স্বামী বাউলানন্দজীর জীবনী আঃ বেঙ্কট রাও যেমনটা লিখেছিলেন_সেখান থেকেই এখানে কিছু কিছু তুলে ধরা হচ্ছিল। স্বামীজীর লেখা “Spiritual Enquiry”_বা “আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা”-ব‌ইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়_তার সূচনায় লেখা হয়েছিল__’ স্বামী বাউলানন্দজীর শিষ্যরা তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণের অবতার হিসাবে জানতো। তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে নিজের বড় ভ্রাতা হিসাবে পরিচয় দিতেন। মহাসাধক রামতীর্থ ছিল যেন তাঁর অভিন্ন আত্মা। তিনি নিজেকে শ্রীচৈতন্যদেবের ছায়া হিসাবে মনে করতেন।’ ১৯৭৬_সালের ১৭-ই জানুয়ারী তিনি নশ্বর শরীর চেয়েছিলেন।।(ক্রমশঃ)
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :– বহু মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, জীবনের পূর্ণতাসাধনের লক্ষ্যে পৌঁছনাের দুটো উপায় -১) সন্ন্যাসের পথ ও ২) গৃহস্থের পথ। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে গৃহীকে বাস করতে হয় এবং তাদের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এই কর্তব্য করতে গেলে তাকে কিছুটা স্বার্থপর হতেই হবে, প্রয়ােজনের দাবিতে এই স্বার্থপরতাটুকু তার পক্ষে স্বাভাবিক। অপরদিকে একজন সন্ন্যাসী গৃহ, পরিবার ও বিবাহিত জীবন ত্যাগ করে আসেন বলেই তার পক্ষে স্বার্থপরতা অশােভন। নিজেদের জন্য চিন্তা তারা করেন না বলেই, সন্ন্যাসীদেরও ভরণপােষণের দায়িত্ব গৃহীদের নেওয়া কর্তব্য। এছাড়াও আরেক ধরণের মানুষ আছেন, যারা দরিদ্র বা অসুস্থ বা অন্ধ কিংবা প্রতিবন্ধী অর্থাৎ যাদের উপার্জন বা নিজের ভরণপােষণের ব্যবস্থা নেই, তাদেরও দায়িত্ব নিতে হয় গৃহীদের। এছাড়াও কূপ খনন করা, পুকুর বাঁধিয়ে দেওয়া, রাস্তা তৈরী করা, হাসপাতাল নির্মাণ—এ সমস্ত কাজেও গৃহীদেরই এগিয়ে আসতে হয়। তাই দেখা যাচ্ছে গৃহী ও সন্ন্যাসীর পথ আলাদা। কিন্তু এই আলােচনায়, এখনও পর্যন্ত এই উপায়ের ভিন্নতা নিয়ে কিছু বলা হয়নি কেন ?
মীমাংসা :— এই আলােচনা আধ্যাত্মিক । ঈশ্বর এক, তিনিই একমাত্র অস্তিত্ব, শাশ্বত আত্মা, সর্বজ্ঞ। আধ্যাত্মিক পথ একটাই, তা হল মনুষ্যত্বের ও নিঃস্বার্থপরতার। আমাদের আলােচনায় এই কথাটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে প্রতিবার। তুমি যে বিভিন্ন উপায় ও পথের কথা বলছ, সেগুলাে আচারিক ও ব্যবহারিক ধর্মের অনুশাসন, আধ্যাত্মিক নয়। তবু এই প্রসঙ্গটা যেহেতু উত্থাপিত হল, তাই এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা প্রয়ােজন।
