স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের সংখ্যায় দেখেছিলাম যে, মন্দিরে খাবারের সাথে বিষ পান করার পর থেকে স্বামীজীর শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল । সেইজন্য কেশরী সিং তাঁকে কুনাভরমে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হোলো এবং দু-তিন সপ্তাহ তার কাছে চিকিৎসা চালানো হোলো। কিন্তু এই চিকিৎসায় কোন ফল পাওয়া গেলো না । সেই জন্য স্বামীজি ওখান থেকে রাজমন্দ্রিতে ফিরে এলেন । এখানে পুষ্কর ঘাটের নিকট বাবাজী-মঠে গেলেন । রাজমন্দ্রির ভেঙ্কট রামাইয়া এবং অন্যান্য ভক্তগণ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দেখতে এলেন। স্বামীজীর স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তারা খুব উদ্বিগ্ন হলেন । তিনি তাদেরকে ওয়াডিগুডেমে কি ঘটেছিল __তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। কেশরী সিং-এর বাড়িতে তাঁর যে চিকিৎসা হয়েছিল তাও তিনি তাদেরকে জানালেন। ভক্তগণ স্বামীজীর জীবন রক্ষার জন্য খুব উদগ্রীব হলেন। তারা একজন বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। চিকিৎসক স্বামীজীকে পরীক্ষা করে ওষুধ দিলেন। কয়েক সপ্তাহ সেই ওষুধ চললো কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না । আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক সময়ে সময়ে ওষুধ পাল্টিয়ে দিতে লাগলেন কিন্তু ফল সেই একই হোলো_স্বামীজীর স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি দেখা গেল না । এরপর ভক্তরা সকলে মিলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বদলে ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা করা শুরু করলো। ন্যাচারোপ্যাথি বিশেষজ্ঞ এক দম্পতি স্বামীজীর চিকিৎসা করতে লাগলেন। কিন্তু এই চিকিৎসাতেও কোনো ফল হলো না। স্বামীজীর শরীর ক্রমে ক্রমে খারাপের দিকে যেতে লাগলো। দিনের পর দিন তার হাত পা সরু হয়ে যেতে লাগল এবং পেট ফাঁপতে লাগলো। স্বামীজীর স্বাস্থ্য ক্রমেই অবনতির দিকে যাওয়ায় ভক্তগণের উদ্বেগ আরো বাড়তে লাগলো। উপযুক্ত ওষুধের জন্য ভেঙ্কট রামাইয়া বিভিন্নজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন । স্বামীজীর শরীরের অবস্থার অবনতি হলেও কিন্তু তিনি সবসময় প্রফুল্ল ছিলেন । যে সমস্ত লোক তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য আসতো _ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাদের নিয়ে আলোচনায় রত থাকতেন। দুবেলাই নদীতে স্নান‌ও করতেন _ তিনি যে শরীরে কষ্ট পাচ্ছেন তা বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারতো না। ভক্তগণ সব সময়ই তাঁকে হাসতে দেখতেন ।
ভেঙ্কট রামাইয়ার উদ্বেগপূর্ণ অনুসন্ধানে সাড়া মিললো, তার এক বন্ধু তাকে বললেন_ কাম্বালাপেটাতে এক বৃদ্ধা থাকেন, তিনি এই সমস্ত রোগের ওষুধ দিতে পারেন! তিনি রোগীকে বমি করিয়ে বিষ বের করে দেন ! এই চিকিৎসার প্রতি ভরসা রেখে রামাইয়া স্বামীজীকে বৃদ্ধার নিকট নিয়ে গেলেন । বৃদ্ধা স্বামীজীকে পরীক্ষা করে ওষুধ খাওয়ালেন। পরেরদিন স্বামীজীর খুব বমি হতে লাগলো এবং পেটের অভ্যন্তরের সমস্ত বিষ বেরিয়ে গেল । সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
তবে সমস্যার এখানেই সমাপ্তি হলো না ! ইতিপূর্বেই স্বামীজীর শরীরের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছিল। ঐ মহিলা স্বামীজীকে মুরগির মাংস খাওয়ানোর কথা বললেন কিন্তু তাতেও আবার সমস্যা দেখা দিলো। কারণ, নিজের শরীরের জন্য স্বামীজি অন্য একটি জীবন নষ্ট করতে রাজি হোলেন না । রামাইয়া ডাক্তারের নিকট এই অসুবিধার কথা বললেন এবং বিকল্প কিছু খাবারের কথা বলার জন্য বৃদ্ধা ডাক্তারকে অনুরোধ করলেন ।বৃদ্ধা_ ভাঙ্গা চাল দিয়ে তৈরি তরল খাবারের সঙ্গে পুরনো তেঁতুলের চাটনি খাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং এইভাবে তিনদিন খেতে বললেন।
ভেঙ্কট রামাইয়া তার বাড়িতে পথ্য তৈরি করিয়ে তার পুত্র লক্ষ্মীপতি মারফত স্বামীজীর নিকট পাঠিয়ে দিতেন। একদিন ওই সময় স্বামীজি শরীরে অস্বস্তি বোধ করছিলেন_ তিনি খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খাবার ঠিকমতো তৈরি হয়নি!” এই কথা বলে খাবার ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। ছেলেটি খাবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার মাকে সব কথা জানালো। তার মা পুনরায় খাবার তৈরি করে পাঠালেন! স্বামীজি সেই খাবার‌ও ফেরত পাঠালেন। ঐদিন ছেলেটির স্কুলে পরীক্ষা ছিল। যাতায়াতে তার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছিল তবুও তার মা তৃতীয়বার খাবার তৈরি করে বললেন_” পরীক্ষা দেওয়া হোক বা না দেওয়া হোক_ স্বামীজীর কাজটা আগে!”_ এই কথা বলে পূনর্বার ছেলেকে স্বামীজীর কাছে পাঠালেন। প্রকৃতপক্ষে ঐ ছেলেটির সেদিন ছিল ধৈর্যের পরীক্ষা ! সে তার মায়ের আদেশ লঙ্ঘন করতে পারলোনা_ তৃতীয়বার স্বামীজীর নিকট খাবার নিয়ে গেল! কিন্তু এইবার সে স্বামীজীর নিকট খাবারটা নামিয়ে দিয়ে স্বামীজীর কথার অপেক্ষা না করেই চলে গেল!
