রূপ-সনাতনকে বৃন্দাবনে পাঠাবার সময় – মহাপ্রভু বলে দিয়েছিলেন তাঁরা যেন শ্রীধামে তাঁর দীন ভক্তদের আশ্রয়স্থল হন। প্রভুর এই মহাবাক্য শিরােধার্য হয়েছিল রূপের জীবনে। ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবের প্রচারিত উপদেশ বিতরণের ফলে দলে দলে ভক্তগণ নানাদিক থেকে বৃন্দাবনে আসছিলেন আর রূপ গােস্বামী অগ্রণী ও উদ্যোগী হয়ে তাঁদেরকে অভ্যর্থনার সঙ্গে তত্ত্ববধানও করছিলেন। যিনি যেমন প্রকৃতির লােক, তাকে সেইভাবে কুটির বাঁধতে দিয়ে সকলের অভাব- অভিযােগ শুনে তাঁদের সুমীমাংসা করে অল্পদিনের মধ্যেই রূপ গােস্বামী বৈষ্ণবমণ্ডলীর কর্তা হয়ে বসলেন। আর বৃন্দাবন বৈষ্ণবমণ্ডলীর মূলকেন্দ্র হয়ে উঠতে লাগল। কোন নতুন ভক্ত বৃন্দাবনে পৌছালে প্রথমেই তিনি রূপ গােস্বামীকে খুঁজে খুঁজে বের করতেন—তাহলেই তাঁর সব ব্যবস্থা হয়ে যেতাে। এইভাবে তিনি শ্রীকৃষ্ণ রচিত রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করতে লাগলেন এক নতুন ভূমিকায়। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের রাজা, রূপ হলেন তাঁর প্রতিনিধি। রূপের সুনাম শীঘ্রই দেশে দেশে প্রচারিত হয়ে গেল। এবং শত শত ভক্ত তাঁর অনুবর্তন করে ব্রজমণ্ডলে এক সঙঘ গড়ে তুললেন।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বিগ্ৰহসেবার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন রূপ ও সনাতন একদিনের জন্যও তা বিস্মৃত হননি। লুপ্ততীর্থ উদ্ধারের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা লুপ্ত শ্রীবিগ্রহের পুনঃ আবিষ্কার বা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যও একান্ত তৎপর ও ব্যাকুল ছিলেন। সনাতন গােস্বামী মথুরার চৌবেজীর গরীব বিধবার কাছ থেকে মদনগােপাল বিগ্রহ সংগ্রহ করেছিলেন। পরম্পরাগতভাবে এই মদনগােপাল বিগ্রহ সেবার ভার পেয়েছিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। বৈষ্ণবসমাজ যখন মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলা লেখার জন্য কৃষ্ণদাসকে খুব পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তখন কৃষ্ণদাস মদনগােপালের মন্দিরে ঢুকে বিগ্রহের “আজ্ঞা” প্রার্থনা করেন। সকল বৈষ্ণবমণ্ডলীর সামনে বিগ্রহের গলার মালা খসে পড়ে। বিগ্রহের পূজারি গােস্বামীদাস সেই মালা তুলে কবিবরের গলায় পরিয়ে দেন এবং সমস্ত বৈষ্ণবগণ হরিধ্বনি দিয়ে কৃষ্ণদাসকে কবিবর হিসাবে এবং মদনগােপালের আজ্ঞাপ্রাপ্ত হিসাবে বরণ করে নেন। কৃষ্ণদাস লেখেন “সেই লিখি মদনগােপাল…”। যে বয়সে কৃষ্ণদাস লিখতে শুরু করেছিলেন সত্যিসত্যিই কৃষ্ণকৃপা, গুরুকৃপা ছাড়া, এতবড় বা এত তথ্যসমৃদ্ধ, জ্ঞানসমৃদ্ধ, ভক্তিগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব ছিল না। উনি নিজেই লিখেছেন :-
“আমি লিখি’, এই মিথ্যা করি অভিমান।
আমার শরীর কাষ্ঠপুতুলী সমান।৷
বৃদ্ধ জরাতুর আমি অন্ধ, বধির।
হস্ত হালে, মনােবুদ্ধি নহে মাের স্থির।৷
নানা-রােগগ্রস্ত—চলিতে বসিতে না পারি।
পঞ্চরােগ-পীড়া ব্যাকুল, রাত্রি-দিনে মরি।৷” –মহতের মহৎ কীর্তি এইভাবেই আশ্চর্যভাবে বা অলৌকিকভাবে সংঘটিত হয় যা বুদ্ধি বিচারেরও অতীত।
