আমরা স্বামী বাউলানন্দজীর ছোটোবেলাকার জীবন নিয়ে আলোচনা করছিলাম। গত এপিসোডে আমরা দেখেছিলাম যে স্বামী বাউলানন্দজী ছোটবেলায় তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর একদল ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসীর সাথে ঈশ্বর লাভের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হন। সেই সন্ন্যাসীদের সাথে ঘুরতে ঘুরতেই স্বামীজীর বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষা লাভ এবং বিদ্যা লাভ সবকিছুই সম্পন্ন হয়। সন্ন্যাসীরা যেখানে যখন বিশ্রাম করতেন_ তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে জীবন সম্বন্ধে, জগৎ সম্বন্ধে, মহাকাশ সম্বন্ধে, অধ্যাত্ম জীবনের বিভিন্ন practice সম্বন্ধে_ আলোচনা করতেন। তাছাড়া তাঁদের কাছে স্থানীয় মানুষেরা বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে আসতো এবং তাঁরা সুন্দরভাবে আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে সবকিছু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। এই সব থেকেই স্বামীজী তাঁর প্রাথমিক অধ্যাত্মজ্ঞান-এর পাঠ পেয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এই সন্ন্যাসী দলের সঙ্গলাভ তাঁর খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভ্রমনকালে কোন এক স্থানে একবার স্বামীজীর শরীরে গুটি বসন্ত দেখা দেয়, তখনকার দিনে গুটিবসন্ত ছিল একটি মারাত্মক রোগ! তাঁকে গ্রামের একটি মাটির ঘরে রেখে দিয়ে ওই সন্ন্যাসীর দল তাদের নিজের পথে চলে যায় ! এই অবস্থায় মা জগদম্বা তাঁর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ওই গ্রামবাসীদের মধ্যে একজনের সাহায্য জুটিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে গুটি বসন্ত হোলে সাধারণত মানুষেরা মারা যেতো, নাহলে ওই রোগীর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যেতো বা মুখমন্ডলে বিভৎস গর্ত গর্ত ক্ষত হয়ে যেতো। ফলে সাধারণত কেউই গুটিবসন্ত রোগীকে সেবার ভার গ্রহণ করতে চাইতো না । কিন্তু মা জগদম্বার কৃপায় ওই গ্রামবাসীটি_ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই অপরিচিত বালকটিকে (স্বামী বাউলানন্দজী) সেবা কোরতো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, সন্ধ্যের আগে ওই গ্রামবাসী টি চলে যাওয়া মাত্রই দুইজন মহিলা সেই ঘরে আবির্ভূত হোতো। তারা প্রায় নগ্ন দেহে থাকতো, তাদের বিস্তৃত এবং অবিন্যস্ত কেশ, মুখমন্ডল ছিল উজ্জ্বল । এদের একজনের রং ছিল কালো এবং অন্যজনের ফর্সা। তাদের মনোমুগ্ধকর হাসি সেই অসহায় বালককে সাহস এবং শক্তি যোগাতো। তাদের স্পর্শে তিনি শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে অনেকটা আরাম পেতেন। তারা কেউ কাউকে কোনো কথা বলতো না_ শুধু সারারাত্রি তারা রোগীর শয্যার দুই পাশে বসে তরুণ স্বামীজীকে মৌন সান্ত্বনা দিতো। স্বামীজী তাদের মুখ-পানে চেয়ে থাকতেন এবং নিরীক্ষণ করে দেখতেন তাঁর মায়ের সঙ্গে তাদের মিল আছে কি না!! তারা যেই হোন না কেনো_ স্বামীজি তাদের উপস্থিতি খুবই উপভোগ করতেন! সারা রাত্রি এইভাবে কেটে যাওয়ার পর সকালে যখন গ্রামবাসী টি এসে দরজায় ধাক্কা দিতো_ তখন ওই মহিলা দুটি অদৃশ্য হয়ে যেতো। স্বামীজী সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত 18 দিন যাবৎ এইভাবে মা জগদম্বার লীলা চলেছিল।(ক্রমশঃ)
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :–মহারাজ, এ জগতে দুঃখ-কষ্ট কেনো এবং তার কারণ এবং সেইসঙ্গে দুঃখ-কষ্ট নিরসনের উপায় সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে যে ব্যাখ্যা পেলাম –তাতে আমরা মােটামুটি সন্তুষ্ট। তবে এ ব্যাপারে আমরা আরও একটু জানতে ইচ্ছুক যে, এছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কি ?
