গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের প্রথম বিদেশ যাওয়ার সময় যে সমস্ত অলৌকিক বা অতিলৌকিক ঘটনাসমূহ ঘটেছিল সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছিল ৷ গুরু মহারাজ যখন ঘটনাটা আমাদেরকে বলছিলেন – তখন উনি নিজেও খুব হাসছিলেন এবং ঐ সব কথা শুনতে শুনতে আমরাও (উপস্থিত ভক্তরা) ভীষণ মজা পাচ্ছিলাম ! কিন্তু সেদিনকার ঘটনাটা সত্যিই একটা মারাত্মক ব্যাপার ছিল ! ওই ঘটনাটা যদি স্বয়ং গুরু মহারাজের না হয়ে অন্য কোন সাধারণ মানুষের হতো – তাহলে সত্যিই সে খুবই মুশকিলে পড়ে যেতো ! কিন্তু গুরু মহারাজ তো ‘মায়ের কোলে বসে থাকা ছেলে’ – তাই তাঁর আর কি দুঃচিন্তা ! তিনি দিব্যি নিশ্চিন্তে প্লেনে উঠে বসে ‘অসলো’-তে নেমেছিলেন এবং অসলো বিমানবন্দর থেকে দু-তিনশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেয়নের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন ! কিন্তু সেসব কথা পরে বলবো , এখন প্রথম থেকে ঘটনাটা বলি । গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “হিথরো বিমানবন্দরে বেয়ন এবং আমি অসলোগামী বিমান ধরার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম । তারপর আমি যেই সিঁড়িতে উঠেছি অমনি গেট বন্ধ হয়ে গেল ! আচমকা ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় বেয়নও প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল – ওর বিহ্বলতা কাটতে কাটতেই তখন আমি অনেকটা উপরে উঠে গেছি (সম্ভবত চলমান সিঁড়ি ছিল) ! শুধুমাত্র ও একবার হাত নাড়লো , আর তার জবাবে আমি একবার হাত নাড়লাম । ব্যস ! ঐটুকুই হোল , আর কোনো যোগাযোগ থাকলো না ।” এরপর গুরু মহারাজ বিমানে আরাম করে বসে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে অসলো বিমানবন্দরে নেমে পড়েছিলেন ৷ কিন্তু এবার কি করবেন ? কোনদিকে যাবেন – কি করবেন , কিছুই তো জানেন না ! নিজের পাসপোর্ট-ভিসা সহ কোন কাগজপত্রও সঙ্গে নাই , সব বেয়র্নের ব্যাগে ছিল ! তাহলে এবার তিনি কি করবেন ? “মায়ের ছেলে”-র আবার দুর্ভাবনা কি ? উনি তো জানেন ব্যবস্থা একটা কিছু হবেই! গুরুমহারাজ বিদেশ যাওয়া নিয়ে জিজ্ঞাসার উত্তরে একবার আমাদেরকে বলেছিলেন – ” আমার কাছে আবার এদেশ-ওদেশ কি ? ওটাতো এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাবার মতো ।” সুতরাং ওনার কোন অসুবিধাই হোল না ! ঐ বিমানবন্দরেই চাকরি করেন একজন অফিসার , যিনি বেয়র্নের পূর্ব পরিচিত এবং বেয়র্নের গুরু যে একজন ভারতীয় সন্ন্যাসী তা জানতেন এবং এটাও জানতেন যে,ঐ গুরুদেব ভারতবর্ষ থেকে দু-এক দিনের মধ্যেই আসবেন। ফলে তিনি গুরু মহারাজের গেরুয়া পোশাক দেখে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি নিজে থেকেই গুরু মহারাজের সাথে আলাপ করে ওনাকে বিমানবন্দরের মধ্যেই ওর নিজের অফিসে নিয়ে গিয়ে বসিয়ছিলেন ৷ একটু কফি বা টিফিন খাওয়ানোর পর ওই ভদ্রলোক গুরু মহারাজকে employee-দের ঢোকা-বেরোনোর gate দিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে বের‌ও করে দিয়েছিলেন! উনি আরও বেশি সময় দিতে পারেন নি – কারণ তিনি on-duty ছিলেন এবং কাজের সময় ফাঁকি দেওয়া ওখানকার সরকারি কর্মীদের স্বভাবে নেই ! যাইহোক, এবার তো গুরু মহারাজ বাইরে বেরিয়ে এলেন – অতঃকিম্ ? এরপর কি হয়েছিল তা উনি নিজের মুখেই বলেছিলেন – “বিমানবন্দরের বাইরে তো এলাম , এবার কি করি! এতক্ষণ ওই ভদ্রলোকের অফিসে বসেছিলাম _সেখানে room heater রয়েছে, তাই বাইরের Temparature সম্বন্ধে কোন