স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। স্বামীজী ভদ্রাচলম্ যাবার পথে গোদাবরী নদীর একটি বালুচরে জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে অদ্ভুত মূর্তিতে প্রকাশিত মা জগদম্বার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন । ইঙ্গিতে মা তাঁকে follow করতে বলেছিলেন। মাকে follow করে স্বামীজি বহুদূর পথ অতিক্রম করার পর এক জায়গায় দেখলেন মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই সময় এক অপার্থিব আনন্দে তাঁর মন প্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
পরদিন সকালে যখন তাঁর ঘুম ভাঙলো তখন তিনি দেখলেন মা যেখানে অদৃশ্য হয়েছিলেন_ সেই স্থানে রয়েছে একটি পাথরের শিবলিঙ্গ! স্বামীজি এটি দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ! গত রাত্রে কি কি ঘটেছে সব তাঁর খেয়াল ছিল!✓রী মায়ের মুখ এবং মায়ের বিশাল শরীর সব‌ই তাঁর মনে পড়ছিল। স্বামীজী অনুভব করলেন যে, মা এখানে শিবলিঙ্গ রূপে তাঁর সামনে বিরাজ করছেন।
স্বামীজি এখন বুঝতে পারলেন যে মা জগদম্বার ইচ্ছা যে তিনি ওই স্থানে থেকে তপশ্চর্যা করেন। তিনি ঐখানেই পুরোপুরিভাবে থাকার সংকল্প করলেন এবং যথাবিহিত প্রস্তুতির জন্য পুনরায় তিনি রাজমন্দ্রিতে ফিরে এলেন।
সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে সেই স্থানে গিয়ে স্বামীজী দেখলেন যে, গৌরীপট্রসহ শিবের অর্ধেকটা মাটিতে ঢাকা! জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি! গগনচুম্বী নানা গাছের মধ্যে ছিল কাঁঠাল, বট এবং বিভিন্ন বন্য গাছ! শিবলিঙ্গের একপাশে এই বনাঞ্চল এবং অন্য পাশে ছিল একটি ঝর্ণা ! সেই ঝর্ণার নিচ থেকে শুরু হয়েছে আবার ঘন বন। বড় বড় গাছ এবং লতাগুল্ম দিয়ে সেই বনটি যেন দূর্ভেদ্য বলে মনে হচ্ছিল।
স্বামীজি অবাক হয়ে সমগ্র এলাকাটি দেখতে লাগলেন। এই স্থানের নির্জনতা এবং সৌন্দর্যে তিনি বিমোহিত হলেন! একদিকে গোদাবরী নদী, অপর দুইদিকে বনাঞ্চল সহ প্রাচীর সদৃশ্য পাহাড় এবং চতুর্থ দিকে দূরে সমতলভূমি । এই সমতলভূমিতে ছোট ছোট কয়েকটি কুটীর দেখা যাচ্ছিল। প্রকৃতি মায়ের বৈচিত্র্যময় এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হলেন। প্রকৃতির এইসব রূপ ✓রী মায়ের‌ই সৌন্দর্যের প্রকাশ বলে_ তাঁর মনে হলো! তিনি তৎক্ষণাৎ শিবলিঙ্গের চারপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে, শিবলিঙ্গটিকে তুলে _সেইস্থানেই ঠিকমতো করে বসালেন এবং এরপর তিনি নিকটবর্তী বেলগাছের পাতা নিয়ে এসে ওই শিবলিঙ্গকে পূজা করলেন।
পূজা অন্তে সেখানে বসে বসে স্বামীজী__ গত রাত্রির মা জগদম্বার দর্শন বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলেন ! তিনি মনে মনে নিজেকে খুব‌ই ধন্য ভাবলেন, কারণ মা জগদম্বা মানব শরীরে আবির্ভূত হয়ে তাঁর সামনে দেখা দিয়েছিলেন। যাদের মন কাম- ক্রোধ- লোভ- আসক্তি- ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতা প্রভৃতি দোষমুক্ত __তারাই কেবলমাত্র মা জগদম্বার স্থুল দর্শন পেয়ে থাকেন।