স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আগের দিন বলা হয়েছিল যে স্বামীজী পেরেন্টাপল্লীতে কিছুদিন থাকার পর ভদ্রাচলমের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রাচলম্ দক্ষিণের একটি বিখ্যাত তীর্থস্থান। কয়েক শতাব্দী পূর্বে ভক্ত রাম কর্তৃক এখানে একটা বড় মন্দির হয়েছিল । নিজাম সরকারের ভূমি রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মচারী ছিলেন এই রাম। তার প্রকৃত নাম ছিল গোপান্না। পরবর্তীতে তাঁর ভক্তিপূর্ণ আচার-ব্যবহারের জন্য তিনি রামদাস নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর হেফাজতে যে সরকারি তহবিল ছিল, তা তিনি এই মন্দির বিশাল মন্দির নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিলেন। এই অপরাধে সরকার তাঁকে অভিযুক্ত করেন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এই আদেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি নিরন্তর ভগবান রামচন্দ্রের নিকট প্রার্থনা জানাতে থাকেন।কথিত রয়েছে তাঁর এই ভক্তিপূর্ণ প্রার্থনায় প্রসন্ন হয়ে_ রামচন্দ্র এবং লক্ষণ নিজামের সামনে আবির্ভূত(প্রকট) হয়ে স্বর্ণ দিয়ে সমস্ত অর্থ মিটিয়ে দিয়েছিলেন । এর ফলে রামদাস জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে যান এবং বাকি জীবন ঈশ্বর চিন্তায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন।ঈশ্বরের কৃপায় এবং সাধন-বলে তিনি জন্ম-মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন অর্থাৎ পরবর্তী জীবনে এই রামদাস একজন আধ্যাত্মিক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামের মন্দির সারা বৎসর বহু ভক্তকে আকর্ষণ করে এবং এর ফলে সবসময়েই এই মন্দিরে অনেক লোকজনের ভিড় লেগেই থাকে। রাস্তার অপর পারে রামমন্দিরের বিপরীত দিকে একটি ছোট্ট পাহাড় আছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে একটি শিবমন্দির নির্মিত হয়েছিল কিন্তু এই স্থানটি দর্শকদের বা তীর্থযাত্রীদের ততো বেশি আকর্ষণ কোরতো না_ যতটা কোরতো রামমন্দির! শুধু একজন পুরোহিত সকালে-বিকালে শিবের পুজো করতেন। তুলনামূলকভাবে ওই স্থানটি শান্তিপূর্ণ এবং অবস্থানের উপযোগী ভেবে স্বামী বাউলানন্দজী সেখানেই অবস্থান করতে শুরু করলেন। সেই সময় মিঃ রামানন্দ রাও নামে এক ফটোগ্রাফার স্বামীজীকে পরিচর্যা করতেন । সেই সময় রামমন্দিরের কয়েকজন পুরোহিত এই শিবমন্দিরে প্রায়ই আসতেন এবং স্বামীজীর কাছে বসে নানান আধ্যাত্মিক আলোচনায় কিছুক্ষণ করে সময় কাটাতেন। ভদ্রাচলমে থাকাকালীন স্বামীজীর মধ্যে ভাবজগতের চরম পরিবর্তন দেখা দিলো। ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা তাঁর প্রবল হয়ে উঠল । এই সময়ে তিনি কারো সঙ্গ করতে পারতেন না, তাঁর খাবারে রুচি ছিল না! সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি নদীতে স্নান করতে যেতেন, তারপর মন্দিরে বসে ধ্যান করতেন! অন্য কোনরূপ কার্যকলাপের দিকে তাঁর কোন হুঁশ থাকতো না । তিনি কি খাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন __এসব কিছুই তিনি বুঝতে পারতেন না । সবসময়েই তিনি যেন সমাধিতে রয়েছেন বলে মনে হোত।।(ক্রমশঃ)
