শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা থেকে পরপর লাইনগুলি তুলে ধরছিলাম। আমরা আগের দিন মানব শরীরে অবস্থিত বিভিন্ন সরোবর এবং চতুর্দশ ভুবনের আলোচনায় ছিলাম। এবার এখন আমরা আবার ফিরে যাবো গুরুমহারাজের কথায়। দ্যাখা যাক্ – উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদের শুরুতে গুরুমহারাজ দেহতত্ত্বের বিভিন্ন ‘সরোবর’ নিয়ে আরো কি কি কথা বলেছেন।
উনি এরপরে বলেছেন – ” ‘প্রেমসরোবর’– যার অবস্থান দ্বিদল পদ্মে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে। অনাহত চক্রের দ্বাদশদল কমলের মধ্যে ‘মানস সরোবর’-এর অবস্থিতি এবং স্বাধিষ্ঠান চক্রের ষড়দল কমলের মধ্যে ‘কাম সরোবর’ বিরাজমান। সুতরাং মানবদেহের সহস্রার চক্র হতে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত পুরুষ অঙ্গ এবং আজ্ঞাচক্রের নিম্ন প্রদেশ হতে মূলাধার চক্র পর্যন্ত প্রকৃতি অঙ্গ। নরনারী নির্বিশেষে প্রতিটি শরীরে প্রকৃতি ও পুরুষের অবস্থানের ও পরিচিতির একই রূপ।”
তাহলে আমরা গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী (বাউল মত অনুযায়ী) মানব শরীরের চারটি সরোবরের কথা জানলাম অক্ষয় সরোবর, প্রেম সরোবর, মানস সরোবর ও কাম সরোবর এবং এটাও জানলাম যে, মানব শরীরে তাদের অবস্থানগুলি যথাক্রমে সহস্রারে বা সহস্রদল কমলে, আজ্ঞাচক্রে বা দ্বিদল কমলে, অনাহত চক্রে অর্থাৎ দ্বাদশদল কমলে এবং স্বাধিষ্ঠান তথা ষড়দল কমলের মধ্যে ! এছাড়াও জানতে পারলাম যে, অক্ষয় সরোবর এবং প্রেম সরোবর অর্থাৎ সহস্রার ও আজ্ঞাচক্র যেহেতু মানবশরীরের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত – তাই এতোদূর পর্যন্ত মানবের পুরুষ অঙ্গ এবং আজ্ঞাচক্রের নিচের অংশ থেকে মূলাধার পর্যন্ত অংশ যেহেতু মানবশরীরের বামভাগে অবস্থান করে – তাই এগুলি হোলো প্রকৃতি অঙ্গ। বাউলগণের মতে, এই ব্যাপারে বাহ্যিক নারীপুরুষের ক্ষেত্রটা পৃথক নয় অর্থাৎ নারীশরীর বা পুরুষশরীর – এই উভয় শরীরের ক্ষেত্রেই পুরুষ অঙ্গ বা প্রকৃতি অঙ্গের ব্যাপারটা এক।
যাইহোক, আমরা গুরুমহারাজের লিখিত পরবর্তী কথাগুলিতে চলে যাই। এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – অক্ষয় সরোবর হোতে প্লাবন এসে বিরজাতে (বিরজা সূর্যের মানসী কন্যা, নামান্তরে যমুনা) পতিত হয়। বিরজার প্রবাহ ‘প্রেম সরোবর’ পর্যন্ত। পুনরায় ঐ প্রবাহ প্রেম সরোবর হোতে উল্লসিত হয়ে রেবা-তে পতিত হয়। রেবার প্রবাহ ‘মানস সরোবর’ পর্যন্ত। মানস সরোবর হোতে ঐ প্রবাহ উচ্ছ্বলিত হয়ে নর্মদার পতিত হয়। নর্মদার প্রবাহ ‘কাম সরোবর’ পর্যন্ত। এইভাবে ক্রমানুসারে বিরজা হোতে রেবাতে এবং রেবা হোতে নর্মদায় বন্যা এসে ‘কাম সরোবরে’ পতিত হয়।
