৈসর্গিক প্রীতিযুক্ত সমর্থা রতিই হল ভগবৎ প্রেম, যা সম্পূর্ণরূপে স্বাভিমানশূন্য – নিজ সম্ভোগসুখেচ্ছা বর্জিত ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি’ যুক্ত ।
এই সমর্থা রতি উত্তরোত্তর বদ্ধিত হয়ে যথাক্রমে প্রেম, স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব ও মহাভাবে পরিণতি লাভ করে। মহাভাবই হলাদিনী-স্বরূপিণী শ্রীমতী রাধা। বাউলদের মতে এটাই আর এই হল রাধাতত্ত্ব—এটাই হল মধুর ভাবের চূড়ান্ত পরিণতি বা বিকাশ ।
শ্রীরাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি। যাঁর ভিতর দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নিজেকে বোধে-বোধ করছেন। এই রাধাতত্ত্ব আশ্রয় করেই রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ রাস রচনা করেন—রস আস্বাদন করেন ও করান। এই রাধাতত্ত্ব আশ্রয় না করলে কৃষ্ণতত্ত্ব কস্মিন কালেও জানা সম্ভব নয়। কারণ সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধাকে আশ্রয় করে নিজেকে আস্বাদন করেন এবং জানেন । সুতরাং শ্রীকৃষ্ণকে জানতে হলে রাধারাণীর কৃপা ব্যতিরেকে হবার নয় – বাউলদের এটাই বিশ্বাস।
অতএব সাধারণী রতির সাধকগণ সহজ প্রীতিবশতঃ অধম অধিকারী। এঁদের নিজ সুখাসক্তিই প্রধান— কৃষ্ণদর্শন হেতুমাত্র। আত্মমুখের চাহিদা প্রবল, এইজন্য এটা জীবভাব। এই রতিতে জাগতিক স্থিতি লাভ হয় । এটাই যোনিজ মানুষের স্থিতি। এঁরা ক্ষীরোদ সাগরে অবস্থান করেন, সংসার চক্রে যাতায়াত করেন এবং জাগতিক প্রাকৃতিক সুখ-দুঃখ ভোগ করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, বাউলমতে এটাই যোনিজ মানুষ ।
সমঞ্জসা রতির সাধকগণ গুণজ প্রীতিবশতঃ মধ্যম অধিকারী এটা মুক্ত ভাব । এই রতিতে মুক্তি লাভ হয়। এটা অযোনিজ মানুষের স্থিতি। ভগবানের অনন্ত গুণ-ঐশ্বর্যের প্রভাবে এরা মুগ্ধ। এদের ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও নিজ সুখস্পৃহাও রয়েছে। এই অবস্থায় বৈকুণ্ঠস্থিতি লাভ হয় ; যেখানে মুক্তিকামী মুক্তাত্মাগণ অযোনিজ দেহপ্রাপ্তহয়ে অবস্থান করেন। যেখানে অনন্ত বাসুদেব চতুর্ভুজ নারায়ণ লক্ষ্মী সহকারে অনন্ত ঐশ্বর্যে অনন্ত গুণমণ্ডিত হয়ে বিরাজমান।। মুক্তাত্মাগণ তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য ও অনন্ত গুণ দর্শন করে ভগবৎ ঐশ্বর্যের আনন্দে এবং মুক্তানন্দে মগ্ন থাকেন। বলাবাহুল্য বাউলমতে এঁরাই অযোনিজ মানুষ।
সমর্থা রতির সাধকগণ নৈসর্গিক প্রীতিবশতঃ উত্তম অধিকারী। এটা সহজভাব। এদের কৃষ্ণ-সুখেই সুখ— নিজ সুখস্পৃহা বর্জন করেন। শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে আছে :—
“আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ।”
এই সমর্থা রতিতেই ব্রজে স্থিতি হয় যা বাউলের ভাষায় সহজপুর। এটাই নিত্য বৃন্দাবন বা গোলোক । এই রতিতেই রাসমঞ্চে প্রবেশাধিকার লাভ ঘটে—যেখানে দ্বিভুজ ব্রজনন্দন শ্রীকৃষ্ণ বিরাজিত । তিনি নিরন্তর মুরলীধ্বনি সহকারে গোপীগণকে আকর্ষণ করছেন। সমর্থারতির সাধকগণ এই পরম স্থিতি লাভ করেন এবং পরমানন্দে নিমগ্ন হন। আর বাউলমতে এরাই সহজ মানুষ ৷
প্রিয় আত্মন্, সহজিয়া বাউলমতে এই হল মানুষ তত্ত্ব। যাঁরা জিতেন্দ্রিয় নন অর্থাৎ উন্নত আধার নন এবং উক্ত লক্ষণযুক্ত উত্তম প্রকৃতি লাভ করেননি, তাঁদের সহজিয়া বাউল সাধনায় প্রবেশা- ধিকার নেই। কারণ অনধিকারীগণের পতন অনিবার্য । বাউলগণ বলেন সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয়-সিদ্ধ হলেই রসসাধনায় প্রবেশাধিকার লাভ হয়। নতুবা অঘটন ঘটবে—নিশ্চয় জানবে। তাঁরা বলেন- সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবগণ এই সাধনার বিষয় চর্চা না করে ভালইকরেছেন। কারণ এটা ব্যাপকভাবে প্রচার হবার বিষয় নয়। এটা অতি দুর্লভ এবং একমাত্র উত্তমাধিকারীগণ ভিন্ন অন্য কারো এই আচারে অধিকার নেই । প্রিয় আত্মন,
বাউলমতের সাধনাপথে তিনটি অবস্থাভেদ আছে; যথা- প্ৰবৰ্ত্ত, সাধক এবং সিদ্ধ। সহজিয়া সাধনার পথে বাউলগণকে ঐ অবস্থাগুলি অবগত হয়ে অতিক্রম করতে হয়
প্রবর্ত্ত অবস্থা :—শ্রদ্ধা এবং দাস্যভাব ও দুটি আশ্রয় নাম ও মন্ত্র। শ্রীসদগুরুর চরণযুগল আশ্রয় করে নাম গ্রহণ করতে হয় এবং অপরাধশূন্য চিত্তে নাম নামী অভেদজ্ঞানে ভাবনা করতে হয়। শৌচ, তীর্থবাস, ইন্দ্রিয়সংযম ইত্যাদি এর অঙ্গ । এই অবস্থায় ব্যাকুল হয়ে মন্ত্র প্রাপ্তির জন্য সদগুরুর শরণাপন্ন হতে হয়। নামে রুচি না হলে মন্ত্রপ্রাপ্তি হয় না। নামে রুচি হলে চিত্তের কলুষ নাশ হয়। দেহ শুদ্ধ হয়। চিত্ত শুদ্ধিতে দেহে সাত্ত্বিকভাব উৎপন্ন হয় । তখন সদগুরু বা ঈশ্বর প্রসন্ন হন। দীক্ষামন্ত্র প্রাপ্তি ঘটে। মন্ত্রসিদ্ধি হলে প্রবর্ত্তর সাধক অবস্থায় উত্তরণ ঘটে।
সাধক অবস্থা :— রাগ ও মঞ্জরীভাব । দুইটি আশ্রয়—রাগানুগা ভাব এবং প্রকৃতি ।
এই অবস্থায় সাধকের আপন প্রকৃতিগত স্বভাব জাগ্রত হয় এবং সেই স্বভাবানুসারে রাগানুগা ভাবের আশ্রয় নিতে হয় এবং বৈরাগ্য অবলম্বন করে প্রাকৃত কামকে জয় করতে হয় । প্রাকৃত কাম বৈরাগ্য দ্বারা সংযম হলে গুরুকৃপায় সাধকের কাম জয় হয়। তখন প্রকৃতির প্রয়োজন হয়। কারণ প্রকৃতি ছাড়া পুরুষ একা সাধনা করতে পারে না ।রতিকে স্থির অবিচলিত রাখাই এই সাধনার উদ্দেশ্য –এই হল মঞ্জরীভাব । কিন্তু যতদিন প্রাকৃত কামবিজয় না হচ্ছে অর্থাৎ প্রাকৃত কামবিজয় না হওয়া অবধি প্রকৃতি সঙ্গ করা নিষিদ্ধ। ক্রমে মাধুর্যময় নিকুঞ্জ লীলার সূত্রপাত হয় তখন সাধক সিদ্ধ অবস্থায় উপনীত হন।
