স্বামী বাউলানন্দজীর ছোটবেলাকার কিছু কথা এখানে বলা হচ্ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে স্বামীজীর প্রথাগত শিক্ষালাভ খুব একটা হয় নি! কিন্তু কেন? এই নিয়ে আজ আলোচনা করা যাক্!
আমরা জেনেছি যে তিনি খুব বড় ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন_ফলে ওনার ছোটবয়সে হাতেখড়ির দিন ওনাদের বাড়িতে খুব ঘটা করে অনুষ্ঠান পালন হয়েছিল। সম্ভবতঃ সরস্বতী পূজার দিন এবং সরস্বতী প্রতিমা পূজার শেষে ওনাকে হাতে খড়ি দেওয়া হয়েছিল । পন্ডিতমশাই মেঝেতে ছড়ানো চালের উপরে “ওঁ” এবং সরস্বতীর প্রনাম মন্ত্র লেখানো হয়েছিল। পন্ডিতমশাইকে নতুন বস্ত্র, উপযুক্ত দক্ষিণা ইত্যাদি দেওয়া হয়েছিল। তারপর রীতিমতো প্রসেশন্ সহকারে শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ছাত্রদেরকে মেঝের উপর বালি ছড়িয়ে আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে বর্ণমালার অক্ষরগুলি লিখতে হোত। কোন ছাত্র ঠিকমতো না পারলে দেওয়া হোত শাস্তি!
এই একটা ঘটনাই বালক স্বামীজীর জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। একদিন পড়া না পারার জন্য পন্ডিতমশাই একজন ছাত্রকে প্রচন্ড বেত্রাঘাত করলেন এবং সেই ছাত্রটি আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রবলভাবে কাঁদছিল। এই ঘটনায় বালক স্বামীজী খুবই ভয় পেয়ে গেছিলেন_ঐদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে গেছিলেন। সেই রাতে ওনার প্রবল জ্বর এসেছিল এবং সেই জ্বর বেশ কিছুদিন স্থায়ীও হয়েছিল। স্বামীজীর মা যে কোনভাবে আসল সত্যটা জানতে পেরেছিলেন_তাই সেই দিনেই মা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে,”আমার ছেলে আর কোনোদিন স্কুলে আসবে না”। ঐদিন থেকেই স্বামীজীর স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটায় ইতি হয়ে যায়। এরপর উনি যা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন_তা বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে এবং বাকিটা পরবর্তীকালে ওনার নিজের চেষ্টায়।।(ক্রমশঃ)
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :– মহারাজ, প্রয়াত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কি কেবলমাত্র পুত্ররাই করতে পারবে এই ধারণা বা বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায় ?
মীমাংসা :– দ্যাখাে, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ সাধারণভাবে ভীষণ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। সেইহেতু তারা কেবল নিজেদের শারীরিক সুখভােগ ছাড়া অন্য কোন জিনিসের প্রতি কোন উৎসাহবােধ করে না। ফলে অতীত এবং ভবিষ্যতের স্মৃতিকে স্মরণে রাখার ধারাকে অব্যাহত রাখার মধ্যে একটা ভাঙনের সৃষ্টি হয় । এরকম যখন একটা অবস্থা হয়, তখন অতীতের স্মৃতির স্মরণে রাখার ধারাকে অব্যাহত রাখতে মানুষ দৈনিক, মাসিক এবং বার্ষিক কিছু যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়া এবং উৎসবাদি পালনের মধ্যে দিয়ে সেই ধারাকে পুনঃসংস্থাপন করতে উদ্যোগী হয়। তারপর সেইসব যাগযজ্ঞ ও উৎসব পালন করার পর মানুষ সেই দিনক্ষণ, তিথি ও নক্ষত্রগুলি ভুলে বসে থাকে। তাই ভুলভ্রান্তিগুলি দূর করতেই মানুষ তখন আবার নতুন করে সেই উৎসব ও যাগযজ্ঞের সঙ্গে কিছু ভাল খাবার-দাবারের রীতি প্রচলন করে—যাতে করে বর্তমান প্রজন্ম ঐ সব দিনক্ষণ, তিথি-উৎসবাদি পালনে উৎসাহবােধ করে এবং তার মধ্যে দিয়ে প্রয়াত ব্যক্তিকে স্মরণে রাখে। সেই থেকে সাধারণ মানুষের একটা অংশ, যারা নাকি সেই সমস্ত ভাল ভাল খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন, তা করে যাচ্ছেন এবং সেই ধারা এখনও চলছে ।
জিজ্ঞাসা :—এই জগতে কেউ কেউ আছেন, যারা নির্জনবাসে গিয়ে ঘটনাচক্রে কৃচ্ছসাধনে অপারগ হয়ে ওঠে। তারা এই নির্জনবাসে শক্তির কত ক্ষমতা এবং শক্তির রূপান্তরের কি ধারা তা জানে না। তাছাড়া এই নির্জনবাসের যে কি মহৎ উদ্দেশ্য সে সম্বন্ধেও তারা অবহিত নয় । প্রকৃতপক্ষে তারা আধ্যাত্মিক উপলব্ধির থেকে বহু দূরে। তারা ধ্যানের মাহাত্ম্য এবং মনােসংযােগের গভীরতা সম্বন্ধেও অজ্ঞ। আচ্ছা এই সমস্ত ব্যক্তিরা যদি নির্জনবাসে একটা অনুকূল পরিস্থিতিও পেয়ে যায়, তাহলে কি তারা অন্য সমস্ত ব্যক্তি যারা স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্জনবাসে ধ্যান করছেন, তাদের মতাে শক্তির রূপান্তরের ধারা ও ক্ষমতা লাভ করতে পারবে ?
মীমাংসা :– হ্যাঁ, তারা নিশ্চয়ই তা পারবে । তবে তাদের পক্ষে শক্তির রূপান্তরের ধারাগুলি পেতে বিলম্বিত হবে এবং ধারাগুলি ধীর-লয়ে চলবে । তবে তারা যদি এই ধীর – লয়ে চলার গতিটাকে বহুদিন ধরে চালিয়ে নিতে পারে, তখন তারা একসময়ে স্বাভাবিকভাবেই এবং নিজের থেকেই শক্তির ক্ষমতা এবং রূপান্তরের ধারাগুলি সহজে বুঝতে পারবে এবং সেইসঙ্গে নির্জনে ধ্যানের মাহাত্ম্য ও মনােসংযােগের গভীরতার যে কি উপযােগিতা, তাও উপলব্ধি করতে পারবে।
জিজ্ঞাসা :—আচ্ছা, মহারাজ, দেখা যায় যে, রাজ্য পরিচালনায় আইনের শাসন অনুযায়ী যারা নাকি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি অন্যায় ও ক্ষতিসাধন করে, তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয় এবং এটা করা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থেই। আবার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, যাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সেই অন্যায়কারীদের স্বার্থেও এটা করা হয় আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্যায়কারী বা ক্ষতিসাধনকারী কাউকে কাউকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তাদের দেহকে নাশ করা হয়। আচ্ছা এই ধরণের দৈহিক নির্যাতন বা দেহনাশে কি সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন স্বার্থরক্ষিত হয় ? বা যার শরীরকে হত্যা করা হল, তার কোন স্বার্থ রক্ষা করা হল ?
মীমাংসা :– না মােটেই না, এই ধরণের হত্যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের এবং কারও কোন স্বার্থ রক্ষিত হয় না এবং যাদের শরীরকে হত্যা করা হল, সেই অন্যায়কারীদের স্বার্থেরও এটা পরিপন্থী।
জিজ্ঞাসা :—আচ্ছা, এটা কিভাবে সবার স্বার্থের পরিপন্থী ?
মীমাংসা :—কারণ যে সমস্ত অন্যায়কারীদের শরীরকে হত্যা করা হল, তাদেরকে সংশােধন ও শুদ্ধিকরণের সুযােগ থেকে এবং ভালভাবে বেঁচে থাকার সুযােগ থেকেও বঞ্চিত করা হল। এটাই স্বার্থের পরিপন্থী নয় কি?
জিজ্ঞাসা :– এই ধরণের শাস্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর কি প্রতিফলন ঘটাতে পারে ?