ধরে নাও, তুমি একজন গৃহস্বামী। তােমার সাথে কয়েকজন ব্যক্তির আলাপ হল । তাদের খাদ্যের দরকার । খাদ্য সংগ্রহ করার উপায় তাদের নেই, জায়গাটিতে তারা নতুন। তােমার মনে হল যে, তােমার কিছু করা উচিত। যেহেতু তােমার সামর্থ্য ও উপায় আছে। তাই তুমি তাদের বাড়ি নিয়ে এলে এবং তােমার স্ত্রীকে বললে অতিথিদের খাবার দিতে। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আর কিছু নেই। তােমার স্ত্রী রান্না করতে রাজী হলেন না, বললেন, যাদের এনেছে তাদের চলে যেতে বল’। এতে তুমি মর্মাহত হলে, অতিথিরাও সমস্যাটা আঁচ করতে পেরে নীরবে চলে গেল। এরকম ধরণের ঘটনা তােমার বাড়িতে নিয়মিত ঘটে। স্ত্রীর প্রতি তােমার বিরক্তি ও বিরূপতা বাড়তেই থাকে। এই পরিস্থিতিতে তুমি কি করবে ? স্ত্রীকে ত্যাগ করে হয়ত পুনরায় বিবাহ করবে। কিন্তু দ্বিতীয় জনও যদি একই রকম হন, তখন কি করবে? অথচ অপরের কষ্ট দেখে তুমি বােবা সাক্ষী হয়ে থাকতে পারছ না, তােমার ইচ্ছা তাদের সেবা করার, তােমার সামর্থ্য ও আছে। কিন্তু তােমার স্ত্রী বাধ সাধছেন। এই অবস্থায় তােমার মধ্যে অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এখন তােমার সামনে দুটো পথ খােলা। হয় স্ত্রীর মতে চলতে হবে সবকিছু মেনে নিয়ে, না হয় সংসার ত্যাগ করে অন্য জীবন শুরু করতে হবে। প্রথমটি হলে তােমার বর্ণিত সৎগৃহস্থীর সাথে তােমার তুলনাই চলবে না এবং পরেরটি হলে তুমি তাে গৃহীই নয়। অতএব ইচ্ছে থাকলেও গৃহী জীবনে তুমি থাকতে পারলে না । কেন ? তােমার স্ত্রীর স্বার্থপরতা তােমাকে বাধ্য করেছে নিজের স্বভাবের প্রবণতা থেকে সরে যেতে। তােমার আচরণ কিন্তু স্বাভাবিক, অর্থাৎ স্বার্থের কলুষ থেকে মুক্ত।
আর একটা উদাহরণ দেখ । ধর তুমি এক সচ্ছল ব্যক্তি এবং একটা বিরাট পরিবারের দায়িত্ব তােমার কাঁধে। তােমার বাড়িতে বেশ কিছু দাস-দাসী আছে এবং সেই দাস-দাসীদের সন্তানরাও তােমার গৃহেই বাস করে। তােমার সন্তানদের সাথে তারাও খেলাধুলা করে। তােমার সন্তানেরা পরিষ্কার নতুন জামাকাপড় পরে, কিন্তু তােমার দাস-দাসীদের সন্তানদের গায়ে ছেঁড়া জামা। তুমি তাদের জন্য ভাল জামাকাপড় কিনতে চাও, কিন্তু পরিবারের বাকী সদস্যদের তাতে আপত্তি। একসাথে খেলাধুলাে করার পর তােমার ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে এসে পেট ভরে পুষ্টিকর খাবার খায়, অন্যরা সাধারণ খাবার আধপেটা পায়। এক্ষেত্রেও পারিবারিক কারণে তুমি নিরুপায়। একই স্কুলে পড়াতেও তুমি চাইছো, পারছো না। তখন তুমি কি করবে ? হয় পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গী মুখ বুজে মেনে নেবে নাহয় ঘর ছাড়বে। স্ত্রীর ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। তুমি যদি স্বার্থপর হও, আর তিনি যদি স্বাভাবিক ও উদার মানুষ হন, তাহলেও একই সমস্যা হবে। সেক্ষেত্রে ওনাকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। এবার ধর স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি স্বার্থপর ও সংকীর্ণ হয় এবং তাদের সামর্থ্য থাকলেও সেবার স্পৃহা না থাকে, তবে তারা সৎ গৃহীও নয় এবং সন্ন্যাসী হবারও কোন যােগ্যতা তাদের নেই। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে এদের কোন শ্রেণীতে ফেলবে ? গৃহস্থ না সন্ন্যাসী ?
