স্বামী বাউলানন্দজী এবং তাঁর সে পেরেন্টাপল্লীর আশ্রম সম্বন্ধে কথা হচ্ছিল। আপ্পা বেঙ্কটরাও এই সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হলো_ অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রি থেকে বেশ কয়েকঘন্টা লঞ্চে গিয়ে গোদাবরীর পশ্চিম তীরে নেমে, খারাই নদী বাঁধের উপরে উঠে_একটি সমতলভূমিতে পৌঁছানো যায় । সেখানে কয়েকটি আদিম অধিবাসীদের কুঁড়েঘর রয়েছে । আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে পার্বত্য নদীর একটা শাখা রয়েছে। এই খরস্রোতা নদীর বরফশীতল হাঁটু জল পার হয়ে আশ্রমের জায়গাটিতে পৌঁছানো যায় । ওই স্থানে নদীটি যেন সবসময় ওঙ্কার ধ্বনি তুলে বয়ে চলে ! নদী পার হলেই বাউলানন্দজীর প্রতিষ্ঠিত “রামকৃষ্ণ মুনিবাতম্”- আশ্রম ! এখানে শিব মন্দির রয়েছে, তাছাড়া রয়েছে শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মন্দির শ্রী রামকৃষ্ণদেব এখানে হংসের ওপর বিরাজ করছেন এবং মূর্তির মুখমন্ডলে এমন প্রশান্তভাব যে মনে হয় তিনি যেন সকলকে শান্তি প্রদান করছেন। মন্দির ছাড়াও এই আশ্রমে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর রয়েছে_ এগুলো তীর্থযাত্রীদের থাকার ঘর। তাছাড়া আরেকটি চালা রয়েছে_ একে যজ্ঞশালা বলে, এখানে ঠাকুরের ভোগ এবং ভক্তদের আহার্য প্রস্তুত হয় ! স্বামী বাউলানন্দজী শরীরে থাকা কালীন সময়ে আপ্পাজী সহ অনেক ভক্তরা যাওয়া আসা করতো। তাদের সঙ্গে স্বামীজী অনেক আধ্যাত্মিক আলোচনা করতেন কিন্তু তাদের কেউ কখনোই স্বামীজীর পূর্বাশ্রমের কোন কথা তাঁর মুখ থেকে শোনে নি। এই নিয়ে ভক্তদের অনেক কৌতূহল ছিল এবং তারা তা নিবারণ করার জন্য বারবার তাঁকে অনুরোধ‌ও জানাতো ! কিন্তু স্বামীজী এই ব্যাপারে বরাবর নিরুত্তর থাকতেই অধিক পছন্দ করতেন।(ক্রমশঃ)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :– আমরা কিছুটা বুঝতে পারলাম। তবে এবার বলুন—যারা আমাদের পরিবারের সদস্য নয়–তাদেরকেও কিভাবে অর্থাৎ কত সঠিকভাবে এবং কত নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারি ?
মীমাংসা :– এটা একটা সুন্দর প্রশ্ন । তুমি আত্মনিরীক্ষণ করে দেখ—তুমি কিন্তু তােমার পরিবারের সদস্যদেরও নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসো না । যে মুহূর্তে তুমি তােমার পরিবারের সদস্যদের নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারবে—তখন থেকেই তুমি কিন্তু অপরকেও নিঃস্বার্থ ও মানবতার দৃষ্টি নিয়েই ভালবাসতে শুরু করবে। অনুরূপভাবে তুমি যখন থেকে নিজেকে যথার্থভাবে ভালবাসতে আরম্ভ করবে—তখন থেকেই তােমার পরিবারের সদস্যদেরও তুমি সঠিকভাবে ভালবাসতে পারবে ।
জিজ্ঞাসা :– এই আলােচনায় কোথায় যেন আমাদের মনে একটা দ্বিধা রয়ে গেল, অর্থাৎ বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা হল না। আমরা ভাবি—আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের নিঃস্বার্থ ভালবাসি। আর অপরদের অর্থাৎ যারা পরিবারের সদস্য নয়, তাদের ভালবাসি স্বার্থের কথা চিন্তা করে। কিন্তু জিজ্ঞাসার উত্তরে এখন বুঝতে পারছি—তা ভুল। সুতরাং দয়া করে এটি আমাদের সহজবােধ্য করে বুঝিয়ে দিন।
মীমাংসা :– সাধারণভাবে দেখতে গেলে তােমরা কিন্তু তােমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের যথার্থভাবে ভালবাসো না—ভালবাসো তাদের শরীরগুলিকে। এজন্যই তােমরা তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের বা আত্মিক উন্নতির জন্য শিক্ষার প্রয়াসী না হয়ে তাদের শারীরিক ভােগ-বিলাসের শিক্ষাই দিয়ে থাকে। এমনকি এই ক্ষেত্রেও তােমরা কিছুটা পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন করো। সন্তানদের মধ্যে যারা একটু বাধ্য এবং যাদেরকে বেশী উপযােগী বলে মনে কর তাদের প্রতি তােমাদের বেশী মনোেযােগ থাকে। এটা অবশ্য পূর্বাপর সংস্কার থেকেই তােমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে—কারণ তােমরা নিজেরাও নিজেদের সত্তার চেয়ে শরীরকেই বেশী ভালবাস। এটা ভুল এবং এখান থেকেই জন্ম নেয় স্বার্থপরতা। ফলে তােমরা পরিবারের সদস্যদের শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই চিন্তিত থাকো—তাদের আত্মিক বিকাশের দিকে নয়। এভাবেই তােমাদের সন্তান-সন্ততিদের সঠিক পথনির্দেশের অভাব হয়, যার ফলে আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকো।
জিজ্ঞাসা :– তাহলে কি আমরা তাদের এই শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যবােধের শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেব ?
