স্বামী বাউলানন্দজী পেরেন্টাপল্লীতে যখন প্রথমে স্থানীয় উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতে শুরু করলেন_তখন থেকেই ওনার বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বভাব-বিপ্লবী স্বামীজী এসবের তোয়াক্কা না করে নিজের সংকল্পে অবিচল থাকলেন।
বাধা যত বেশি হতে লাগলো_তাঁর কর্মের গতি তত‌ই বাড়তে লাগলো। তিনি উপজাতিদের সমস্যাগুলি নিয়ে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, এমনকি ওখানকার রাজ্যপাল এবং মন্ত্রীদের কাছেও সব কথা জানিয়েছিলেন! উনি সবসময় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বানীগুলি_তাঁর কর্মযোগের সপক্ষে উদাহরণ হিসাবে পেশ করতেন।
এইসময়েই উনি Messege To Humanity-ব‌ইটি লেখেন এবং ওই ব‌ইয়ের লিখিত কথাগুলি তিনি তাঁর পরিচিতি জনেদের কাছে প্রচার করতেন_যাতে করে তারা আবার সেগুলিকে আরো নানা জায়গায় প্রচার করতে পারে।
সেই সময় ঐ অঞ্চলে আরো একটা নতুন এবং মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ঐ স্থানটি যেহেতু হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীনে ছিল_তাই নিজাম চাইলেন ওখানকার মানুষদেরকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে তার স্বমতে নিয়ে আসতে! নিজামের নিয়োজিত লোক কাসিম রাজভির নেতৃত্বে শুরু হোল ধর্মান্তকরণের নামে উপজাতিদের উপর অত্যাচার! উপজাতিদের সমস্ত ছোট ছোট দলের শতশত লোকেরা তীর-ধনুক নিয়ে স্বামীজীর কাছে চলে এলো এবং তাঁকে সবার নেতা মেনে নিয়ে কাসভির দলের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ালো!(ক্রমশঃ)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ _Spiritaul Enquiry_ ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :– আমরা এই আলােচনায় জেনেছি যে, একাধিকবার জন্ম নেওয়ার বাসনা রােধ করত হলে কাণ্ডজ্ঞান দরকার ও উন্নত মানুষের সাথে সংযােগ ও শক্তির আদানপ্রদান প্রয়ােজন। শুধু মানুষের ধারণা পাল্টে দিলেই কি প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখা যাবে ?
মীমাংসা :— যারা একাধিকবার শরীর নিয়েও এখনও বাসনামুক্ত নন, তাদের ধারণা যদি স্পষ্ট হয় এবং তারা যদি কাণ্ডজ্ঞান সচেতন হন তবে শরীর ও মনে শক্তির অপচয় না ঘটিয়ে তাদের সংযত করতে পারবেন। সেই শক্তি তখন তাদের উর্ধ্বচেতনাকে উদ্দীপ্ত করবে। পরিমাণগত মানের থেকে জীবনযাত্রার গুণগত মানের দিকে ঝোঁকটা বাড়বে। পৃথিবীতে তাদের ভূমিকায় তখন থাকবে স্বার্থত্যাগ । তখন নবীনদের তারা অনুপ্রাণিত করতে পারবেন এই আদর্শে। সমস্যাটা নিয়ে জগতে যে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, সেটার মীমাংসা একমাত্র এইভাবেই সম্ভব।
জিজ্ঞাসা :—কিছু মানুষের ধারণা পাল্টে গেলেই কি রাজনৈতিক বিভ্রান্তি কেটে যাবে ?
