স্বামী বাউলানন্দজীর পূর্ব জীবনের(ছোটবেলার) পরিচয় সংক্রান্ত কথা হচ্ছিল ! ভক্তরা যতই স্বামীজীকে তার পূর্ব জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করতেন_ স্বামীজি ততই ব্যাপারটাকে কৌশলে এড়িয়ে যেতেন! তবে ভক্তরা এটা জানতে পেরেছিল যে, স্বামীজীর মায়ের নাম ছিল “কল্যানী” এবং তিনি অধিক বয়সে জাত! তাছাড়া তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের একমাত্র সন্তান।
ঠিকমতো পরিচয় না পাওয়ার জন্য ভক্তদের অনেকেই তাকে স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ তামিল ভাবতো(যেহেতু স্বামীজী তামিল,তেলেগু ভাষায় খুবই পারঙ্গম ছিলেন)__ কিন্তু বেশিরভাগ ভক্তই জানতো যে_ তিনি বাঙালি। স্বামী বাউলানন্দজী যে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিপ্লবী ছিলেন _এ ব্যাপারে ভক্তরা নিশ্চিত ছিল! কোন কোন ভক্ত তাঁকে এ অঞ্চলের প্রখ্যাত বিপ্লবী ‘আল্লুরি সীতারাম রাজু’ _ বলে অভিহিত করতেন । স্বামী বাউলানন্দজী অবশ্য এসব ব্যাপারে কোন গুরুত্ব দিতেন না _ তিনি পূর্বের কোন প্রসঙ্গ উঠলেই হেঁসে উড়িয়ে দিতেন এবং বলতেন _”আমরা কোন নির্দিষ্ট স্থানের জীব _এই ভাবনা সংকীর্ণ ভাবনা! এই সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে আমরা _’সারা বিশ্বের’, ‘আমরা সকলের’ এই ধারনা কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাই তো আমি করে যাচ্ছি । সুতরাং এই সত্যকে উপেক্ষা করে কোন জিজ্ঞাসাকারীকে মিথ্যা আনন্দ দেওয়ার জন্য __কেন নিচের স্তরে নিজেকে নামাবো!
স্থানীয় মানুষেরা স্বামীজীকে ‘বাউলানন্দ’ না বলে ‘বালানন্দ’ বলতো_কারণ তেলেগু ভাষায় বাউলানন্দ কথাটির তাৎপর্য তারা খুঁজে পেতো না।এই নিয়েও স্বামীজীর কোনো আপত্তি ছিল না_উনি ‘স্বামী বাউলানন্দ’-নামের বদলে স্বামী বালানন্দ নামেই স‌ই করতে শুরু করেছিলেন।(ক্রমশঃ)
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
তুমি একদা কি ছিলে এবং এখন তুমি কি অবস্থায় আছ–তার তফাৎ সম্বন্ধে স্মরণ করতে গিয়ে বলা যায়—তােমার শরীরবিহীন অবস্থায়—বিশ্বজনীনতায় তােমার চেষ্টার কোন প্রবণতা ছিল না। অথবা তােমার স্বকীয়তা লাভের কোন প্রবণতা ছিল না। উদ্ভিদ অবস্থায় তােমার মধ্যে কিছুগুণ থাকায় তুমি তােমার সুখ-সমৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলে। আবার তুমি যখন নিন্মশ্রেণীর অমানব বা মনুষ্যেতর অবস্থায় ছিলে, তখনও কিছু ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য থাকায় সুখ ও নিরাপত্তার দিকেও তােমার ঝোঁক ছিল। এরপর যখন তুমি উচ্চশ্রেণীর মনুষ্যেতর অবস্থায় এলে, তখন তােমার আরও অধিক প্রবণতা হল সুখ ও নিরাপত্তা লাভ করার ।
এবার যখন তুমি মনুষ্যপ্রজাতির এক মানবসত্তায় পরিণত হলে তখন তােমার সবরকম বৈশিষ্ট্য থাকায় সঠিকভাবে ও সংগতিপূর্ণভাবে বিশ্বজনীনতা লাভের জন্য নিজেকে সমৃদ্ধ করলে এবং স্বকীয়তা লাভ করলে। এখানেই তােমার প্রকৃত সুখ ও নিরাপত্তা নিহিত আছে। এই হচ্ছে তুমি কি ছিলে এবং এখন কি আছ–তার পার্থক্য।
মানবশরীরে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সঠিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলতে হয়—এই স্থিতিতে নিঃস্বার্থতা ও মানবিকতার উৎকর্ষসাধন করাই তােমার উদ্দেশ্য, যাতে মনুষ্যেতর ও অমানব প্রাণীরা স্বাভাবিকভাবেই তােমার এই উৎকর্ষতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই পৃথিবীতে প্রথম মানবশরীর নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে । আর এই উৎকর্ষতার গুণাবলীই জগতের সবকিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় দূর করতে সহায়ক হবে। এইভাবেই জগতের যাবতীয় সমস্তকিছুর বৃদ্ধি ও প্রাচুর্য ঘটে। আবার প্রাথমিক ফলশ্রুতি হিসাবে বলা যেতে পারে যে, এই পদ্ধতিতেই জগতের যাবতীয় সবকিছু—এমনকি মনুষ্যপ্রজাতির প্রাণীরাও পরস্পর পরস্পরের সহায়করূপে বা একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে পারে ।