মীমাংসা :– না—আমি তা বন্ধ করে দেবার কথা বলছি না। আমি বলছি তােমরা তােমাদের সন্তানদের এমন শিক্ষা দাও যাতে করে তারা মানবিকগুণে সমৃদ্ধ হয় এবং তারা ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযােগ পায়। শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা আরাম-বিলাসের দিকে নজর কম হলেই তারা তাদের আত্মিক উন্মেষের জন্য বেশী মনােযােগ ও উদ্যম প্রয়ােগ করতে পারবে।
জিজ্ঞাসা :– তাহলে সেই শিক্ষার পদ্ধতিটা কিরকম হবে ?
মীমাংসা :– এতক্ষণ যে শিক্ষার কথা বললাম –প্রথমে সেই পদ্ধতিতে নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। তারপর তােমাদের স্ত্রীদের এবং পরে ছেলেমেয়েদের একই পদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তুলবে। তাহলেই দেখবে তুমি নিজেকে সঠিকভাবে ও নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারছাে এবং পরিবারের সদস্যরাও তাদের নিজেদেরকে সঠিকভাবে ভালবাসতে পারছে। এরূপ অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে—তুমি এবং তােমার ছেলেমেয়েরা অন্যজনেদেরও দেখবে ভালবাসতে পারছে। শিক্ষার মুখ্য অঙ্গগুলি হল—তুমি এখন কি এবং অতীতে কি ছিলে—তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা এবং এই দুয়ের মধ্যে যে প্রভেদ তার সঠিক বােধ প্রয়ােজন। তাছাড়া তােমার বেঁচে থাকার অর্থাৎ অস্তিত্বের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণের প্রধান উপায়গুলি কি তা স্মরণপূর্বক তার মূল্যায়ন প্রয়ােজন।
জিজ্ঞাসা :– আচ্ছা! আপনার আলােচিত উপলব্ধি, স্মরণ ও বােধে বােধের মূল্যায়ন কি সম্ভব যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে আত্মশক্তির বিকাশ ঘটছে ?
মীমাংসা :– হ্যাঁ, এটা পুরােপুরিই সম্ভব । দেখো, বস্তুজগতের সবকিছুর সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে মানিয়ে চলার জন্য এই আত্মশক্তির রূপান্তরণ ও অভিবিকাশ অপরিহার্য, যা কিনা উপলব্ধি, স্মরণ ও বােধে বােধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই হওয়া উচিত।।
জিজ্ঞাসা :– আপনার নিকট এগুলি জেনে আমরা অত্যন্ত উৎসাহ বােধ করছি। তাহলে এবার বলুন—উপরােক্ত শিক্ষার মুখ্য অঙ্গগুলি কি ?
মীমাংসা :– তােমার সঠিক উপলব্ধিতে তুমি কি ? –তুমি একজন মানুষ তথা ব্যক্তিসত্তা। সাধারণ অনুভূতি, সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম ও আধ্যাত্মিক চেতনা ও ব্যক্তি অহং নিয়ে তােমার এই সমগ্র ব্যক্তিসত্তা গঠিত। এই সমস্তগুলি ছাড়াও তােমার আনন্দ বিনােদন ও সৃজনশীলতার অনুভূতি রয়েছে আর রয়ােছ সৃজন ক্ষমতা ও পুনঃসৃজন ক্ষমতা। তুমি যখন শরীর ত্যাগ করবে তখন এই সৃজন ক্ষমতা ও পুনঃসৃজন ক্ষমতা লােপ পাবে, কিন্তু তােমার সত্তা নষ্ট হবে না। তখন তােমার দেহ বিনষ্ট হলেও ঐ ব্যক্তিসত্তা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেই থাকবে কিন্তু এই পার্থিব জগতে নয়। সেই স্থিতিতে তােমার যাবতীয় শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য রহিত হয়ে যাবে। এমন কতকগুলি উপাদান আছে যা শরীরকে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে ঐ সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য শরীরের নিমিত্ত যেন না হয় তা যেন হয় সত্তার বা জীবাত্মার স্বস্তির জন্য। তাই দেহকে সত্তার (জীবাত্মার) সম্ভোগের যন্ত্ররূপে গড়ে তুলতে হবে—দেহের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে। তােমার সত্তার তথা জীবাত্মার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে তােমার নিঃস্বার্থ মানবিক চেতনার বিকাশে । আর সেগুলি প্রাপ্ত হতে গেলে তােমাকে প্রথম থেকেই নিঃস্বার্থ হবার অনুশীলন করতে হবে। এই জন্য তােমার সমস্ত শক্তি ও মনকে এমন খাতে প্রবাহিত করতে হবে যাতে শরীরটা ঐ চেতনা বিকাশে সহায়ক হয় এবং সেই উন্নয়নটা তােমার শরীর ত্যাগের পরও ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে যায়—যখন তােমার বিদেহী আত্মা বা জীবাত্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান থাকবে। … [ক্রমশঃ]