সিদ্ধ অবস্থা :— প্রেম, সহজভাব বা মহাভাব এবং দুটি আশ্ৰয় – শ্রীরাধারাণীর চরণ যুগল ও প্রেমরাগ। এই অবস্থায় প্রাকৃতভাব বিবর্জিত অপ্রাকৃত চিন্ময় সহজাবস্থার শৃঙ্গারাত্মক রস মাধুর্যের উন্মেষ হয় । প্রিয় আত্মন,
প্রবর্ত্ত অবস্থার পরিণতি সাধক অবস্থা এবং সাধক অবস্থার পরিণতি সিদ্ধ অবস্থা। প্রবর্ত্ত না হয়ে সাধক হলে পতন অবশ্যম্ভাবী। আর সাধকের পূর্ণ পরিণতিই সিদ্ধ অবস্থা।
প্রবর্ত্ত অবস্থায় মন্ত্রসিদ্ধ হলে বহিরঙ্গা মায়াশক্তি*(*পরে বহিরঙ্গা মায়াশক্তি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।) অপসারিত হয়এবং ভ্রমনিবৃত্তি হয় । এরপর সাধক অবস্থায় সাধনা দ্বারা রতি স্থায়ীবা অটুট হয় । তখন সিদ্ধ অবস্থা উপস্থিত হয়ে থাকে।
বিন্দু রতিরই নামান্তর । এই বিন্দু বা রতি যখন নিষ্কম্প বা স্থিরহয়, তখনই অটুট অবস্থা বা সিদ্ধ অবস্থা । প্রিয় আত্মন্, এই সিদ্ধদেহে প্রেম ও রসেরঅভিব্যক্তি হয়।
প্রবর্ত্ত অবস্থায় প্রকৃতিগ্রহণ নরকের দ্বারস্বরূপ। কারণ ঐ অবস্থাতে প্রকৃতি-সঙ্গ হলে জীবের পতন হয়ে থাকে। সেইহেতুপ্রয়োজন – দাস্যভাব এবং সদগুরুর চরণযুগল আশ্রয় এবং শ্রদ্ধা রাগ। এটা অভাব স্থিতি—জীবভাব – ক্ষীরোদ সাগরে স্থিত সামাহ্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ ।
দ্বিতীয় অবস্থায় প্রকৃতি মাতৃদ্বারস্বরূপ জননী। তাই প্রকৃতি মুক্তির দ্বারস্বরূপ । সেই হেতু প্রয়োজন—মঞ্জরীভাব এবং সখীর চরণযুগল অশ্রিয় ও রাগানুগা ভাব । এই অবস্থার নাম স্বভাব—এটাই মুক্তস্থিতি। বৈকুণ্ঠ স্থিত অযোনিজ মানুষ।
তৃতীয় অর্থাৎ সিদ্ধ অবস্থায় সাধকের দেহ পরিণত হয় সিদ্ধদেহে এবং এই অবস্থায় প্রেম ও রসের পূর্ণ অভিব্যক্তি হয় । এটা রসিক অবস্থা বা সহজস্থিতি। সেইহেতু এটা মহাভাব এবং আশ্রয় শ্রীরাধারাণীর চরণযুগল ও প্রেমরাগ। এটাই সহজস্থিতি—মহাভাব বা নব বৃন্দাবনে স্থিত সহজ মানুষ ।
প্রিয় আত্মন্, এখন বুঝলে তো যে, প্রবর্ত্ত অবস্থায় প্রয়োজন নামাশ্রয় ও মন্ত্রাশ্রয়, সাধক অবস্থায় রাগাশ্রয় ও প্রকৃতি আশ্রয় আর সিদ্ধ অবস্থায় হয় রসের পূর্ণতা, তাই রসিক
সহজভাবে প্রবেশ করলে সাধকের ভিতর এক অদ্ভুত দিব্য রূপান্তর উপস্থিত হয় – ইহা বস্তুতঃ প্রেমের অবস্থা । তখন আর প্রকৃতি সেবার প্রয়োজন হয় না। পরিপক্ব সিদ্ধদেহে সামান্য মানসিক ক্রিয়াতে অনুক্ষণ মিলনাত্মক সহজানন্দের আস্বাদন হতে থাকে ৷ এই অবস্থাই বাউলের সহজ অবস্থা । এইখানেই বাউলের মনের মানুষের বোধে বোধ হয় । আর একেই বলে মহা উল্লা সময় উজ্জলৱস বা অপ্রাকৃত চিন্ময়রাস । এর মধ্যেই সৃষ্টির লীলা রহস্যের মূল নিহিত রয়েছে।