স্বামীজি তাঁর জীবনে নানারকম পরীক্ষার মধ্যে পড়েছিলেন এবং সবরকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্বামীজীর মধ্যে উপরিউক্ত দোষগুলির যে কোনো একটিও যদি থাকতো, তাহলে আলুলায়িত কেশবিশিষ্ট বিশাল কৃষ্ণকায় মূর্তি দেখে হয়তো ভয়েই তিনি মারা যেতেন অথবা উলঙ্গিনী নারী শরীর দেখে তার মনে ইন্দ্রিয়ের প্রভাব কাজ কোরতো! কিন্তু এগুলি কোনোটিই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি‌। তিনি তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়ের উপর জয়ী হয়েছিলেন। তাই মা জগদম্বা তাঁকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ।
বহু সাধক মা জগদম্বার মোহিনী মূর্তি দর্শন করে প্রলুব্ধ হয়ে পড়েন। যদি কোনো সাধক প্রলোভনে পড়েন এবং মা জগদম্বাকে চিনতে না পারেন __তাহলে তাঁরা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন! কিন্তু স্বামীজীকে এগুলির কোনটিতেই পড়তে হয়নি! তিনি সকল পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন।
যে স্থানে স্বামীজি শিবলিঙ্গটিকে দেখতে পেয়েছিলেন সেই স্থানের নাম‌ই বর্তমানে “রামকৃষ্ণ মুনিবাতম্” এবং পাশের গ্রামটির নাম‌ই হোল পেরেন্টাপল্লী । পেরেন্টাপল্লী তৎকালীন হায়দ্রাবাদের নিজাম রাজ্যের শেষ সীমা ছিল।(ক্রমশঃ)
==============©================
*MESSAGE TO HUMANITY*
~ _Swami Baulananda_
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পৃথিবীতে কোন সময়েই বর্তমানের ন্যায় এত বেশী লোক সংখ্যা ছিল না। মানব জাতির ইতিহাস পাওয়া গেলে দেখা যাবে যে, বহু পূর্ব থেকেই লোক গণনা প্রথা চালু ছিল। তবে স্থানে স্থানে এর পরিবর্তন লক্ষিত হয়। কোন স্থানেই এই হিসাব সংরক্ষণ নিয়মিত ছিল না। এমন কি এই অনিয়মিত হিসাব সংরক্ষণের কোন ধারাবাহিকতাও ছিল না। এর বিভিন্ন কারণ ছিল । এদের মধ্যে মুখ্য কারণ হল ধর্ম ; ঐ সকল অঞ্চলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন হল এর গৌণ কারণ ।
অবশেষে বর্তমান যুগে কোন কোন অঞ্চলে নিয়মিত হিসাব সংরক্ষণের প্রথা চালু হল। এই প্রথা ক্রমে অন্য অঞ্চলে প্রসার লাভ করল। এই প্রথা সমগ্র আবিষ্কৃত পৃথিবীর অন্তর্ভুক্ত হল না; সে জন্য ইহা তখনও সার্বজনীন হয়ে উঠল না।
নিয়মিত এবং ধারাবাহিক লোকগণনার হিসাব সংরক্ষণের সূচনা থেকে আরম্ভ করে যদিও কোন কোন স্থানে লোক সংখ্যার হ্রাস হয়েছে, তথাপি বতমান সময় অবধি একটা ক্রমবর্দ্ধমান ভাব দেখা যায় । হয়ত এই ক্রম বৃদ্ধির হারের হ্রাস হয়েছে তথাপি স্থূল এবং সূক্ষ্ম বস্তু, ব্যক্তি অহং এবং বিশ্ব অহং, ব্যক্তি মন এবং বিশ্ব মন, বিশ্ব শক্তি আত্মায় না মেশা পর্যন্ত একাদিক্রমে এই বৃদ্ধি সুনিশ্চিত ছিল ।
মানব ক্রমাগত সুখী এবং নিরাপদ হওয়ার প্রবণতায় প্রবৃত্ত হল। কিন্তু প্রগতি কি এবং কেমন করে তা অর্জন করা যায় সে সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা ছিল না। প্রগতির পথে সুখ এবং নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল হল, কিন্তু তাতে তারা তৃপ্ত হল না। এই সকল কারণে তারা মানবীয় সত্তায় উন্নীত হতে পারল না। আবার কাণ্ডজ্ঞান থাকায় পুনরায় অমানবীয় সত্তা হওয়ার পক্ষেও অনোপযুক্ত হয়ে উঠল। তারাই এই পৃথিবীতে মানব জাতি ।