মদনগােপাল প্রতিষ্ঠা করার পর সনাতন একদিন উদ্ধার করেন শ্রীকৃষ্ণপৌত্র বজ্রনাভের আমলের গােবিন্দদেবের অষ্টমূর্তি–যা দ্বাপরের পর থেকে অপ্রকটিত ছিল। এই অপূর্ব মূর্তিপূজার ভার স্বয়ং শ্রীরূপ গােস্বামী গ্রহণ করেন এবং হাজার হাজার বছর পর ভক্ত-সম্মুখে মূর্তিকে প্রকট করেন। এই গােবিন্দদেবের উদ্ধারসাধনের কাহিনী আজো ব্রজমণ্ডলের জনমানসে জাগরূক রয়েছে। প্রাচীন শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে রূপ গােস্বামী জেনেছিলেন যে, বৃন্দাবনের যােগপীঠে দ্বাপরের কৃষ্ণ,পৌত্র রাজা ব্ৰজনাভের আরাধিত শ্রীবিগ্রহটি বিরাজ করছেন। কাঁথা-করঙ্গধারী রূপ-সনাতন যখন বৃন্দাবনের অরণ্যে প্রান্তরে তীর্থ উদ্ধারের জন্য ঘুরে বেড়াতেন তখন থেকেই গােবিন্দদেবের কল্পমূর্তি রূপের হৃদয়-সিংহাসন অধিকার করে রেখেছিল। কিন্তু কোথায় সেই বিগ্রহ, কোথায় সেই যােগপীঠ, কোথায় কোন প্রান্তরে, জঙ্গলে, অথবা কোন নদীগর্ভে সেই বিগ্রহ আত্মগােপন করে আছেন। কে দেবে তাঁর সন্ধান! যখন যেখানে যেতেন সকলকে তিনি কাতরকণ্ঠে তাঁর দর্শনলব্ধ বিগ্রহমূর্তির কথা জিজ্ঞাসা করতেন। উপস্থিত ভক্ত, বৈষ্ণব, বৃদ্ধ, কাঙাল, ধনী—সকলকেই জিজ্ঞাসা করতেন। ভক্তের শেষ সম্বল ভগবান, অবশেষে শ্রীরূপ গােস্বামী তাঁরই শরণাপন্ন হলেন। আকুল প্রার্থনা করতে লাগলেন “হে প্রভু ! হে প্রাণনাথ, কোথায় তুমি–কোথায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছ প্রভু ! আমায় তার সন্ধান দাও, তােমার অদর্শনে যে ভক্তের প্রাণ যেতে বসেছে প্রভু !”
ভগবান কিন্তু ভক্তের এই প্রার্থনা পূরণ করতে দেরি করেননি। যমুনাতীরে সজলনয়নে রূপ একদিন প্রাণের প্রাণ শ্রীগােবিন্দকে স্মরণ করছিলেন, এমন সময় এক শ্যামকান্তি ব্রজবালক রূপের কাছে গিয়ে শুধালাে, “ও বাবাজী! তুমি এখানে বসে বসে নিদ্রা যাচ্ছে না গােবিন্দর ধ্যান করছাে ? যে গােবিন্দর তুমি ধ্যান করছাে সে তাে ঐখানে আছে। ঐ দূরে গােমাটিলার মধ্যে।” চমকে ওঠেন শ্রীরূপ। সেকি! এতদিন নানাজনকে জিজ্ঞাসা করেও যে বিগ্রহের কেউ কোন সন্ধান দিতে পারলাে না—একটা ব্রজবালক কিনা তাঁর অবস্থান বলে দিল ! শ্রীরূপ ব্যাকুল হয়ে বালককে বললেন, ‘’বাবা টিলার ঠিক কোন জায়গায় গােবিন্দজী আছেন ?” ছেলেটি বলল, “তাও জান না বাবাজী! প্রতিদিন দুপুরবেলায় ঐ টিলার এক জায়গায় একটি গাইগরু এসে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আপনা-আপনি দুধ ঢেলে দিয়ে যায়। ওর নীচেই তাে রয়েছেন গােবিন্দজী।” বলেই ছেলেটি অকস্মাৎ অন্তর্হিত।
এই দিব্যদর্শনের পর গোস্বামীর মন-প্রাণ এক দিব্য আনন্দে ভরে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন এটা কি কোন ব্রজবালক না স্বয়ং ব্রজকিশোর শ্রীগােবিন্দজী ! প্রকৃতস্থ হবার পর রূপ গােস্বামী ছুটে গেলেন নিকটবর্তী গ্রামে, তাদেরকে জানালেন তাঁর দিব্যদর্শনের কথা। ব্রজবাসী লােকেরা বললেন, “বাবাজী তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি ঐ টিলার উপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি গাইগরু রােজ দুধ দিয়ে আসে।” রূপ গােস্বামীর নয়নে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। তিনি গ্রামবাসীদের বললেন, “তােমরা সকলে আমাকে একটু সাহায্য কর, সকলে চল ঐ স্থানে গিয়ে মাটি খুঁড়ে আমাদের প্রাণের ঠাকুর গােবিন্দজীকে বের করে আনি।৷”
