স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। [আমরা আগের দিন দেখেছিলাম যে, স্বামীজী গোদাবরীতে স্নান করতে গিয়ে একপাল গরুর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন এবং সেই জায়গাটি গরুর খুড়ের ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় তাঁরা খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন।]
শত শত গরুর ঘনঘোর চরণ ধুলার মধ্যে স্বামীজী চোখ বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু জায়গাটি ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে একেবারে ভীষণ অন্ধকার হয়ে গেছিল । স্বামীজি চোখ খুলে দেখলেন যে, তিনি রাম শাস্ত্রীর উপর হেলান দিয়ে রয়েছেন। রাম শাস্ত্রী তাঁকে দু হাত দিয়ে ধরে আছে এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছে। নদী হতে ঠান্ডা হাওয়া আসছিল _তা সত্ত্বেও দেখা গেল স্বামীজি খুব ঘামছেন । তাঁর সমস্ত অঙ্গ ঘর্মাক্ত । শরীরের সংযোগস্থল গুলি শিথিল হয়ে গেছিল, ফলে তিনি হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়লেন । রাম শাস্ত্রী তাঁকে মাটি থেকে তুলে ধরলেন । রাম শাস্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে স্বামীজি মন্দিরে এসে পৌঁছালেন। মন্দিরে আসার পর শাস্ত্রীজী স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করলেন _’ইতিপূর্বে তাঁর এরকম হয়েছিল কিনা’? স্বামিজী এই কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন _’তাঁর কি হয়েছিল’? শাস্ত্রীজী বাহ্যিকভাবে যা দেখেছিলেন, তাই শুধু বলতে পারলেন _তার বেশি কিছু বলতে পারেননি।
প্রকৃতপক্ষে, ওই সন্ধ্যায় সেদিন স্বামীজীর চরম ‘ভাব’ হয়েছিল! ধুলোর ঘন অন্ধকারে তিনি দেখলেন গোপালক কৃষ্ণ আনন্দে নাচছেন! তাঁর ইষ্ট মূর্তি দেখে তিনি গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি ইষ্টের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন । রাম শাস্ত্রী বাহ্যিক কি ঘটেছে তাই দেখেছিলেন কিন্তু সেই বিশেষ অবস্থায় যেহেতু তিনি স্বামীজীর শরীরের ছোঁয়া পাচ্ছিলেন __এই ছোঁয়াতেই তার মনে উল্লাস ভাব এসেছিল এবং তিনি সেই সময় অকারণে অঝোরে কাঁদছিলেন! কিন্তু তিনি যে কাঁদছেন তাও তিনি নিজেই বুঝতে পারছিলেন না! মা জগদম্বার এ এক অদ্ভুত লীলা!
ভাগবতকে(ভগবানের সাধনা করেন যিনি) সেবা করা ভগবানকে সেবা করার ন্যায় মঙ্গলদায়ক ! যে প্রকৃতপক্ষে ভক্তিভাবে সেবা করে, অন্য কোন প্রচেষ্টা বিনাই তার আধ্যাত্মিক অগ্রগতি হয় এবং সে শুভ ফল পায়! রাম শাস্ত্রী সেদিন তাই পেয়েছিলেন!