মীমাংসা :—কেন যাবে না। প্রতিটি মানুষ যাতে তার জীবনের ন্যূনতম প্রয়ােজনগুলি মেটাতে পারে এবং সেটা করতে গিয়ে যাতে অতি-সঞ্চয়ের বৃত্তি না তৈরী হয়, এটা সুনিশ্চিত করাই তো রাজনৈতিক দায়িত্ব। বিভ্রান্তি আসছে কেন ? মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দাবি এখনও ভাল করে মেটানো যাচ্ছে না, ভবিষ্যতে তো আরও অসম্ভব হবে ! এই আশঙ্কাতেই রাজনীতিবিদরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু তাদের মূল ধারণায় অনেক ত্রুটি আছে বলে জনসংখ্যার সমস্যা ওরা কৃত্রিমভাবে মেটানাের চেষ্টা করছেন। আর তাতে শুধু জটিলতাই বাড়ছে, সুরাহা হচ্ছে না।
জীবন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকলে অভিজ্ঞরা ত্যাগমুখী হবেন ও নবীনরা প্রাথমিক পর্বে কিছুটা ভােগমুখী জীবনযাপন করলেও, তাদের যােগাযােগ থাকবে স্বার্থমুক্ত অভিজ্ঞদের সাথে। এই সংযােগ ও সান্নিধ্যে সেই ভােগস্পৃহা কমে যাবে এবং অধিকাংশ মানুষেরই নতুন করে জন্ম নেওয়ার বাসনা থাকবে না। সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ে যে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, সেটা তখন অনেকটাই কেটে যাবে।
জিজ্ঞাসা :– আপনার মীমাংসাটা আমরা বুঝেছি। এবার জানতে চাই, এখন থেকেই যদি আপনার নির্দেশিত পথে এগােনো যায়, তবে অভিজ্ঞদের নিঃস্বার্থপরায়ণ হতে কতদিন সময় লাগতে পারে ?
মীমাংসা :– সেক্ষেত্রে মানুষের সংস্কার, সামর্থ্য ও বয়সের বিচারটা করতে হবে। আজ যাদের বয়স কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে, তারা সঠিক ধারণা পেলে, পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যেই বাসনমুক্ত হতে পারে। যাদের বয়স তিরিশ বছর থেকে চল্লিশ বছরের মধ্যে তারাও পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর বয়সের মধ্যেই মুক্ত হতে পারে। যাদের বয়স পাঁচ থেকে কুড়ির মধ্যে, তারা তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যেই নিঃস্বার্থপরায়ণ হয়ে উঠবে। এই ভাবে বর্তমান প্রজন্মের কেউ যদি তিরিশ বছর বয়সের মধ্যেই বাসনমুক্ত হয়, তবে তার পরবর্তী প্রজন্মের কোন শিশু কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যেই বাসনামুক্ত হয়ে যাবে। কোন কোন অভিজ্ঞ এমন নিশ্চয়ই থাকবেন, যার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাসনমুক্ত হতে পারেননি। ঐ ‘ইচ্ছাটা` নিয়েই তাদের বর্তমান শরীরের মৃত্যু হবে। সূক্ষ্ম শরীরেও এই ইচ্ছাটা তীব্রভাবে থেকে যাবে এবং এর ফলস্বরূপ, পরের শরীরে তিনি অবশ্যই মুক্তি পাবেন। ঠিক মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে অনেকের বাসনা-মুক্তি হতে পারে। কিন্তু জীবন্মুক্ত অবস্থায় জীবনযাপন করার সাধ অপূর্ণ থেকে যায় । সেই অতৃপ্তিটুকু থাকলে শেষ একবার তাকে শরীর নিতে হবে কিন্তু সেই জন্মে পুরাে সময়টাই সে পরার্থে নিবেদন করবে।
জিজ্ঞাসা :—যারা নবীন অর্থাৎ প্রথমবার শরীর নিয়েছে, তাদের বাসনামুক্ত হতে কতদিন লাগবে ?
মীমাংসা :—সময়টা সামগ্রিকভাবে প্রায় একই লাগবে। কারণ অভিজ্ঞ ও নবীন উভয়ই একে অপরের সাথে যুক্ত ও নির্ভরশীল।
জিজ্ঞাসা :–সাধারণভাবে বিচার করলে বর্তমান মানুষের আর ক’টা জন্ম লাগবে বাসনামুক্ত হতে ?
