স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের দিন দেখেছিলাম যে, স্বামীজি ওয়াডিগুডেম নামক গ্রামে একটি মন্দিরে এক বৃদ্ধা মায়ের কাছে মধ্যাহ্নভোজন করার পর শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থতা অনুভব করতে থাকেন এবং তিনি বুঝতে পারেন যে, ওই মহিলা তাঁকে খাবারের সাথে তেমন কিছু মিশিয়ে দিয়েছে_ যার জন্য তিনি আর বিশেষ নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। যদিও তার ভেতরের জ্ঞান সবই ছিল।
ওই বৃদ্ধাটিই এই ফাঁদ পেতে ছিল__ যাতে কোনো না কোনো ব্যক্তি এসে তার ফাঁদে পড়ে! অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে স্বামী বাউলানন্দজীর আগমন ঘটে এবং এটাকে ওই বৃদ্ধা রমণী একটি বিরাট সুযোগ বলে মনে করে কারণ স্বামীজী ছিলেন ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী। স্থানীয় লোকেদের কাছে তার তেমন কোনো মান-মর্যাদার জায়গাও ছিল না ! তাই বৃদ্ধা স্বামীজীকেই দেবতার নিকট বলি দিতে বা উৎসর্গ করতে চাইলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, কোনো গ্রামবাসী এরূপ একজন অপরিচিত লোকের খোঁজ খবরের তোয়াক্কাই করবে না।এমনকি কেউ খোঁজ করতে এলে_’স্বামীজি পরবর্তী গ্রামের দিকে যাত্রা করেছেন’– এই বলে তিনি অনায়াসে ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন!
আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় স্বামীজীকে দেখা মাত্র এই চিন্তাই তার মনে উদয় হয়েছিল । ঐ মহিলা জল্পনা কল্পনা করতে লাগলো এবং লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য প্রথম ধাপে স্বামীজীকে দুপুরে তার নিকট খাওয়ার কথা বলেছিল‌। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ওই বৃদ্ধা মহিলা কৃতকার্য হোল। দুপুরে স্বামীজীকে সে বিষাক্ত খাবার খাইয়েছিল । ষড়যন্ত্র এবং ফন্দি সম্বন্ধে অবহিত না থাকায় স্বামীজী দুপুরে তার দেওয়া খাবার খেলেন সঙ্গে সঙ্গে ফল ফলে গেল!! তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন এবং ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যার দিকে তিনি কথা বলতে এবং চলাফেরা করতে অপারগ হয়ে পড়লেন । কিন্তু অবচেতন মনে তিনি বুঝতে পারছিলেন মন্দিরে কি হচ্ছে ! বৃদ্ধা মহিলা তার বধ্য-কে অসহায় অবস্থায় দেখে খুবই আনন্দিত হোল। ঐ মহিলা তার সহচরদের প্রয়োজন মতো আয়োজন করার জন্য খবর পাঠালো__ যাতে স্বামীজীকে ঠিক মধ্যরাত্রে বলি দেওয়া যায় ! ওই বৃদ্ধা নিশ্চিত ছিল যে, সে যে ঔষধ প্রয়োগ করেছে__ তা অন্তত একদিন স্বামীজীকে সব সজ্ঞান অবস্থায় কাষ্ঠখন্ডের মতো ফেলে রাখতে পারবে ! অন্ধকার হয়ে এল __স্বামীজি আরো অক্ষম হয়ে পড়লেন! আর মহিলাটি ততই সক্রিয় হয়ে উঠলো! স্বামীজী বুঝতে পারছিলেন _ কতিপয় লোক তার সঙ্গে কথা বলতে আসছে এবং চলে যাচ্ছে এরূপ উত্তেজনাপূর্ণ কর্ম মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলতে থাকলো। খুব কম করে দশ জন লোক ব্যস্ততার সঙ্গে মন্দিরে যাতায়াত করছিল স্বামীজী এক অদ্ভুত অবস্থায় পড়ে রইলেন । তাঁর মন সক্রিয় তিনি সব কিছুই বুঝতে পারছেন _পাশ ফিরতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না! এরূপ অসহায় অবস্থায় এক সাবধান বাণীর কথা তাঁর মনে পরলো !;প্রায় দশ বছর পূর্বে এক বৃদ্ধা মহিলা তাকে এই সাবধান বানিয়ে দিয়েছিলেন একদা স্বামীজি অন্ধপ্রদেশের গুডুর নামে এক শহরে যাচ্ছিলে শহরে পৌছাতে আরো আধমাইল রাস্তা বাকি আছে _ এমন স্থানে তিনি একটি সমাধি দেখতে পেলেন এবং রাতটা সেখানেই তিনি অবস্থান করলেন । ওই সময় একজন বৃদ্ধা মহিলা ও সেখানে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা উভয়েই চারদিন সেখানে রইলেন। পঞ্চম দিনে স্বামীজী স্থান ছেড়ে চলে যাবার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় বৃদ্ধটি তাকে ডেকে বললেন বৎস ভবিষ্যতে আমারই মত দেখতে এক বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে তোমার দেখা হবে । আমি সাবধান করে দিচ্ছি __ তুমি তাকে বিশ্বাস করো না !;অসহায় অবস্থায় পড়ে স্বামীজীর সেই সাবধান বাণীর কথা মনে পড়লো ! যে বৃদ্ধা মহিলা তাঁকে দুপুরে খেতে দিয়েছিলেন __তিনি ঠিক ওই বৃদ্ধা মহিলার মতো দেখতে !!
দুটি ঘটনা একত্র করে স্বামীজি বুঝতে পারলেন যে কোন ক্ষতি করার অভিপ্রায়ে বৃদ্ধ মহিলা তাঁকে বিষাক্ত খাবার দিয়েছেন কিন্তু কিছুই করতে পারেন নাই! স্বামীজি অসহায় অবস্থায় পড়ে রইলেন তাদের হাত থেকে পালাতে‌ও পারছেন না!
‌‌ মধ্যরাত্রির ঠিক কিছুক্ষণ পূর্বে স্বামীজীর এক অদ্ভুত এবং উপভোগ্য দর্শন লাভ হোল। আমরা জানি যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন, সে জায়গায় ছিল একটি শিব মন্দির!! মন্দিরের ভিতরে শিব ও পার্বতীর মূর্তি ছিল । তারা সমগ্র বিশ্বের আদি পিতা-মাতার প্রতীক! যদিও বাইরের দিক হতে মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল_ তথাপি আদি পিতা মাতা ঘরের বাইরে কী কী হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছিলেন‌।(ক্রমশঃ)
*আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা*
~~~~~~~~~~~~~~~
_স্বামী বাউলানন্দ_
জিজ্ঞাসা:—ঈশ্বর লাভ করতে হলে কি বনে গিয়ে কৃচ্ছসাধন করে কঠোর তপশ্চর্যা প্রয়োজন?
স্বামীজি:—- না! বাড়িতে আমরা দেখি মায়েরা রান্নাঘরে গিয়ে উনুন ধরান। আগুনের সামনে বসে ধোঁয়ার জ্বালা সহ্য করে রান্না করেন। বাড়ির সমস্ত লোক সেই খাবার খায়। ঠিক যেমন_ খাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও প্রত্যেককে রাঁধতে হয় না, ঠিক তেমনি ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য সকলকে বনে যেতে হয় না। যারা পূর্বে পূর্বে বনে গিয়ে তপশ্চর্যা করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য সকলে ঈশ্বর উপলব্ধি করতে পারে।
অনেক বাবা-মা লেখাপড়া শেখার জন্য 4/ 5 বছরের জন্য ছেলেমেয়েদের অন্যত্র পাঠায় । তখন তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকে। ঠিক তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বা অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য লোকে বিদেশ যায়_ অথচ ঐ সমস্ত দেশ তাদের অজানা। বছরের পর বছর ছেলে মেয়েদের দেখতে না পেলেও মা-বাবা বেশ নিশ্চিন্ত থাকে । তাহলে বাবা মা ছেলে মেয়েদের কেন নির্জনে পাঠায় না_ যাতে তাদের ছেলেমেয়ে ঈশ্বরলাভ করে বাড়ি ফিরে আসতে পারে!!