মীমাংসা :– দ্যাখাে, এই জগতে দু ধরণের বা দুরকমের অন্যায়কারী ও ক্ষতিসাধনকারী লােক রয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরণের লোক যারা নাকি নিজেদের জ্ঞান ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয় না এবং যারা নাকি শক্তি রূপান্তরজনিত ক্ষমতাও অর্জন করেনি। অপর পক্ষের লােক হল, যারা শক্তির রূপান্তরের ক্ষমতা অর্জন করেছে বটে_ তবে তারা সেই ক্ষমতার গুণগত মান লাভ করতে পারেনি এবং বিবেক ও জ্ঞান দ্বারা পরিচালিতও নয় ।
আবার দ্যাখো, এই ধরণের লােকেরাই কিন্তু তাদের ঐ অন্যায় ও পাপকার্য সম্পাদন করার একটা যুক্তি খুঁজে পায়। হয়তাে বা সেই যুক্তি ও কারণের একটা ভিত্তিও ওরা দেখতে পায় । সেটা যে কোনাে বিষয়ের উপর ভিত্তি করেও হতে পারে। চিন্তা-ভাবনা এবং যুক্তি সংস্কারগতভাবে একটা অভ্যাস এবং এটা শরীর-সম্পর্কিতও নয় । আর এই চিন্তা-ভাবনা ও যুক্তির অভ্যাস তাদের শরীরের মৃত্যুর পরও চলতে থাকে। এই চিন্তাভাবনা ও যুক্তির ধারাটা তাদেরকে আবার পুনঃশরীর ধারণে প্রভাবিত ও বাধ্য করে। যেহেতু এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কারগুলি শরীরবিহীন অবস্থায় জীবাত্মারূপে সূক্ষ্ম জগতে বিরাজ করে, সেইহেতু এই চিন্তা-ভাবনার অভ্যাসগুলি তথা অন্যায় ও পাপকার্যগুলি পুনঃশরীর ধারণ করা পর্যন্ত প্ররােচিত করে এবং তা ক্রমশ প্রগাঢ় হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীকালে যখন জীবাত্মা শরীর ধারণ করে, তখন সেই অন্যায় ও পাপকার্যগুলি আরও বেশী বেশী করে থাকে। সুতরাং শাস্তির ফলে শরীরকে হত্যা করা হয়, তার স্বভাব বা সংস্কার পরিবর্তন হয় না। আর এই ধরণের শরীর-হত্যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বা কোন ব্যক্তি বিশেষেরও কোন স্বার্থরক্ষিত হয় না।
জিজ্ঞাসা :– কিন্তু আইন কি বলে ? যে আইন নাকি বহুল প্রচলিত ও বিশ্বজনীন এবং যা বিশেষ কোন অপরাধের জন্য মনুষ্য-শরীরকে হত্যার বিধানও অনুমােদন করে ?
মীমাংসা :— অবশ্যই আইন তাে সেখানে আছে। এবার আইনের একটু বিশ্লেষণ করা যাক। কেন এ ধরণের আইন প্রণীত হল ? এবং এই আইনের উদ্দেশ্যই বা কি আর এর ফলে কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে ?
এই জগতে কিছু কিছু ব্যক্তি তাদের চরমতম অমানবিকতার জন্যই ঘৃণ্যতম অপরাধ আরম্ভ করেছিল, যা নাকি অসামাজিক এবং সমাজে স্বীকৃত নয়। অন্যদের প্রতি সেই সমস্ত অসামাজিক সন্ত্রাসকার্য রুখতে বা তাদেরকে ঐ ধরণের অপরাধমূলক সন্ত্রাস থেকে বিরত রাখার জন্যই মৃত্যুদণ্ডজনিত শাস্তির আইন প্রণীত হয়েছিল। এই ধরণের শাস্তি যদিও সমাজে কিছু স্বস্তি এনেছিল, তবে তা খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। যে সমস্ত অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে তাদের শরীরকে হত্যা করা হয়েছিল, কিছু সময় পরে তারা আবার অন্য শরীরধারণ করে এই জগতে ফিরে আসছে। এবং অন্যদের সঙ্গে এই সমাজেই বাস করছে।
এই পুনঃশরীরধারণ অবস্থায়, যা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে, তাদের ইন্দ্রিয় অনুভূতি ও চিন্তা-ভাবনাগুলি পূর্বজন্মের মতই রয়ে গেছে, বরং আরও বেশী শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে তারা ঐ ধরণের ঘৃণ্যতম অপরাধ করতে আনন্দ পায়, এই অবস্থায়ও তাদেরকে পূর্বের মতই আইন-অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়। এই ভাবেই অপরাধ এবং শাস্তি—দুইই এই জগতে চলতে থাকে। দেখা যাচ্ছে, জগতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারেই এই অপরাধও বাড়ছে এবং শাস্তিও চলছে। আর বর্তমান সময়ে এ ধরণের অপরাধ এবং হত্যার শাস্তি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে এই শাস্তি কিন্তু অপরাধকে বাড়িয়ে তুলতে প্রভাবিত করছে। … [ক্রমশঃ]