বর্তমানে এই পৃথিবী সমস্তকিছুতে যে অনৈক্য, বিঘ্ন, দারিদ্র ও বিনষ্টকারী লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে চলেছে, সেগুলি ঐ পদ্ধতিতেই ঐক্য, শান্তি ও প্রাচুর্যে রূপান্তরিত হয়ে প্রগতির পথে এগুবে এবং সেই সঙ্গে প্রকাশিত হবে এই পৃথিবীতে এক আনন্দঘন মধুর পরিবেশ। এর পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিনষ্টকারী লক্ষণগুলি লােপ পেয়ে এই জগতে বিরাজ করবে এক অনাবিল শান্তি। এটাই হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির বেঁচে থাকার বা অস্তিত্বের উদ্দেশ্য এবং এটা সমগ্র পৃথিবী তথা বিশ্বের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযােজ্য।
সুতরাং ঐ পদ্ধতির নীতি, আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঠিক স্মরণ ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা যায় যে, ঐ পদ্ধতি হল সমস্ত কিছুর ওপর একটা নিঃস্বার্থ কর্মযজ্ঞ। আর তুমি মানব সমাজের একজন, তাই তােমারও এই শরীর নিঃস্বার্থ কাজের জন্যই গঠিত হয়েছে। এর ফলশ্রুতি হিসাবে তুমি যাদের সঙ্গে চলা-ফেরা, ওঠা-বসা করছে—তারাও তােমার নিঃস্বার্থ সেবা-কর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রগতির পথে অগ্রসর হবে আর তুমি হয়ে উঠবে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। এই ভাবেই তুমি অপরকেও উন্নত চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ও উন্নীত করতে পারবে। তাহলে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রগতি ও উন্নতির পথে সহায়ক হয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা নাগরিক হিসাবে রূপান্তরিত হবে এবং এইভাবেই পৃথিবীও উত্তরােত্তর প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে ৷
জিজ্ঞাসা :—আচ্ছা, আমাদিগকে স্মরণ ও মনন করতে বলা হচ্ছে—অর্জন করতে বলা হচ্ছে না কেন ?
মীমাংসা :– দ্যাখাে, একজন মানুষ হিসাবে এই অপরােক্ষ অনুভূতিগুলি তােমার মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল এবং এগুলি তােমার সহজাত তাই তােমাকে স্মরণ ও মনন করতে বলা হচ্ছে—অর্জন করতে নয় ।
জিজ্ঞাসা :—তাহলে আমাদিগকে কি অর্জন করতে হবে ?
মীমাংসা :– যে সমস্ত পরম বােধগুলি তােমার মধ্যে সহজাত ও অন্তর্নিহিত আছে—সেগুলিকে স্মরণ করে এবং ভিত্তি করেই তােমাকে তােমার কাজের স্থিতি বা অবস্থা অর্জন করতে হবে।
জিজ্ঞাসা :—সহনশীলতার উপর আমাদের একটা আস্থা আছে। এই সহনশীলতাকে আমরা একটা মানবিকগুণ বলে বিবেচনা করি। এই সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতা আমরা কিভাবে অর্জন করবাে ?
মীমাংসা :— এই সহিষ্ণুতার অনুভূতি তােমার মধ্যেই আছে এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্যেই এই সহিষ্ণুতা-সহনশীলতা বিভিন্নভাবে কমবেশী অবস্থায় আছে। ভালবাসা থেকেই এই সহিষ্ণুতার উৎপত্তি। সেই ভালবাসা স্বার্থ নিয়েই হােক বা নিঃস্বার্থভাবেই হােক। কারণ যে ভালবাসে –তাকে সহিষ্ণু হতেই হয়। এটা সহজাত। মা কি সন্তানের অত্যাচার সহ্য করে না ?… [ক্রমশঃ]