উপরিউক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর এল শিবরাত্রির উৎসব। মহা শিবরাত্রির উৎসবকে সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দুগণ একটা বড় উৎসব বলে গণ্য করে এবং প্রায় সব অঞ্চলেই এই উৎসব পালন করা হয়। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত রয়েছে যে ত্রিদেব এর মধ্যে অন্যতম হলেন পরমেশ্বর শিব। পৌরাণিক গল্পে রয়েছে_শিবপত্নী উমা স্বামীর ইচ্ছা লংঘন করেছিলেন এবং কৃত অপরাধের জন্য অনুশোচনায় তিনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তিনি পুনরায় গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা রূপে জন্ম গ্রহণ করলেন_ পর্বতের কন্যা তাই তাঁর নাম হয়েছিলো পার্বতী। এরপর স্বামী শিবের দর্শন লাভের জন্য তিনি তপস্যায় মগ্ন হলেন।
শিবরাত্রির দিন পার্বতী কে বিবাহ করার জন্য শিব অবতরণ করেছিলেন । এই মহাদিনটি হোল_ ‘পার্বতী কল্যাণের দিন’ ! ‘প্রকৃতি’-র সঙ্গে মিলিত হওয়া এবং তাকে ক্রিয়াশীল করার জন্য ‘পুরুষ’-এর যে অবতরন _তারই প্রতীকস্বরূপ । ‘পুরুষ -প্রকৃতি’র মিলনেই এই বিশ্বের প্রকাশ হয়েছে।
সব শিব মন্দিরেই ভক্তগণ ‘পার্বতী কল্যান’ অনুষ্ঠান করেন। তাঁরা মন্দিরে পুজো দেন এবং সারা রাত্রি জেগে কাটান! তাঁরা ভাবেন_ সাধনার পরিপূর্ণতার জন্য এটা একান্ত প্রয়োজন! তাঁরা রাত্রে ঘুমান না ! অনেকে খোল-করতাল নিয়ে ভজন গেয়ে এবং ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করতে করতে সারা রাত্রি কাটিয়ে দেন।
ভদ্রাচলমের শিবমন্দিরে ‘পার্বতী কল্যান’ উৎসব পালিত হোল । রাম শাস্ত্রী নিজেই পৌরোহিত্য করলেন। উৎসব সম্পন্ন হওয়ার পর যাত্রীরা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে গেল। মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হোল । সমগ্র স্থানটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো । স্বামীজিও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সকলে প্রস্থান করার পর তিনি মন্দিরের এক কোণে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন।
ধ্যানমগ্ন স্বামীজীর সামনে রাম শাস্ত্রীও উপবেশন করলেন। যেহেতু তিনি স্বামীজীর ঘনিষ্ঠ অনুগামী_ তাই তিনি এই কাজ করতে সাহস পেয়েছিলেন! সময় অতিক্রান্ত হতে লাগলো, কোনো রকমের কোনো শব্দ নেই_ কোনো গোলমাল নেই! এইভাবে রাত কেটে গেল। এদিকে সারা রাত কেটে গেছে_ রাম শাস্ত্রী বাড়ি ফেরেন নাই দেখে_ তার মা পরের দিন প্রাতে সূর্যোদয়ের পরেই মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এসে দেখলেন যে, স্বামীজি এবং রাম শাস্ত্রী মুখোমুখি ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন ! তাঁদের শরীর শক্ত! ওই অবস্থায় তাঁদেরকে বসে থাকতে দেখে _শাস্ত্রীজীর মা খুবই আনন্দিত হলেন এবং ভক্তিভাবে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন।(ক্রমশঃ)
*MESSAGE TO HUMANITY*
~ _Swami Baulananda_
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মহাপ্রলয়ের পূর্বে এবং পরে সর্বেসর্বা বা ঈশ্বরের যেমন সাতটি শাশ্বত লক্ষনই বর্তমান ছিল,মহাপ্রলয়েও ঈশ্বরের এই সাতটি লক্ষণ বর্তমান ছিল। এই সাতটি লক্ষণ হোল যথাক্রমে_ কাল, মহাকাল, মহা চৈতন্য, চৈতন্য, প্রেম, জ্ঞান এবং শক্তি। প্রলয়ের পর বন্যা কমে যাওয়ার সাথে সাথে এবং চৈতন্য কাজ শুরু করার আগে _সাতটি লক্ষণ ছাড়াও বিশ্বসত্তা এবং পঞ্চভূত বর্তমান ছিল, যদিও তারা তখন নিষ্ক্রিয় ছিল। চৈতন্য কাজ করার সাথে সাথে অহং-এর মাধ্যমে বিশ্ব সত্তা কর্তৃক স্বতন্ত্রীকরন আরম্ভ হোল । শাশ্বত প্রকাশের নিয়ম, ভৌতিক পদার্থ এবং পঞ্চভূতের উপর ভিত্তি করে এই স্বতন্ত্রীকরন আরম্ভ হোল।