বাউলগণ বলেন – ‘যদি ঐ ধারাকে বাঁধ দিয়ে অর্থাৎ যোগ-সাধনা ক্রিয়া দ্বারা ঊর্ধ্বমুখী করা যায়, তাহলে ‘মনের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষ’-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এখানে গুরুমহারাজ বাউলমতের কথা বলেছেন, বাউলমত অনুযায়ী ‘দেহতত্ত্বে’-র গুঢ় রহস্যের কথা বলেছেন। উনি সরোবরগুলি ছাড়াও দেহভ্যন্তরস্থ তিনটি ধারার কথা বলেছেন, যেগুলি বাহ্যজগতে তিনটি নদীর নামের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত এবং যেগুলি হোলো ‘বিরজা’, ‘রেবা’ ও ‘নর্মদা’।৷ অক্ষয় সরোবর বা সহস্রার থেকে যে প্লাবন ওঠে, তা বিরজাপথে প্রবাহিত হয়ে ‘প্রেম সরোবর’ বা আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত পৌঁছায়। বিরজার গতি ঐ পর্যন্তই – এরপর আর তার ক্রিয়াশীলতা থাকে না।
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – তারপরে সেই প্লাবনের প্রবাহ ‘প্রেম সরোবর’ থেকে উল্লসিত হয়ে ‘রেবা’-র ধারায় পতিত হয় এবং সেই নিম্নমুখী ধারা ‘মানস সরোবরে’ অর্থাৎ অনাহত চক্রে এসে পৌঁছায়। রেবার প্রবাহ এতোদূর পর্যন্তই, এরপরে তার আর ক্রিয়াশীলতা থাকে না৷ মানস সরোবর থেকে সেই একই প্রবাহ ‘উচ্ছ্বলিত’ হয় এবং নর্মদায় পতিত হয়ে – সেই নিম্নমুখী ধারা বেয়ে ‘কাম সরোবরে’ পতিত হয়। এইভাবে ক্রম অনুসারে অক্ষয় সরোবরের সৃষ্ট প্লাবন প্রথমে বিরজায় পড়ে এবং পরে যথাক্রমে ‘উল্লসিত’ ও ‘উচ্ছ্বসিত’ হয়ে ‘রেবা’ এবং ‘নর্মদা’-র ধারা ধরে আজ্ঞাচক্র বা প্রেম সরোবরে এবং অনাহত চক্র বা কাম সরোবরে পতিত হয়।
উপরোক্ত কথাগুলি থেকে আমরা ভালোই বুঝতে পারলাম যে, এই ধারাগুলি সবই নিম্নমুখী এবং সহস্রার থেকে সৃষ্ট প্লাবনই প্রথমে উল্লসিত হয়, পরে উচ্ছ্বসিত হয় এবং ঐ প্লাবনের উল্লাস বা উচ্ছ্বাস যথাক্রমে বিরজা থেকে রেবায়, পরে রেবা থেকে নর্মদায় এসে পতিত হয় এবং অক্ষয় সরোবর থেকে প্রথমে প্রেম সরোবারে ও পরে কাম সরোবারে এসে পৌঁছায়। এইভাবেই শক্তির নিম্নমুখী গতি সাধারণ মানুষের মধ্যে অব্যাহত থাকে।
কিন্তু গুরুমহারাজ এরপরে বলেছেন যে, বাউলমতে রয়েছে – এই যে নিম্নমুখী ধারা বা প্রবাহ এর গতিপথে বাঁধ দিতে হবে, আর তাহলেই বাউল সাধকদের জীবনের অন্তিম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য লাভ করা যায় অর্থাৎ যদি যোগ-সাধনার দ্বারা ঐ গতিকে ঊর্ধ্বমুখী করা যায় – তাহলেই ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’ বা ‘নিত্যের মানুষ’-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।৷