ধারণাই করতে পারিনি ! কিন্তু যেই বেরিয়ে এলাম – দেখলাম , কি সাংঘাতিক ঠান্ডা ! একেবারে ‘মাইনাস’ তাপমাত্রা _ তার উপর একটা dry শীতল হাওয়া দিচ্ছিল ! আমাদের দেশের মতো প্রায় উষ্ণ-ক্রান্তীয় অঞ্চলের লোকের পক্ষে তা ছিল সত্যিই মারাত্মক ! একেবারে হি-হি করে দাঁতে দাঁত লাগার উপক্রম ! কিন্তু এই ব্যাপারটা আমি সামলে নিয়েছিলাম! আমার চিন্তার বিষয় ছিল অন্য_ এতক্ষণ বিমানবন্দরের ভিতরে ছিলাম, যে কোনো ভাবে ৪/৫ ঘণ্টা কাটাতে পারলে তো বেয়র্ন ফিরবেই – তখন একসাথে ওর বাড়ি চলে যেতে পারতাম! এখন একা একা রাস্তায় এই ভয়ানক ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব, কিন্তু বেয়র্নের বাড়িই বা কিভাবে যাবো __সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম! এমন সময় দেখি একটা গাড়ি আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো এবং সেই গাড়ির ভিতর থেকে একটা মেয়ে আমাকে কিছু একটা ইঙ্গিত করছিলো, বোধ হয় গাড়ির ভিতরে বসতে অনুরোধ করছিলো ! আমি তার গাড়ির কাছে যেতেই সে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বলল – ” তুমি পরমানন্দ তো ?” ও বেয়র্নের কথা জিজ্ঞাসা করলো_আমি সংক্ষেপে ওকে ঘটনাটা বললাম। সব কথা শোনার পর ও রেয়র্নের অসহায় অবস্থার কথা শুনে খুব হাসলো, তারপর বললো_”আমার গাড়িতে বসো! আমি যদিও অফিসে এসেছি – কর্মরত অবস্থায় রয়েছি _তবু তোমাকে বেয়র্নের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি_ চলো! বেয়র্ন এসে দেখবে যে তুমি তার বাড়িতে বসে আছো_সেটা খুবই মজার ব্যাপার হবে!” মেয়েটির নাম ছিল (সম্ভবত) রেদুন! আসলে ও জানতো _আজই বেয়র্নের সাথে গুরুমহারাজ ‘অসলো’ বিমানবন্দরে ঐ সময়ে আসবেন_তাই ও অফিস থেকে সময় করে ঐ নির্দিষ্ট সময়ে বিমান বন্দরের সামনে অপেক্ষা করছিলো! গুরু মহারাজ বলেছিলেন_”ওখানকার রাস্তাঘাট অত্যন্ত উন্নত! 8-লেন রাস্তা! দেখলাম মেয়েটি ঘন্টায় 150-180 কিমি বেগে গাড়ি চালিয়ে আমাকে বেয়র্নের বাড়ি পৌঁছে দিল। মেয়েটি দাঁড়ালো না, কারণ ওর অফিসের তাড়া ছিলো! তবে যাবার আগে আমাকে বলে গেলো যে শীঘ্রই ও এখানে আসবে এবং বেয়র্নের অহেতুক টেনশন ভোগের সমস্ত কথা শুনবে!! যাইহোক, ওখানে বেয়র্নের বয়স্ক বাবা-মা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন _ওনারা আমাকে একা দেখে অবাক হয়ে গেলেন”। তারপর সব ঘটনার কথা শুনে তারা _গুরুমহারাজ যে নিরাপদে চলে এসেছেন, তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন এবং বেয়র্ন যে ঠিকই ফিরে আসবে_তারা গুরু মহারাজকে এই আশ্বাসও দিয়েছিলেন! এরপর ওনারা গুরু মহারাজের refreshment-এর এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এদিকে বেয়র্ন বিমানবন্দরে নেমে আতি-পাতি করে গুরুমহারাজকে খুঁজে না পেয়ে _সেখান থেকে পরিচিত জনেদের ফোন করে গুরুমহারাজের খবরটা জানিয়ে দিয়েছিলো! ও কিন্তু বৃদ্ধ পিতামাতাকে ফোন করেনি _কারণ ও ওনাদেরকে অকারণ বিব্রত করতে চায় নি!যতটা পারা যায় _ সবরকম ব্যবস্থা করে বেয়র্ন গাড়ি ধরে যখন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে এসেছিলো _তখন ছিল ওর অবাক হবার পালা!! দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, গুরুমহারাজের জন্য উদ্বিগ্নতা-ভয় _ইত্যাদি সবকিছুই ও একেবারে ভুলে গিয়েছিল, যখন ও বাড়ি পৌঁছে দেখলো __খাওয়া দাওয়া সেরে, একটু রেস্ট্ করে হাসিমুখে ওকে reception করছেন স্বয়ং গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ!! (ক্রমশঃ)