বিশ্ব সূত্রের জাগরণ-ই হোল বিশ্বসত্তা রূপে সর্বেসর্বা বা ঈশ্বরের প্রকাশ । এটা হোল জড়-অবস্থা থেকে বিশ্ব-অহং-এর স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ এবং বিশ্বমনের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া! ফলে সৃষ্টি হলো বিশ্বসত্তা।বিশ্বচৈতন্য কাজ করার শুরু থেকে বিশ্ব-শরীরের ন্যায় বিশ্ব সত্তার প্রকাশ শুরু হয় ।
যখন বিশ্বসত্তারূপে ঈশ্বরের প্রকাশ শেষ হোল, তখন বিশ্বে ঐশ্বরিক সুক্ষ্ণ অবস্থার প্রকাশেরও সমাপ্তি ঘটলো। যখন বিশ্ব শরীরের ন্যায় বিশ্ব সত্তার প্রকাশের সমাপ্তি ঘটল তখন বিশ্বে সুক্ষ্ণ ঐশ্বরিক অবস্থায় _স্থুল অবস্থার প্রকাশের‌ও সমাপ্তি ঘটল।
যা কিছু প্রকাশিত হোল __এসবের মধ্যেই ‘অহং’ রইল । বিশ্বমন রূপে সর্বেসর্বা বা ঈশ্বরের প্রকাশ ছাড়া যে কোন সূত্রে,অহং-এর মাধ্যম ব্যতীত কোন প্রকাশ বা অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। বিশ্বমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্ব অহং-এর সাথে একীভূত হতে হতে বিশ্বসত্তা হয়ে গেল।অহং(Ego) থাকায় যা প্রকাশিত হোল _সেসবের মধ্যেই সীমা থাকলো এবং তা(সীমা) বিশ্বসত্তার‌ও রইল। ঈশ্বর কর্তৃক এর প্রকাশের রীতিতে এবং এর সত্তায় পরিণত হওয়ার রীতিতে _বিশ্বমনে অহং সৃষ্টি হোল ।এই কারণে সর্বেসর্বা হতে বিশ্বমনের দ্বারা এর সৃষ্টি নয় ।এর সৃষ্টি হল সত্তায় আসার যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী । সুতরাং বিশ্বসত্তা প্রকাশিত হবার পূর্বে সর্বেসর্বা অহং শুন্য ছিলেন এবং বিশ্বসত্তা প্রকাশিত হবার পরে তিনি অহং শুন্য‌ই রইলেন। ঈশ্বরের চিরন্তন প্রকাশ ছাড়া বিশ্বে কিছুই অহং শুন্য‌ নয়। বিশ্বে এমন কিছুই নাই যা চিরন্তন প্রকাশের মধ্যে নয় কারণ বিশ্ব সূত্র অনুযায়ী জগতের কোনো অস্তিত্বপূর্ণ প্রকাশ‌ই বর্তমানে অনস্তিত্বপূর্ণ নয়।প্রলয়সহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার অস্তিত্ব বর্তমান থাকবে। জগতের এই অবস্থায় বিশ্ব অহংও প্রলয়কালে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অবস্থান করবে । ঈশ্বরের সঙ্গে বিশ্বমনের একীভূত হওয়ার সময় বিশ্ব অহং _বিশ্বমন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল । ঠিক সেই রূপে মনের অপ্রকাশের যথাযথ রীতিতেই মন থেকে মনের অহং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। এইভাবে বিশ্বমন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই অহং জড় হোল এমনকি মহাপ্রলয়েও এটি এই অবস্থায় বিশ্বে অবস্থান করতে থাকলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না বন্যা কমতে শুরু করল এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্বচৈতন্যের জাগরণ হলো _ততক্ষণ এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করতে লাগলো।
মহাপ্রলয়ের সময় জড় অবস্থায় বিশ্বঅহং-এর এই অস্তিত্ব ঈশ্বরের প্রকাশ লক্ষণের (যেমন কাল, মহাকাল, মহাচৈতন্য,চৈতন্য, প্রেম, জ্ঞান এবং শক্তি) অনুরূপ নয়। এই শাশ্বত লক্ষণগুলি কেবলমাত্র মহাপ্রলয়েই অবস্থান করতে থাকলো_ তা নয়, প্রলয়ের পূর্বে তারা যেমন কাজ করছিল ওই সময়ও ঠিক সেইরূপ কাজ করতে লাগলো। ওই সময়ের পূর্বে যেমন করছিল ওই সময়েও মহাকাশের তেমনি কাজ হোল _ সমস্ত বস্তুসহ দ্রবীভূত জগতকে ধারণ করা ! কাল পূর্বে যেমন করছিল ওই সময়েও তেমনি মহাপ্রলয়ের সময়কে পরিমাপ করছিল। অন্যান্য শ্বাশ্বত প্রকাশ বা লক্ষণগুলিও অনুরূপ ভাবে ঠিক পূর্বে যেমন করছিল ওই সময়েও তদ্রূপ কোরলো। সুতরাং সর্বান্তর্যামী সর্বাবস্থায় অহং বিনা বিরাজ করলেন। … [ক্রমশঃ]