দেখুন,প্রত্যেকের নির্ভীক এবং দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। যখন একাগ্রতা লাভ হয় তখনই একমাত্র ঈশ্বরের দর্শন সম্ভব। যদি আপনারা ঈশ্বর দর্শন করতে চান বা কোনো ভালো কাজ করতে চান তাহলে আপনাদের অবশ্যই প্রবল ইচ্ছা থাকা দরকার। হৃদয় বলবান হোলে__ ইচ্ছা যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি বহন করে। ইন্দ্রিয় সকল সবল হলে হৃদয় বলবান হয়। শরীরকে গুণগতভাবে ভালো খাবার দিলে ইন্দ্রিয়গণ সবল হয়। ব্যক্তি যে খাবার খায় সেই খাবারের গুন মন গ্রহণ করে। খাদ্য যেখানে উৎপন্ন হয় শুধুমাত্র সেখানকার গুণাগুণের উপরেই খাদ্যের গুনাগুন নির্ভর করে না, প্রস্তুতকারকের গুণের উপরেও তা নির্ভর করে। ওই খাবার ক্ষুধা অগ্নিতে না দিয়ে শরীরের মধ্যে অবস্থিত বৈশ্বানরকে(অগ্নিকে) অর্পণ করা উচিত ।
এই হল মহাযজ্ঞ। গুণগত ভালো খাদ্যবস্তু সংগ্রহ, সাত্ত্বিক মনোভাব নিয়ে খাদ্য প্রস্তুত এবং বৈশ্বানরকে অর্পণ এই সমস্ত নিয়ে হয় মহাযজ্ঞ।
গুণগত তামসিক বা রাজসিক খাবার খেলে বা যারা অকথা-কুকথা বলতে বলতে বা অসৎ চিন্তায় মগ্ন হয়ে রান্না করে তাদের রান্না করা খাবার খেলে ভালো ফল তো হয়‌ই না বরং অনেকসময় খারাপ ফল দেখা দেয়। এর কারণ হলো__ যে খাবার হিসেবে আমরা যা খাই, তা শরীরের ভিতরে গিয়ে হজম হয় এবং এর সার অংশ রক্তে পরিণত হয়। ওই রক্ত খাদ্যের মধ্যে যে গুন ছিল তা বয়েনিয়ে গিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। রক্তের কিছু অংশ শুক্র বা সৃজন শক্তিতে পরিণত হয়। এই শুক্র আবার সূক্ষ্ম শক্তিতে রূপান্তরিত হয় । এটাই ব্যক্তিকে কর্মঠ এবং শক্তিশালী করে তোলে। যদি ওই সূক্ষ্মশক্তি ভালো খাদ্যবস্তুর গুণ গ্রহণ করে, তাহলে খাদ্যবস্তুর তাহলে ব্যক্তি কোনো কাজ যথাযথভাবে করতে সক্ষম হবে এবং তার ফল‌ও ভালো হবে।
শরীরে যে সৃজন শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে তা বেশ কিছু সময় শরীরে রাখা প্রয়োজন, যাতে তা সূক্ষ্মশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। যদি এই সৃজনশক্তি যথেষ্ট পরিমাণে সংরক্ষণ না করা হয় এবং ইন্দ্রিয় সুখ চরিতার্থ করার জন্য অহেতুক খরচ করা হয়_ তাহলে ব্যক্তির সুক্ষ্ণশক্তি কখনোই দৃঢ় হয় না, প্রবল ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন হোতে পারে না এবং ইচ্ছা পূরণের জন্য ঐ ব্যক্তি চেষ্টাও করতে পারে না।
সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির সৃজনশক্তি ধারণ করা অবশ্য প্রয়োজন। পরে যখন সুক্ষ্ণশক্তির গঠন আরম্ভ হয় তখন সে তার ইচ্ছা অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারে। এই গুন হলো প্রধান উপাদান। কিছুদিন ধরে ব্রহ্মচর্য পালন না করলে কারোরই আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব নয় ‌। প্রত্যেক ছেলেমেয়েদের ব্রহ্মচর্য পালন করা উচিত ‌।