মীমাংসা (স্বামী বাউলানন্দ মহারাজ) :— হ্যাঁ সম্ভব।
জিজ্ঞাসা :— যদি সম্ভব হয়, তাহলে তার ব্যাখ্যা তথা মীমাংসা জানতে আমরা আগ্রহী।
মীমাংসা :– দ্যাখো, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সাধারণ-অসাধারণ, সুন্দর-অসুন্দর, জীবনমুখী-সৃজনমুখী –সব রকমের শক্তিই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে এবং সেই সঙ্গে স্বার্থপরতা ও নিঃস্বার্থতা তথা স্বার্থহীনতার শক্তিও রয়েছে, তবে সবার ওপরে বিরাজমান আছে আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সে সমস্ত শক্তিগুলি –যেগুলি বস্তুশরীর, ইন্দ্রিয় ও ব্যক্তির ওপর কোনাে ভেদাভেদ না রেখেই অবতরিত বা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে এবং প্রত্যেকেই সেই শক্তিকে কম-বেশীহারে গ্রহণ তথা শোষণ করছে। এতদ্ব্যতীত অশােষিত শক্তিসমূহ সে সমস্ত বস্তু, শরীর ও ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গুলি থেকে নির্গত হয়ে যাচ্ছে।
দ্যাখো, এই পৃথিবীর অন্তহীন শক্তির সমুদ্রে আধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ও অনাধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিরা অতীতে সর্বদাই ছিলেন এবং বর্তমানেও আছেন ! আধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শক্তির মধ্যে রয়েছে–স্বার্থহীনতা বা নিঃস্বার্থতার শুচিতা ও গুণাবলী, অপরদিকে অনাধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শক্তির মধ্যে রয়েছে স্বার্থপরতার আবিলতা বা অশুচিতা। এই শক্তিসমূহের মধ্যে সহজাত হয়ে রয়েছে ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া। স্বার্থপর ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে স্বার্থপর ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া, অপরদিকে নিঃস্বার্থ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে নিঃস্বার্থতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া। স্বার্থপর-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শরীর ও ইন্দ্রিয়গুলি কেবল স্বার্থপর শক্তিগুলিকেই শােষণ করে—অপরদিকে নিঃস্বার্থ-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শরীর ও ইন্দিয়গুলি কেবল নিঃস্বার্থশক্তি শোষণ করে। যে সমস্ত ব্যক্তিরা স্বার্থপরতার শক্তি শােষণ তথা গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় স্বার্থপর ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে বা বিপরীত দিকে যে সমস্ত ব্যক্তিরা স্বার্থহীন শক্তি বা নিঃস্বার্থশক্তি শোষণ করে, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় নিঃস্বার্থতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত।
এই ভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তিই সমাজের অপরাপর ব্যক্তির ওপর তাদের স্ব স্ব আধার অনুসারে কেউ কেউ স্বার্থপরতার আবিলতা আবার কেউ কেউ নিঃস্বার্থতার শুচিতা বয়ে নিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সমাজে একটা খাত সৃষ্টি হয় এবং সেই খাতের মাধ্যমেই বিস্তারলাভ করে স্বার্থপরতা অথবা নিঃস্বার্থপরতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত। এইভাবে সমস্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই মানবসমাজে বিস্তারলাভ করে ভাল ও মন্দ, সৃজনমুখী ও ধ্বংসমুখী, ঠিক ও বেঠিক, পরোপকারী ও অনােপকারী, ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত_ যা নাকি সেইসব আধ্যাত্মিক ও অনাধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সঙ্গে সহজাত হয়ে রয়েছে। এই অবস্থাগুলি অবিরাম ধারায় জগতে চলতে থাকে । আসলে এটা একটা সমষ্টিগত বা সামগ্রিক ব্যাপার। তাই এই অবস্থার উত্তরণের জন্য চাই সামগ্রিক চেতনা আর তা কেবল মানব সমাজই দিতে পারে এবং সেই দেওয়ার উপায় ই হল সামগ্রিক নিঃস্বার্থ চেতনা ।