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিটি মানুষকে আগে স্বাভাবিক হতে হবে, অর্থাৎ মানুষকে আগে মানুষ হতে হবে, ধার্মিক ও উদার হতে হবে। তবে সে পৃথিবীতে নিজের ভূমিকাটি পালন করতে পারবে। মনুষ্যত্বে উপনীত হতে গেলে মানুষকে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে এবং নিজের শক্তির গুণগত রূপান্তর ঘটিয়ে সূক্ষ্ম অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। এই স্থিতিতে পৌঁছে গেছেন এমন-মানুষের সঙ্গ-সান্নিধ্যে নিজের শক্তির রূপান্তর ঘটানাে সম্ভব। শুধু পাত্র নয়, স্থান ও কালও এক্ষেত্রে বিবেচ্য। নির্জনতার দরকার । দুটো সময়ে নির্জন হবার প্রয়ােজন আছে। মনুষ্যত্বে উপনীত হবার জন্য একবার এবং জন্ম-মৃত্যুর কবল থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হবার জন্য আরেকবার। মনুষ্যত্ব এলে তবেই একজন স্বাভাবিকভাবে জীবন নির্বাহ করতে পারবে এবং মানুষ হিসেবে তৃপ্তি আসবে। তখন দ্বিতীয় পর্যায়ে মােক্ষলাভের জন্য তাকে নির্জন হতে হবে । এই আলােচনায় বহুবার এই প্রসঙ্গে কথা বলা হয়েছে। অতএব গৃহী বা সন্ন্যাসী হওয়াটাই মূল কথা নয়, মানুষ হওয়াটাই প্রথম ও আসল কথা ।
সাধারণতঃ গৃহী বলে ‘আমার পরিবারকে পালন করার দায়িত্ব আমার’। গৃহিণী বলে ‘আমার দায়িত্ব স্বামীর পালনের’। কিন্তু স্থূল প্রয়ােজনগুলো মেটাতেই তাদের জীবনের সিংহভাগ কেটে যায়। কেউ সফল হচ্ছেন, কেউ ব্যর্থ হচ্ছেন। যেখানে ব্যর্থতা, সেখানে অশান্তি। যেখানে সাফল্য সেখানেও অশান্তি ও ভুল বােঝাবুঝি। আশি শতাংশ স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সন্দেহ করে, কারণ তাদের একমাত্র অবলম্বন সম্পদ, সুখ ও স্বাস্থ্য। বাড়ির মা অথবা বাবা, ধরা যাক্ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মাসাধিককাল ধরে শয্যাশায়ী হয়ে থাকলেন, তখন ছেলে-মেয়েরাই তাদের একটা উপদ্রব বলে মনে করবে। রুগীর ঘরের পাশ দিয়েও তারা হেঁটে যাবে না। হয়তাে পিতা-মাতার মৃত্যু কামনা করবে এবং সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, জাল দলিল ও মিথ্যা সাক্ষী যােগাড় করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাবে। চিকিৎসককে নিয়মিত নিয়ে আসা হবে প্রতিবেশীদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য। বহু সচ্ছল পরিবারে এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এতটাই যে, এর অমানবিক দিকটা আর কারুর চোখেই পড়ে না। যারা আপনজনদেরই এভাবে অবহেলা করে তারা গৃহের কর্মচারীদের জন্য কতটুকু ভাববে? এরা গৃহস্থ নয়, বাড়িতে এরা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বজায় রাখে। তাই মানবিকতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এই আলােচনায়, গৃহাশ্রম বা সন্ন্যাসশ্রমকে নয়।
জিজ্ঞাসা :—তাহলে দরিদ্র বা অসুস্থ মানুষদের কে প্রতিপালন করৰে ?
মীমাংসা :– আসলে, বহু মানুষের দারিদ্র্য ও অসহায়তার জন্য গৃহীরাই দায়ী। তুমি ভেবে নিয়েছ যে, সমাজে অনগ্রসর শ্রেণীকে সাহায্য করবে গৃহীরা। অর্থাৎ আগে থেকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, জগতে কিছু দুর্ভাগা ও বঞ্চিত মানুষ থাকবেই এবং গৃহীদের কর্তব্য তাদের ভার নেবার। আর তার জন্য গৃহীদের সামর্থ্য থাকা দরকার। এই সামর্থ্য তেরী করতে গেলে সমাজের একটা বড় অংশকে বঞ্চিত করে রাখতে হয়, তবেই সেবার সুযােগ পাবে গৃহীরা, তাই স্বার্থপরের মত তারা সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে যাবে। না, এ ধারণা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।
জিজ্ঞাসা :– আমরা বুঝেছি যে, আপনি তিলমাত্র স্বার্থপরতাকে সমর্থন করতে চাইছেন না, এমনকি গৃহীর ক্ষেত্রেও। কিন্তু যদি একটু স্বার্থ না থাকে, কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের সমস্ত সম্পদ শেষ হয়ে যাবে। ঘর বাড়ি ছেড়ে আমাদের গাছতলায় বসে ভিক্ষা করতে হবে, যে অবস্থায় আমরা আশেপাশে অনেককেই দেখি। সে জীবনকে আমরা ভয়ও পাই, ঘৃণাও করি। সম্পূর্ণ উদার হয়ে গিয়ে যদি নিঃস্ব হতে হয়, তবে আমাদের দায়িত্ব কে নেবে?
মীমাংসা :— ঠিক এই কারণেই এই আলােচনায় বারবার বলা হচ্ছে যে, ভারসাম্য ঠিক রাখতে গেলে মানবতা অপরিহার্য। তাহলে আর বঞ্চনা বা শােষণ থাকবেই না। স্বার্থপরতার ওপর জীবনদর্শন গড়ে উঠতে পারে না এবং তােমার এই উদ্বেগ, ‘কে আমাদের দায়িত্ব নেবে ও কে অপরের দায়িত্ব নেবে’ ? চিরকাল থাকবে অর্থাৎ একটা ব্যবস্থাকে স্বার্থপরতার কাছে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এর ফল মারাত্মক এবং কোন শেষ নেই। … [ক্রমশঃ]