*MESSAGE TO HUMANITY*
~ _Swami Baulananda_
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মানবীয় সত্তার মধ্যে ছেলেমানুষী স্বভাব খুব বেশী প্রকট হয়। যে কোনো পরিবারের দিকে নজর দিলে দেখা যায়__ছোটবয়েসী ভাই, বোন এবং অন্যান্য আত্মীয় যদিও একই বাড়ীতে বাস করে এবং সকলের বন্দোবস্ত এক, তথাপি খাওয়ার সময় একে অপরের নামে নালিশ করে “ও আমার জায়গায় বসেছে ও আমাকে ভেঙাচ্ছে।” এই ধরনের আচরণ হতে ঝগড়া, গালিগালাজ এবং শেষে কান্নায় পৌঁছায়। ঠিক এইভাবেই যখন তারা শুতে যায়, তখন একে অপরের বিছানায় গড়াগড়ি দেয়, নিজেদের মধ্যে লাথি মারামারি করে, একজন বেশী জায়গা নিয়েছে বলে, অপরজন বলে “আমিই প্রথম দেওয়ালের দিকে বিছানা নিয়েছি ‘ — ইত্যাদি, ইত্যাদি ! এরকম চলতে থাকে যতক্ষণ না দু-একজন কান্নাকাটি শুরু করে ! কখনো কখনো আবার এই ঝগড়া মারামারি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সকলেই কাঁদতে শুরু করে।
এখানেই ঐ পরিবারের বড়দের সতর্কতার প্রয়োজন হয়। তাঁরা প্রায়শঃই ছোটদের মিষ্টি কথায় শান্ত করেন। আবার কখনো কখনো সামান্য কড়া কথা বলে বা শাশ্তির ভয় দেখিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে শান্ত করেন। যদিও বিষয়টি সম্বন্ধে ছোট বয়সী ছেলে-মেয়েরা খুব বেশী চিন্তা করে না। তথাপি সহজাত স্বভাবটা এতো প্রবল যে ঝগড়াটা অনেক বড় বয়স পর্যন্ত চলতে থাকে।
এই স্বভাবের কথা ভেবে বড়রা দায়িত্বশীল হয়ে__ যে সমস্ত ছেলেমেয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে না, তাদের জন্য আলাদা আলাদা বিছানা করে দেন।
কিন্তু ঝগড়া করার অভ্যাস যাবে কোথায়? সেই অভ্যাসের বলে_ ছেলেমেয়েরা এক বিছানা থেকে অন্য বিছানায় চলাফেরা করে, একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ে এবং একই পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
নতুন এই অবস্থা সৃষ্টি হ‌ওয়ায়, তখন হয়তো বাড়ির বড়রা বিছানার মধ্যে গণ্ডি করে দেন যাতে কলহের পুনরাবৃত্তি না ঘটে ৷ ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ শরীরের দিক থেকে অধিকতর বলশালী হয় এবং সে ঐ পূর্বোক্ত স্বভাবের বশে _যে কোন উপায়ে গণ্ডি ভেঙ্গে অপরের বিছানায় যাবার চেষ্টা করে।
বাড়ীতে বড়দের কাছে এসব গুলি বড় অশান্তির ব্যাপার! শেষে তারা পরিবেশ অনুযায়ী এক বা একাধিক ছেলে-মেয়েদেরকে বাইরে কোথাও(হোস্টেল) থাকার ব্যবস্থা করেন। এই অভ্যাস স্বাভাবিক হয়ে গেলে অন্য স্থানেও (হোস্টেল বা বোর্ডিং)যেখানে একাধিক ছেলেমেয়ে প্রতিপালিত হচ্ছে) একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যে ছেলেমেয়েরা বাড়ির মধ্যে,ছোট স্থানে বসবাস করছিল এখন তারা একটা বড়-বাড়ীর members। সেখানে গিয়ে তারাও আপস মীমাংসার জন্য একই পদ্ধতি অবলম্বন করে।
বিশ্ব-রূপ এই বিশাল বাড়ীতেও, ছেলেমেয়ে-রূপ মানুষদের এক জায়গায় থাকার ফলে নানান অশান্তি হয় এবং এর ফলেই তারা একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তাদের সকলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বসবাসের জন্য কালান্তরে বংশপরম্পরায় এই পদ্ধতি আরো প্রসারিত হয়। এই ভাবে বিশ্বে মানব-সমুদ্রের ন্যায় বৃহৎ মানবত্বের বিস্তৃতি ঘটেছিল ৷
বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুর পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের ফলে মানুষের শরীরের আকার-প্রকার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুপাতে শরীরের গঠনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের এবং গড়নের মানুষের সংঘবদ্ধ দলের সৃষ্টি হয়েছে ৷
যখন নূতন নূতন বাসস্থান গড়ার পদ্ধতি চলতে থাকল, তখন এমন একটা পরিস্থিতি এলো যে__মানব সৃষ্টির প্রথম পরিস্থিতিতে কোথায় সেই বিশেষ দলটি বাস কোরতো — এটা নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে উঠল। যেখানে যেখানে দলগুলি শক্তিশালী বা সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠছিল, সেই সমস্ত স্থানের নামকরণ করার প্রয়োজন দেখা দিল। এই ভাবে জগতে বিভিন্ন স্থানের নামকরণ হোল।
এই জগতে অাদিকালে শুধুমাত্র আদিপিতা এবং আদিমাতা বাস করতেন। পরবর্তীতে বহু সময়ের ব্যবধানে আজকের এই সমাজ-ব্যবস্থা রূপ পেয়েছে।
নিজ নিজ এলাকায় বিশেষ স্থানে দলবদ্ধ হয়ে জমায়েত হওয়া বয়ােজ্যেষ্ঠদের স্বভাব! এইরকম সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।যেমন_ বাসস্থান সম্বন্ধে, পরিবেশ, পিতামহ এবং প্রপিতামহের আমলের অবস্থা, যুবা অবস্থায় বাপ-ঠাকুরদার মুখে কে কি শুনেছে–এইসব প্রায়ই আলােচিত হয়। ছেলে ছােকরাদের কাছে এর চেয়েও বেশী অদ্ভুত এবং চিত্তাকর্ষক আলোচনা ছিল __যখন বয়স্করা বোলতো, _’তাদের এলাকায় বা গ্রামে বর্তমানে প্রায় একশো ঘর বাসিন্দা আছে, যখন তারা ছােট ছিল _তখন তাদের গ্রামে মাত্র কুড়ি ঘর লােক ছিল। তাদের ঠাকুরদা বলতেন __তারা যখন ছােট ছিলেন তখন তাদের গ্রামে মাত্র দু (২) ঘর বাসিন্দা ছিল–একঘর তাদের এবং অার এক ঘর অন্যজনদের। কেবলমাত্র তাই নয়, তারা তাদের ঠাকুরদাদের নিকট এও শুনেছে যে — তারা অন্য জায়গার বাসিন্দা; বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে এ গ্রামে এসেছে – আবছা আবছা মনে পড়ে’।
প্রত্যেক গ্রাম, তালুক, জেলা, প্রদেশ বা দেশ এবং মহাদেশের এই হোল অবস্থা। এইভাবে বর্তমান যুগে বিশ্বে যে সমগ্র মানব এবং অমানব রয়েছে, অসংখ্য ঘরবাড়ী রয়েছে_ সেই বিশ্বই ছিল আদি পিতা মাতার একক ঘর। খেয়ালখুশিমত বিভিন্ন নাম এবং কৃত্রিম আকার থাকলেও এই হল আদি পিতা-মাতার একক ঘর। নিজ সত্তাদের সঙ্গে মিলে সতেজ এবং উচ্ছৃঙ্খলভাবে এই বিশ্বকে ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড করে দেবার চেষ্টা মানবের থাকলেও এই বিশ্ব আদি পিতামাতার একক ঘর হয়েই থাকবে।
সংঘবদ্ধ হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে বাস করার যােগ্যতা অমানবীয় জীবের চেয়ে মানবদের মধ্যে কম। অমানবীয় জীবের মধ্যে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র চেতনাসম্পন্ন জীবের চেয়ে ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ চেতনাযুক্ত জীবের যােগ্যতা কম। বস্তুর মধ্যে যারা অচলনশীল (যেমন গাছ গাছড়া) যোগ্য তার দিক দিয়ে অন্য সমস্ত বস্তু অপেক্ষা অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। … [ক্রমশঃ]