অতএব সমগ্র মানবের ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপান্তর করে এমন একটা উন্নত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে, যখন কেবল তারা সেই সমস্ত শক্তিই শোষণ তথা গ্রহণ করবে—যার মধ্যে নিঃস্বার্থতারই ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত সহজাত হয়ে রয়েছে । এখন আমরা প্রার্থনা জানাই সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এবং সেই জানা-অজানা আধ্যাত্মিক-শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষদের কাছে, যাঁরা ছিলেন এবং যাঁরা এখন ও এই জগতে – এই বিশ্বে বর্তমান আছেন । তাঁরা যেন প্রত্যেক ব্যক্তিকে এমন ভাবে মহৎ করে তােলেন, যাতে তারা প্রত্যেকেই একটি করে খাতের সৃষ্টি করে—যার মধ্যে দিয়ে কেবল নিঃস্বার্থ ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্তের স্রোত বয়ে চলে এবং এটাই হবে মানবসমাজের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য আর এই প্রার্থনা যেন সমগ্র মানবজাতির তরফ থেকেই হয় ।
[ স্বামী বাউলানন্দজীর ‘আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা’ ( Spiritual Enquiry ) গ্রন্থ সমাপ্ত হল । ]
কিন্তু এই সন্ন্যাসী দলের সঙ্গলাভ তাঁর খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভ্রমনকালে কোন এক স্থানে একবার স্বামীজীর শরীরে গুটি বসন্ত দেখা দেয়, তখনকার দিনে গুটিবসন্ত ছিল একটি মারাত্মক রোগ! তাঁকে গ্রামের একটি মাটির ঘরে রেখে দিয়ে ওই সন্ন্যাসীর দল তাদের নিজের পথে চলে যায় ! এই অবস্থায় মা জগদম্বা তাঁর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ওই গ্রামবাসীদের মধ্যে একজনের সাহায্য জুটিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে গুটি বসন্ত হোলে সাধারণত মানুষেরা মারা যেতো, নাহলে ওই রোগীর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যেতো বা মুখমন্ডলে বিভৎস গর্ত গর্ত ক্ষত হয়ে যেতো। ফলে সাধারণত কেউই গুটিবসন্ত রোগীকে সেবার ভার গ্রহণ করতে চাইতো না । কিন্তু মা জগদম্বার কৃপায় ওই গ্রামবাসীটি_ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই অপরিচিত বালকটিকে (স্বামী বাউলানন্দজী) সেবা কোরতো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, সন্ধ্যের আগে ওই গ্রামবাসী টি চলে যাওয়া মাত্রই দুইজন মহিলা সেই ঘরে আবির্ভূত হোতো। তারা প্রায় নগ্ন দেহে থাকতো, তাদের বিস্তৃত এবং অবিন্যস্ত কেশ, মুখমন্ডল ছিল উজ্জ্বল । এদের একজনের রং ছিল কালো এবং অন্যজনের ফর্সা। তাদের মনোমুগ্ধকর হাসি সেই অসহায় বালককে সাহস এবং শক্তি যোগাতো। তাদের স্পর্শে তিনি শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে অনেকটা আরাম পেতেন। তারা কেউ কাউকে কোনো কথা বলতো না_ শুধু সারারাত্রি তারা রোগীর শয্যার দুই পাশে বসে তরুণ স্বামীজীকে মৌন সান্ত্বনা দিতো। স্বামীজী তাদের মুখ-পানে চেয়ে থাকতেন এবং নিরীক্ষণ করে দেখতেন তাঁর মায়ের সঙ্গে তাদের মিল আছে কি না!! তারা যেই হোন না কেনো_ স্বামীজি তাদের উপস্থিতি খুবই উপভোগ করতেন! সারা রাত্রি এইভাবে কেটে যাওয়ার পর সকালে যখন গ্রামবাসী টি এসে দরজায় ধাক্কা দিতো_ তখন ওই মহিলা দুটি অদৃশ্য হয়ে যেতো। স্বামীজী সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত 18 দিন যাবৎ এইভাবে মা জগদম্বার লীলা চলেছিল।(ক্রমশঃ)
*** *আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা* ***
[ Spiritual Enquiry ]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
<< _স্বামী বাউলানন্দ_ >>
জিজ্ঞাসা :–মহারাজ, এ জগতে দুঃখ-কষ্ট কেনো এবং তার কারণ এবং সেইসঙ্গে দুঃখ-কষ্ট নিরসনের উপায় সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে যে ব্যাখ্যা পেলাম –তাতে আমরা মােটামুটি সন্তুষ্ট। তবে এ ব্যাপারে আমরা আরও একটু জানতে ইচ্ছুক যে, এছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কি ?