শ্রীরূপগােস্বামীর ব্যাকুলতায় গ্রামবাসীরা খননকার্য শুরু করে দিলেন—কিছু মাটি সরানাের পরই গােবিন্দজীর মূর্তি উঠে এল। এবার শ্রীরূপ শাস্ত্র প্রমাণ লক্ষণ মিলিয়ে সমগ্র ব্রজবাসী ও বৃন্দাবনের সাধু-সন্ত-বৈষ্ণবসমাজের সামনে প্রমাণ করে দিলেন যে, ঐ গােমাটিলাই দ্বাপরের যােগপীঠ এবং ঐ মূর্তিই কৃষ্ণ-পৌত্র ব্রজনাভের পূজিত শ্রীশ্রীগােবিন্দজী। এই ঘটনা যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন দলে দলে ভক্ত-পুণ্যার্থীরা শ্রীশ্রীগােবিন্দজীকে দর্শনের মানসে ঐ স্থানে এসে জমা হতে থাকল। শ্রীরূপ তখন সকলের চেষ্টায় ভাণ্ডারার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরবর্তীকালে রূপ সনাতনের সহকারী রঘুনাথভট্টের এক ধনবান শিষ্য গােবিন্দজীর একটি সুন্দর মন্দির বানিয়ে দেন।
বৈষ্ণবীয় সাধন ও সিদ্ধির মূর্ত বিগ্রহ ছিলেন রূপ গােস্বামী। কোমলতা ও কঠোরতা, বৈরাগ্য ও অনুরাগ, বৈধী এবং রাগানুগা ভক্তি, এসবই একসাথে অপরূপ বৈশিষ্ট্যসমেত ফুটে উঠেছিল শ্রীরূপ গােস্বামীর জীবনে বা বলা যায় মহাজীবনে। ভক্তি ও জ্ঞানের সম্মিলিত যে বিরলরূপ তা দেখা গিয়েছিল রূপ গােস্বামীর জীবনে। ব্যবহারিক জীবনে তিনি ছিলেন ডােরকৌপীনধারী দীনাতিদীন বৈষ্ণব। মহাপ্রভুর শিক্ষার আদর্শস্বরূপ–
“তৃণাদপি সুনীচেন তরােরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদাহরিঃ।৷”
—-কবিশেখর লিখেছিলেন—‘’তরু হতে যেবা হয় সহিষ্ণু, তৃণ হতে দীনতর,
সেই বৈষ্ণব জয়গৌরব ভাবে না সে কভু বড়।” —এই বৈষ্ণবীয় আদর্শ সার্থকরূপে প্রকাশিত হয়েছিল রূপ গােস্বামীর জীবনে। কিন্তু চরম কোমলরূপের মধ্যেও ছিল রুদ্র-কঠোর রূপ। কোন শিষ্য, ভক্ত বা বৈষ্ণবদের আচরণে বা জীবনযাপনে সামান্য শিথিলতা থাকলে তাঁর কোমলমূর্তি মুহূর্তে পরিবর্তিত হত তেজস্বী সিদ্ধপুরুষের রুদ্রমূর্তিরূপে। এইভাবে রূপগােস্বামী বৈষ্ণবসমাজে সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন।
রূপ গােস্বামী একাধারে দিকপাল পণ্ডিত ও অতুলনীয় কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। বিনয় ও দৈন্যতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যশ-প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর কাছে শূকরীবিষ্ঠার ন্যায় ঘৃণ্য পদার্থ। তৎকালে বৃন্দাবনে বিখ্যাত পণ্ডিত, জ্ঞানী ও ভক্তরা আসতেন বিভিন্ন কারণে। একবার এক দিগগজ পণ্ডিত রূপ-সনাতনের পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের কথা শুনে এসেছিলেন তাঁদের সাথে তর্ক করে তাঁদেরকে পরাস্ত করতে। কিন্তু রূপ-সনাতন কোন তর্কে না গিয়ে সেই পণ্ডিতকে বিজয়পত্র লিখে দিয়েছিলেন। তাঁদের শিষ্য ও সন্তান শ্রীজীব গােস্বামী তখন তরুণ। তিনি তাঁর তারুণ্যের চঞ্চলতাবশত ঐ পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন এবং তাঁকে পরাজিত করেন। পণ্ডিতটি ব্রজ ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যান, কিন্তু “যশ প্রতিষ্ঠাকে” “শুকরীবিষ্ঠা”-র ন্যায় অপবিত্র জ্ঞান না করায় শ্রীরূপ সঙ্গে সঙ্গে শ্রীজীবকে আশ্রম থেকে নির্বাসিত করেন। পরে শ্রীসনাতনের চেষ্টায় শ্রীরূপ ও শ্রীজীবের মিলন হয়। রূপ, সনাতন ও শ্রীজীব বৃন্দাবনে “ত্রিরত্ন” নামে পরিচিত ছিলেন। এরাই ছয় গোঁসাই-এর অন্যতম তিন গোঁসাই। বৈষ্ণবসমাজের শিরােমণি রূপ গােস্বামী, রত্ন বা আকরস্বরূপ সনাতন আর নিষ্ঠা, ভক্তি ও সেবার পূর্ণ পরাকাষ্ঠা শ্রীজীব গােস্বামীর মহাপাবন জীবনকথা শুনলে বা পাঠ করলে ভক্তজনের এখনও কল্যাণ হয়। তাই মহাজন বলেছেন– ‘’এই ছয় গোঁসাই-এর করি চরণবন্দন
যাহা হইতে বিঘ্ননাশ অভীষ্ট পূরণ।৷”