প্রিয় আত্মন্, রস সাধনার মূল উদ্দেশ্য হল রসিক হওয়া । এই রসতত্ত্ব সাধারণ জীবের ধারণার অতীত। এই সহজভাব— জীবভাব এবং ঈশ্বরভাবের অতীত। বাউলগণ বলেন – ‘বিন্দু টললে জীব এবং অটলে ঈশ্বর।’ অর্থাৎ বিন্দুর নিস্পন্দ বা রতির অটল অবস্থা হল ঈশ্বরভাব এবং এর পরের অবস্থা হল রসিকের অবস্থা । আর কেবলমাত্র রসিকগণই এই রসের আস্বাদনে সমর্থ হন। বাউলদের ভিতর এইরূপ প্রচলিত ধারণা আছে যে—শুকদেব, সনক, সনাতন, সনন্দ, সনৎকুমার ইত্যাদি মুনিগণ প্রকৃতিসঙ্গ বিমুখ ছিলেন এবং কৌমার্যব্রত ও বৈরাগ্য অবলম্বন করে অটলের সাধনা করেছিলেন। ঐ মহাপুরুষগণ যে অটল অবস্থা লাভ করে ছিলেন সেই অবস্থা ঈশ্বরস্থিতি
প্রিয় আত্মন্, বাউলগণ বলেন – সাধারণী রতির নায়িকার সহিত রাগসাধনা সম্ভব নয়, কারণ এরা ব্যভিচারিণী হয়—কাণ্ডারী হতে পারে না। এদের সংস্পর্শে রতি নাশ হয়। সমঞ্জসা রতির নায়িকারও মহাভাব হয় না । সমর্থা রতির নায়িকাই একমাত্র রাগসাধনার অনুকূল। এই সমর্থা রতিতেই একমাত্র মহাভাব হয়, যাহা সহজস্থিতি । বাউলরা বলেন –বিন্দু স্থির বা নিষ্কম্প না হওয়া পর্যন্ত রাগসাধনায় প্রকৃতি বিচার অপরিহার্য। কিন্তু সিদ্ধের নিকট এইরূপ কোন ভেদ নেই। তাঁর নিকট সমগ্র প্রকৃতি-সত্তাই শ্রীরাধারূপে প্রকটিত
বাউলমতে কৃষ্ণমহিমা এবং রাধাপ্রেম রহস্যের পরম উৎকর্ষ হয় এই মানবদেহ ভাণ্ডে। ঐ পরম তত্ত্বের বোধে বোধ দেহভাণ্ডের জ্ঞান হতেই হয়। অতএব এই দেহতত্ত্ব জানলেই ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব অচিরেই জানা যাবে। তাঁরা বলেন – অগ্নির সাহচর্য ছাড়া দুধ যেমন আবর্তিত হয় না, সেইরূপ প্রকৃতির সাহায্য ব্যতীত বিন্দু আবর্তিত হয় না । আর বিন্দুর আবর্তন ব্যতীত রসের অভিব্যক্তি হয় না। সুতরাং প্রকৃতি অগ্নিকুণ্ডস্বরূপা ।
এখন সহজ তত্ত্বের দুটি পদের উল্লেখ করছি যেগুলির মধ্যে সহজ তত্ত্বের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে—
সহজেতে জীব জন্মে সহজে বিনাশে,
সহজেতে খায় পিয়ে সহজেতে ভাসে।
সহজেতে খায় জীব দেখহ ভাবিয়া,
সহজ সন্ধান কেহ না পায় খুঁজিয়া । ’
অন্য পদটি :— ‘ সাধি তত্ত্ব দেহে হই সাধক প্রকৃতি,
স্বভাব প্রকৃতি হলে তবে রাগরতি ॥
প্রকৃতি পুরুষ হয় দেহান্তর হলে
রসাশ্রয় প্রেমাশ্রয় সাধন করিলে ॥’
এখন বুঝতে পারছ, রসিক ভিন্ন রস আস্বাদন করা দুরূহ। সুতরাং প্রকৃতি সঙ্গেও যাঁদের রতি অটল এবং বিন্দু নিষ্কম্প থাকে তাঁরাই সহজ বাউল বা রসিক বাউল ।