ওষুধ এবং সেবায় ভালো কাজ হলো! ক্রমে ক্রমে স্বামীজি সুস্থ হয়ে উঠলেন ! শীঘ্রই তিনি স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পেলেন এবং পুনরায় তপশ্চর্যা করার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলেন।।(ক্রমশঃ)
~~~~~~~~~~~~~~~~
*আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা*
~~~~~~~~~~~~~~~~
স্বামীজী একসময় কথাপ্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন –
“দ্যাখো, তােমরা গত কয়েক মাস ধরে এখানে আসার পরিকল্পনা করছিলে। কিন্তু আসতে পারো নাই। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছায় নয়। এখানে তােমাদের উভয়ের কিছু কাজ আছে, সেজন্য ঈশ্বর তােমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তােমরা যদি আসার পরিকল্পনা নাও করতে তাহলে কিছু একটা ঘটতো যা তোমাদেরকে এখানে নিয়ে আসতো।
ঈশ্বর সম্বন্ধে কি বলার আছে? প্রকৃত ধারণা থাকার প্রয়ােজন আছে এবং সেই ধারণাকে কাজে লাগানো দরকার।
আমরা মানব জাতি। ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা হয়েছে সেই ধারণাকে কাজে লাগালেই আমাদের ঈশ্বর উপলব্ধি হবে।
ব্যাপারটা যদি এতই সহজ তবে লােকে এই পথে অগ্রসর হতে পারছে না কেন ? আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে চিন্তা করি, তাঁকে জানাবার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষের কথা একবারও চিন্তা করি না ৷ মানুষ সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণা নাই। মানুষ কি তা জানবার চেষ্টাও করি না। ঈশ্বরকে জানার আগে মানুষকে জানা উচিত। মানুষ কি? মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে কি সম্পর্ক? এই সমস্ত প্রশ্ন সম্বন্ধে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
একদিকে মানুষের সঙ্গে নিম্ন স্তরের জীবের এবং অপর দিকে মানুষের সঙ্গে পরমাত্মার কি সম্পর্ক এ সম্বন্ধে গভীর মনোযােগের সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তির অনুসন্ধান করা উচিত। নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানা দরকার। নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা হবার পর তাকে সেই পথ অবলম্বন করতে হবে, যে পথে চরম অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়।
সর্বেসর্বাকে উপলব্ধি করা এবং তাঁর সঙ্গে একীভূত হওয়া নিশ্চিত সম্ভব যদি ঠিক ঠিক ধারণা নিয়ে যথাযথ অভ্যাস করা যায়। কেবলমাত্র আলােচনা করে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না।”
স্বামীজী চোখ খুলে তাকালেন এবং আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বুঝতে পেরেছো?” তিনি পুনরায় বলতে শুরু করলেনঃ “ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। যা সত্য তাই ব্ৰহ্ম। যা চিরস্থায়ী তাই ব্ৰহ্ম। যা শাশ্বত তাই ব্ৰহ্ম। ক্ষণস্থায়ী সবই মিথ্যা। আমরা চর্ম চক্ষু দিয়ে যা দেখি তা হল জগৎ। জগতের সবই আমাদের দৃষ্টিগোচর। তাহলে নির্দিষ্ট আকারে যা দৃষ্টিগােচর তা কি মিথ্যা?
জগৎ যে সমস্ত উপাদান দিয়ে গঠিত তারা সকলে অস্থায়ী। তারা নিয়ত পরিবর্তনশীল। তারা চিরস্থায়ী নয় সেহেতু তারা ক্ষণস্থায়ী। যেহেতু পরিণামে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে সেহেতু তারা মিথ্যা। যার সৃষ্টি আছে তার বিনাশও আছে। একদিন তার বিনাশ হবেই। আমরা জানি আমরা একদিন মরব। যে সন্তানকে আমরা স্নেহ দিয়ে ভালবাসা দিয়ে লালন পালন করছি তারও মৃত্যু ঘটবে ৷ এটাও আমরা জানি যে বাড়ী আমরা লােহা এবং সিমেন্ট দিয়ে তৈরী করেছি সেটাও একদিন ধ্বংস হবে। পরিবর্তন এবং বিনাশ হোল বস্তুর প্রকৃতি।
যে বস্তুকে আমরা দেখি, স্পর্শ করি এবং যাকে আমরা ভােগ করি তা কি করে মিথ্যা হতে পারে? এর উত্তর হোল — প্রত্যেক বস্তু পঞ্চ ভূত দ্বারা গঠিত – যথা-ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। ঈশ্বরীয় শক্তিই পঞ্চভূত দিয়ে বস্তুকে গঠন করে। শক্তি ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব নাই। বস্তুকে বাদ দিয়ে শক্তি কাজ করতে পারে না। বস্তু এবং শক্তির সমন্বয়ে জড় বস্তু গঠিত। জড় বস্তু ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং এর বিনাশও হয়। চৈতন্য বস্তুকে গঠন করে এবং এই চৈতন্যের প্রভাবে বস্তুর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই চৈতন্যই হল ব্ৰহ্ম। ইহা শাশ্বত, সনাতন। ইহাই সত্য।” … [ক্রমশঃ]