মীমাংসা :—কেউ কেউ এই জন্মেই মুক্ত হবে, কেউ পরের জন্মে। বাকীদের, খুব বেশী হলে আর একটা জন্ম লাগবে। তিন জন্মের মধ্যে বর্তমানে জীবিত সমস্ত মানুষ মুক্তি পেতে পারে ।
জিজ্ঞাসা :–আনুমানিক কত বছর লাগতে পারে এটা হতে ?
মীমাংসা :–প্রায় এক হাজার বছর।
জিজ্ঞাসা :–এক হাজার বছর মানে বড় দীর্ঘ সময় নয় কি ? জগৎ কি অতােদিন ধরে এই সংকট সহ্য করে যেতে পারবে?
মীমাংসা :–এটা মােটেও খুব একটা বেশী সময় নয়। আধ্যাত্মিক আদর্শে এই প্রচেষ্টা শুরু করলে, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে এর শুভ প্রভাব দেখা যাবে। দারিদ্র্য, দুঃখ কষ্ট, অভাব এগুলাে কমে যাবে। এটাই একমাত্র উপায়, শুধু অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, শান্তিপূর্ণ ভাবে অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও।
জিজ্ঞাসা :–এইভাবে এগুলে কি এক হাজার বছর পরেও পৃথিবীতে মানুষ থাকবে ?
মীমাংসা :—অবশ্যই থাকবে।
জিজ্ঞাসা :—সবাই যদি স্বার্থত্যাগী হয়ে বাসনামুক্ত অবস্থায় উত্তীর্ণ হয় তাহলে কি করে পৃথিবীতে মানুষ থাকবে ?
মীমাংসা :—কেন নয়? বনস্পতিরা পশু-শরীর পাচ্ছে, আর পশুরা মানবশরীর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, এই ধারা তাে প্রাকৃতিকভাবেই ক্রমবর্ধমান । যারা মানবশরীর নিয়ে আছে, তাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিলে তো আর মনুষ্যেতর ধারা ব্যাহত হয় না, বরং সেই গতি আরাে অনুকূল হয়ে উঠবে। প্রাকৃতিকভাবে বনস্পতিশরীর থেকে মানবশরীরের যাত্রা উর্ধ্বমুখী। মানুষের চেতনাও যখন উর্ধ্বমুখী হবে তখন সৃষ্টির ধারায় প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা আসবে, যা এখন নেই।
জিজ্ঞাসা :—আপনার নির্দেশিত পথে যদি সমাধানের রাস্তা খোঁজা হয়, তবে আগামী পৃথিবীর সম্ভাব্য চরিত্র কেমন হবে বলে আপনার ধারণা ?
মীমাংসা :—উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন হবে। বর্তমানের অস্থিরতা ও সংকট কেটে গিয়ে পৃথিবীতে শান্তি আসবে। প্রেম, জ্ঞান ও শক্তির ভারসাম্য থাকবে মানবসমাজে। ইন্দ্রিয়জ বৃত্তি কমে গিয়ে সূক্ষ্মবৃত্তির বিকাশ হবে, কারণ শক্তি রূপান্তরিত হবে স্থূল থেকে সূক্ষ্মে । বর্তমান জগতে জ্ঞান ও শক্তির কর্তৃত্ব, প্রেম গৌণ হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রেমই হবে মূল, যাকে আধার করে জাগবে জ্ঞান ও শক্তি। আহার, বস্ত্র ও বাসস্থানের মৌলিক প্রয়ােজনগুলি থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। প্রেমই হবে সর্বব্যাপক ও নির্ধারক শক্তি। স্বাভাবিক ভাবেই দেবত্বের বিকাশ ও অসুরত্বের বিনাশ হবে। সার্বিকভাবে প্রাণীজগৎ এবং মহাপ্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য সুস্থ ও সুন্দর হবে। সৃষ্ট সমস্ত বস্তু তখন জগতে তাদের স্বকীয় অবদান রাখতে পারবে যাতে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সার্থক হয়। মানবজাতির দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও অভ্যাসের মধ্যে মনুষ্যত্বের শুভ গুণগুলি প্রকট হবে যাতে পরিণামে সবাই শান্তি ও আনন্দের সাথে লয় হতে পারে বােধের ভূমিতে । … [ক্রমশঃ]