মানুষকে এই পাঠে “পুনরায় মানব শরীরধারী” বলা হয়েছে। প্রগতি সম্বন্ধে ( প্রগতি কি এবং কেমন করে তা অর্জন করা যায় ) সম্যক জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে এরকম হতেই হবে। আর এ সম্বন্ধে সচেতন হতে হলে তাদের শরীরের এক বা একাধিক বার মৃত্যু ঘটা দরকার এবং এই পৃথিবীতে পুনরায় শরীর ধারণ করা দরকার । ক্রমাগত লোকসংখ্যা বৃদ্ধির এটা হল অন্যতম কারণ।
প্রগতি দু-ধরনের –’উর্ধ্ব প্রগতি’ এবং ‘বাহ্য ( Out ward ) প্রগতি’। সুখ এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অতৃপ্ততার ফলে যে অবস্থা মানুষকে পুনরায় শরীর ধারণ করতে বাধ্য করে তার নাম ‘বাহ্য প্রগতি’। আর যে অবস্থা মৃত্যুর পর মানুষকে এই বাধ্যবাধকতার ঊর্দ্ধে রাখে, পুনরায় মনুষ্য শরীর ধরণের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে (কারণ সুখ এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সে তৃপ্ত) তা ‘ঊর্দ্ধ প্রগতি’। স্বাভাবিক ধারায় যেহেতু ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ চেতনাযুক্ত বিভিন্ন অমানবীয় জীব মানুষের সংস্পর্শে আসছে সেইহেতু মানব এবং অমানবীয় শক্তির বিচ্ছুরিত এবং স্পন্দিত অনুগুলির পরস্পরের সংস্পর্শ ঘটছে। নিজ জাতির এবং অন্য বিভিন্ন জাতির মধ্যে এই সংস্পর্শ ঘটছে। যে সমস্ত অমানবীয় সত্তার পরোক্ষ বা অপরোক্ষ ভাবে মানবীয় সত্তার সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটে তাদের মধ্যে সংস্পর্শ ঘটছে। এই সংস্পর্শ সার্বজনীন নীতি, ঊর্ধ্ব প্রগতি সুখী ও নিরাপদ হওয়ার সাধারণ প্রবণতা অনুযায়ী সার্বিক প্রয়ােজনের তাগিদে কেবলমাত্র মানবীয় সত্তায় বর্তমান যে উচ্চ চেতনা–তা পাবার উপযুক্ত হয় ।
অমানবীয় সত্তায় থাকাকালীন অমানবীয় সত্তার উচ্চ চেতনাগুলি হল মানবীয় সত্তায় থাকাকালীন মানবের কাণ্ডজ্ঞান। ঠিক সেই অমানবীয় সত্তাগুলি উচ্চ চেতনা পেয়ে, মানবত্ব অর্জনের যোগ্যতা প্রাপ্ত হয়ে এবং উৎকর্ষ মানব চেতনায় পুষ্ট হয়ে মানবরূপে চিহ্নিত হয় । সুতরাং ঐ সমস্ত বিভিন্ন প্রকারের অমানবীয় সত্তা যা মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে এবং উচ্চ চেতনা পেয়েছে সেগুলি মৃত্যুর পর কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মনুষ্যরূপে শরীর ধারণ করে। এইভাবে পৃথিবীতে জন সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। যদিও মানবীয় সত্তাতেও সুখী এবং নিরাপদ হওয়ার প্রবণতা রয়ে গেল তথাপি অমানবীয় সত্তার সুখী এবং নিরাপদ হওয়ার প্রচেষ্টা যেমন ‘সুখী হওয়া এবং নিরাপদ হওয়া’–এই প্রবণতার উপর প্রতিষ্ঠিত, মানুষের ঐ প্রাপ্তির প্রচেষ্টা কিন্তু সে রকম হল না । তাদের এই প্রচেষ্টা হল দৃঢ় বিশ্বাস, প্রগতির ক্ষেত্রে সুখ এবং নিরাপত্তার নিশ্চিত নির্ভরশীলতার সচেতনতা বা কাণ্ডজ্ঞানের উপর।
কিন্তু সূক্ষ্ম সক্রিয় চেতনার অবলম্বন ব্যতিরেকে কাণ্ডজ্ঞান দু-ধরনের প্রগতির ( বাহ্য এবং ঊর্ধ্ব ) অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী হল না। এই জন্য ‘বাহ্য প্রগতি’র মাধ্যমে সুখ এবং নিরাপত্তা লাভের অসম্ভাবনা সম্বন্ধে অবগত হল না । … [ক্রমশঃ]