মীমাংসা (স্বামী বাউলানন্দ মহারাজ) :— হ্যাঁ সম্ভব।
জিজ্ঞাসা :— যদি সম্ভব হয়, তাহলে তার ব্যাখ্যা তথা মীমাংসা জানতে আমরা আগ্রহী।
মীমাংসা :– দ্যাখো, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সাধারণ-অসাধারণ, সুন্দর-অসুন্দর, জীবনমুখী-সৃজনমুখী –সব রকমের শক্তিই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে এবং সেই সঙ্গে স্বার্থপরতা ও নিঃস্বার্থতা তথা স্বার্থহীনতার শক্তিও রয়েছে, তবে সবার ওপরে বিরাজমান আছে আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সে সমস্ত শক্তিগুলি –যেগুলি বস্তুশরীর, ইন্দ্রিয় ও ব্যক্তির ওপর কোনাে ভেদাভেদ না রেখেই অবতরিত বা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে এবং প্রত্যেকেই সেই শক্তিকে কম-বেশীহারে গ্রহণ তথা শোষণ করছে। এতদ্ব্যতীত অশােষিত শক্তিসমূহ সে সমস্ত বস্তু, শরীর ও ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গুলি থেকে নির্গত হয়ে যাচ্ছে।
দ্যাখো, এই পৃথিবীর অন্তহীন শক্তির সমুদ্রে আধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ও অনাধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিরা অতীতে সর্বদাই ছিলেন এবং বর্তমানেও আছেন ! আধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শক্তির মধ্যে রয়েছে–স্বার্থহীনতা বা নিঃস্বার্থতার শুচিতা ও গুণাবলী, অপরদিকে অনাধ্যাত্মিক-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শক্তির মধ্যে রয়েছে স্বার্থপরতার আবিলতা বা অশুচিতা। এই শক্তিসমূহের মধ্যে সহজাত হয়ে রয়েছে ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া। স্বার্থপর ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে স্বার্থপর ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া, অপরদিকে নিঃস্বার্থ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে নিঃস্বার্থতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রিয়া। স্বার্থপর-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শরীর ও ইন্দ্রিয়গুলি কেবল স্বার্থপর শক্তিগুলিকেই শােষণ করে—অপরদিকে নিঃস্বার্থ-শক্তিবিশিষ্ট ব্যক্তিদের শরীর ও ইন্দিয়গুলি কেবল নিঃস্বার্থশক্তি শোষণ করে। যে সমস্ত ব্যক্তিরা স্বার্থপরতার শক্তি শােষণ তথা গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় স্বার্থপর ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে বা বিপরীত দিকে যে সমস্ত ব্যক্তিরা স্বার্থহীন শক্তি বা নিঃস্বার্থশক্তি শোষণ করে, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় নিঃস্বার্থতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত।
এই ভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তিই সমাজের অপরাপর ব্যক্তির ওপর তাদের স্ব স্ব আধার অনুসারে কেউ কেউ স্বার্থপরতার আবিলতা আবার কেউ কেউ নিঃস্বার্থতার শুচিতা বয়ে নিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সমাজে একটা খাত সৃষ্টি হয় এবং সেই খাতের মাধ্যমেই বিস্তারলাভ করে স্বার্থপরতা অথবা নিঃস্বার্থপরতার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত। এইভাবে সমস্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই মানবসমাজে বিস্তারলাভ করে ভাল ও মন্দ, সৃজনমুখী ও ধ্বংসমুখী, ঠিক ও বেঠিক, পরোপকারী ও অনােপকারী, ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত_ যা নাকি সেইসব আধ্যাত্মিক ও অনাধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সঙ্গে সহজাত হয়ে রয়েছে। এই অবস্থাগুলি অবিরাম ধারায় জগতে চলতে থাকে । আসলে এটা একটা সমষ্টিগত বা সামগ্রিক ব্যাপার। তাই এই অবস্থার উত্তরণের জন্য চাই সামগ্রিক চেতনা আর তা কেবল মানব সমাজই দিতে পারে এবং সেই দেওয়ার উপায় ই হল সামগ্রিক নিঃস্বার্থ চেতনা ।
অতএব সমগ্র মানবের ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপান্তর করে এমন একটা উন্নত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে, যখন কেবল তারা সেই সমস্ত শক্তিই শোষণ তথা গ্রহণ করবে—যার মধ্যে নিঃস্বার্থতারই ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত সহজাত হয়ে রয়েছে । এখন আমরা প্রার্থনা জানাই সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এবং সেই জানা-অজানা আধ্যাত্মিক-শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষদের কাছে, যাঁরা ছিলেন এবং যাঁরা এখন ও এই জগতে – এই বিশ্বে বর্তমান আছেন । তাঁরা যেন প্রত্যেক ব্যক্তিকে এমন ভাবে মহৎ করে তােলেন, যাতে তারা প্রত্যেকেই একটি করে খাতের সৃষ্টি করে—যার মধ্যে দিয়ে কেবল নিঃস্বার্থ ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, ক্রিয়া ও সিদ্ধান্তের স্রোত বয়ে চলে এবং এটাই হবে মানবসমাজের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য আর এই প্রার্থনা যেন সমগ্র মানবজাতির তরফ থেকেই হয় ।
[ স্বামী বাউলানন্দজীর ‘আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা’ ( Spiritual Enquiry ) গ্রন্থ সমাপ্ত হল । ]